কীর্তিময় ক্লাব কাহিনী - ২ : রিয়ালের গ্যালাক্টিকো আর অন্তরালের ধ্রুবতারা - পর্ব ১
আগের পর্বঃ বুসবি বেবস ও একটি ট্র্যাজেডির গল্প
২৫ এপ্রিল, ১৭০৭ সাল। বর্তমান স্পেনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল কাস্তিয়ার ছোট্ট এক শহর আলমানসায় মুখোমুখি হয়েছে ইউরোপের সব বড় শক্তি। একপাশে স্প্যানিশ এবং ফরাসী সৈন্যদের মিলিত বাহিনীর নেতৃত্বে আছেন বিখ্যাত ইংরেজ কমান্ডার ডিউক অফ বারউইক, অন্যদিকে ইংরেজ, ওলন্দাজ আর পর্তুগীজ সৈন্যদের মিলিত বাহিনীর নেতৃত্বে আছেন 'আর্ল অফ গ্যালওয়ে' নামে পরিচিত হেনরি। যুদ্ধে ডিউক অফ বারউইকের যুদ্ধকৌশলের কাছে পরাজিত হন হেনরি। স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের অধিকার নিয়ে সংঘটিত এই যুদ্ধ ইতিহাসে পরিচিত ব্যাটল অফ আলমানসা নামে। এই যুদ্ধ সম্পর্কে বলা হয়, সম্ভবত ইতিহাসের একমাত্র যুদ্ধ যেখানে ইংরেজদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এক ফরাসী আর ফরাসীদের কমান্ডার ছিলেন এক ইংরেজ।
ব্যাটল অফ আলমানসা ছাড়াও এই ছোট শহরটি প্রতি বছর মে মাসের ১ তারিখ থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত চলা ''মুর এন্ড ক্রিশ্চিয়ান'' উৎসবের জন্য বিখ্যাত বটে।
আজকের এ গল্প ব্যাটল অফ আলমানসা বা ঐ ৬ দিন ব্যাপী চলা উৎসবকে নিয়ে নয়। গল্পটা ইতিহাসকে ভেঙ্গে নতুন ইতিহাস তৈরি করা এক ভদ্রলোকের জীবন নিয়ে।
৫৩১ বর্গ কিমি আয়তনের এই শহরে ব্যাটল অফ আলমানসার ১৮৮ বছর পর জন্মগ্রহণ করল এক শিশু। শিশুটির জীবন ৮২ বছর দীর্ঘ হয়েছিল এই মর্ত্যে। যার প্রায় পুরোটাই বিলিয়ে দিয়েছিলেন একটা দলের জন্য।
স্বপ্ন লালনের সূচনা
শৈশব পার করার আগেই পরিবার পাড়ি জমালো মাদ্রিদে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে যোগদান করল তার চেয়ে বয়সে ছোট মাদ্রিদের একটা ক্লাবের যুবদলে। ক্লাবটার জন্ম হয়েছে ১৯০২ সালে। ছেলেটার জন্মের ৭ বছর পরে। ১৯০৯ সাল থেকে ১৯১১ সাল, প্রায় ৩ বছর ক্লাবের যুবদলে গোলের পর গোল করে গেল এই কিশোর। ১৯১২'র শুরুতে এসে বয়স যখন ১৭ ছুঁই ছুঁই করছে সুযোগ পেলেন মূল দলে। সেখানে প্রায় ১৫ বছর ধরে খেলে গেল এই স্ট্রাইকার।
প্রথম কয়েক বছর সাধারণ খেলোয়াড় হিসেবে থাকলেও নেতৃত্ব গুণ, মাঠে সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা যোগ্য হিসেবেই বাহুতে পড়িয়ে দেয় অধিনায়কের আর্মব্যান্ড। সেসময় স্পেনের ফুটবলে তেমন কোন ক্লাব প্রতিযোগিতা না থাকায় শিরোপার মানদণ্ডে তার অসাধারণ নৈপুণ্যে ভাস্বর খেলোয়াড়ি জীবনকে বিচার করার উপায় নেই। ৬৮৯ ম্যাচে ৩৪০ গোল প্রমাণ করে স্ট্রাইকার হিসেবে দুর্দান্ত ছিলেন এই ভদ্রলোক। মাত্র ১টি কোপা দেল রে বা কিংস কাপ দিয়েই শেষ হয়েছে ক্যারিয়ার।
খেলোয়াড় হিসেবে অবসর নিলেও ক্লাবের প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ তার মনকে ক্লাব ছেড়ে যেতে সায় দিল না। ১৯২৭-৩৫ এই সময়টাতে ক্লাবের সাথেই থাকলেন তিনি। যোগ দিলেন ক্লাবের পরিচালনায়। প্রথমে ক্লাবের একজন পরিচালক হিসেবে, তারপর মূল দলের সহকারী ম্যানেজার আর শেষে পুরোদস্তুর ম্যানেজার হিসেবে ক্লাবকে সহায়তা করতে লাগলেন। তাঁর সময়ে ম্যানেজার হিসেবে দু'বার লা লিগা জেতালেন মাদ্রিদ শহরের এই ক্লাবটাকে। সাথে ১৯৩৪ এবং ১৯৩৬ এর কিংস কাপ।
তারপর ১৯৩৬ সালে শুরু হয়ে গেল স্পেনের গৃহযুদ্ধ। নিজেও যুদ্ধে অংশ নিলেন। এ সময় সকল ক্লাব কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ছিল স্পেনে।
ছাই থেকে ফিনিক্স পাখির প্রত্যাবর্তন
যুদ্ধ শেষে আবার ফিরে এলেন প্রিয় ক্লাবে। এসে যা দেখলেন, তা ভাষায় বর্ণনা করার মত না। পুরো ক্লাবটা এক অর্থে মরে গেছে। ক্লাবের সব অর্জন, দালানকোঠা, মাঠ এখন কেবল ধ্বংসস্তূপ। ক্লাবের পরিচালকদের বেশিরভাগ যুদ্ধের সময় নিহত হয়েছেন, অনেকেই নিখোঁজ, এমনকি ট্রফিগুলোর প্রায় সবকটি চুরি হয়ে গেছে। ক্ষমতায় তখন জেনারেল ফ্রাংকো। তার পছন্দের ক্লাব অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ। ক্লাবকে পুনরায় দাঁড় করাতে গিয়ে ব্যাপক সমস্যায় পড়লেন এই সাবেক স্ট্রাইকার। কারণ, তার এই প্রিয় ক্লাবটার নাম রিয়াল মাদ্রিদ। যারা কিনা আবার অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের চিরশত্রু। ফ্র্যাংকো অ্যাথলেটিকোর পুনঃসংস্থানে প্রচুর অর্থ সাহায্য দিলেও রিয়ালকে বলতে গেলে কানাকড়িও দিলেন না। হাল ছেড়ে দিলেন না এই ভদ্রলোক। মাসের পর মাস তিনি ক্লাবের পুরনো খেলোয়াড়, কোচ, কর্মকর্তা, পরিচালকদের খুঁজে বের করে তাদের একত্র করলেন। এদের সাহায্যে ক্লাবটিকে আবার দাঁড় করালেন।
১৯৪৩ সালে রিয়াল মাদ্রিদ বার্সেলোনাকে হারানোর পর সমর্থকদের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গায় মারা যান অনেকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার দুই ক্লাবের প্রেসিডেন্টকে পদ থেকে অবসর নিতে বাধ্য করে। সেসময় ক্লাবের পরিচালকদের সমর্থনে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন ভদ্রলোক। তখন থেকে আমৃত্যু এই পদে ছিলেন ভদ্রলোক।
ভদ্রলোকের পরিচয় এবার দেওয়া যাক! উনার নাম সান্তিয়াগো বার্নাব্যু ইয়েস্তে।
কিন্তু সাফল্য আসেনি। সময় লেগেছে, কারণ, ক্লাবের তখন ভগ্নদশা। আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ খুব কম, ভাল খেলোয়াড় নেই। আর সেসময়ে রমরমা অবস্থা চলছে অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ, অ্যাথলেটিকো বিলবাও আর বার্সেলোনার। তাদের শক্তিশালী দলগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে চলার মত দল নয় রিয়াল মাদ্রিদ।
তিনি ঠাণ্ডা মাথায় সময় নিয়ে ক্লাবের পুনর্গঠনে মনোযোগ দিলেন। ক্লাবের সবদিককে ধীরে ধীরে বদলাতে থাকলেন। ক্লাবের কর্মকর্তা এবং টেকনিকাল টিম গঠন করলেন যারা দল নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা পাবেন। ক্লাবে নিয়ে আসলেন এমন কিছু মানুষকে যারা একাধারে পরিশ্রমী, গুণী এবং বড় লক্ষ্যের প্রতি দৃষ্টি দেন। তেমনি একজন ছিলেন রাইমুন্দো সাপোর্তা। যিনি রিয়াল মাদ্রিদের ফুটবলের পাশাপাশি বাস্কেটবলে রিয়ালকে শক্তিশালী দলে পরিণত করা শুরু করেন।
এরপর ১৯৪৭ এ বার্নাব্যু মনোযোগ দেন ক্লাবের নিজস্ব স্টেডিয়াম নির্মাণের প্রতি। নুয়েভো শামার্তিন নামক এই স্টেডিয়াম নির্মাণের সময় ছিল সমগ্র ইউরোপের সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম। তখন তাচ্ছিল্য করে বলা হত, ''ছোট ক্লাবের বিশাল স্টেডিয়াম''। সাথে সাথে নির্মাণ করেন ক্লাবের ট্রেইনিং কমপ্লেক্স ''সিউদাদ ডেপোর্তিভা'' যাতে করে খেলোয়াড়রা অনুশীলনের সময় স্টেডিয়ামের মাঠ নষ্ট না হয়।
দলের প্রাক্তন খেলোয়াড় মিগুয়েল মালবো ১৯৫০ এ গঠন করেন ক্লাবের যুব একাডেমী যা লা ফ্যাব্রিকা নামে পরিচিত হয়। মালবো নিয়ে আসেন আরেক সাবেক খেলোয়াড় সান জোসেকে। প্রায় ৫০ বছর ধরে মালবো লা ফ্যাব্রিকার পরিচালক হিসেবে ক্লাবকে সার্ভিস দেন।
এর মাঝে সাফল্য যে আসছিল না একেবারেই তা কিন্তু নয়। লা লিগা না জিতলেও ১৯৪৬-৫০ সময়ে রিয়াল ১৯৪৬ এবং ১৯৪৭ এ কিংস কাপ (স্প্যানিশ কাপ), এবং ১৯৪৭ এ কোপা এভা দোয়ার্তে (স্প্যানিশ সুপার কাপের পূর্ব নাম) জিতে নেয় মাদ্রিদের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত দলটি।
সবশেষে মনোযোগ দেন ক্লাবের মূল দলের প্রতি। রিয়াল মাদ্রিদকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করার প্রয়াস শুরু করেন তিনি। যা শুরু হয় আলফ্রেদো ডি স্তেফানোকে কেনার মাধ্যমে। কয়েক বছরের মধ্যে খেলোয়াড় কেনা এবং ক্লাবের যুবদল মিলিয়ে তৈরি করেন বিশ্বের প্রথম বহুজাতিক ক্লাব দল।
তারপরও কি বহুল আকাঙ্ক্ষিত সাফল্য মাথা নুয়েছিল বার্নাব্যুর কাছে নাকি হেরে গিয়েছিলেন তিনি? পরবর্তী পর্বে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর আজন্ম লালিত স্বপ্নের ভাগ্যে কি ঘটে জানা যাবে হয়ত।
পরবর্তী কিস্তিঃ
রিয়ালের গ্যালাক্টিকো আর অন্তরালের ধ্রুবতারা- পর্ব ২