• সেরা ফুটবল ক্লাব
  • " />

     

    কীর্তিময় ক্লাব কাহিনী - ২ : রিয়ালের গ্যালাক্টিকো আর অন্তরালের ধ্রুবতারা- দ্বিতীয় পর্ব

    কীর্তিময় ক্লাব কাহিনী - ২ : রিয়ালের গ্যালাক্টিকো আর অন্তরালের ধ্রুবতারা-  দ্বিতীয় পর্ব    

     


    আরো পড়ুনঃ 
     

    "বুসবি বেবস" ও একটি ট্র্যাজেডির গল্প

    রিয়ালের গ্যালাক্টিকো আর অন্তরালের ধ্রুবতারা- পর্ব ১


     

    ১৯৫২ সালের মার্চ মাস। ঢাকার রাজপথ যখন ভাষার দাবিতে মুখর, তখন স্পেনের মাদ্রিদ শহরে বসেছে চার ক্লাবের এক ফুটবল টুর্নামেন্টের আসর। আয়োজক রিয়াল মাদ্রিদ। উপলক্ষ ক্লাবের ৫০ বছর পূর্তি। ঐ টুর্নামেন্টের অঘোষিত ফাইনালে মুখোমুখি হয় রিয়াল আর কলম্বিয়ান ক্লাব মিলোনারিওস। এক সোনালী চুলের আর্জেন্টাইনের অবাক করা নৈপুণ্যে ৪-২ গোলে হারল মাদ্রিদ।

     

    ডি স্তেফানোঃ ইতিহাস রচনার সূচনা

     

    মাদ্রিদের কর্মকর্তাদের নজরে আসলো সেই খেলোয়াড়। প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব বার্সেলোনাও মুগ্ধ সেই খেলোয়াড়ে। দু'দল তাকে দলে ভেড়ানোর জন্য দড়ি টানাটানি শুরু করল। বার্সেলোনা সে সময়ের শক্তিশালী দল। ২৬ বছরের আলফ্রেদো ডি স্তেফানোকে ভেড়ানোর জন্য তারা সবরকম চেষ্টা শুরু করল। প্রথম যোগাযোগ করল, এক বিখ্যাত আইনজ্ঞ র‍্যামন ফার্গাসের সাথে যিনি আবার আইনজ্ঞ ছাড়াও ছিলেন মিলোনারিওসের একজন পরিচালক। ফার্গাস মিলোনারিওস এবং বার্সার মধ্যে মধ্যস্ততাকারী হিসেবে সমঝোতা শুরু করলেন। কিন্তু বার্সার প্রথম প্রস্তাব কলম্বিয়ান ক্লাবটি প্রত্যাখ্যান করল।

     

    এরপর বার্সা ফার্গাসের সাথে যোগাযোগ খুব একটা না রেখে ঝুঁকলো রিভার প্লেটের সাথে আলোচনা করতে। কারণ, ডি স্তেফানো আর্জেন্টিনার ফুটবল ধর্মঘটের কারণেই ধারে রিভার প্লেট থেকে মিলোনারিওসে খেলছিলেন। তারা আরেক কলম্বিয়ান হুয়ান বুস্কেটসের মাধ্যমে আলোচনা শুরু করল। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! বুস্কেটস ছিলেন মিলোনারিওসের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব সান্তা ফে’র পরিচালক। তিনি মূলত এই দলবদল যেন বার্সার পক্ষে না যায় সেই চেষ্টাই করেছিলেন। অবশেষে মিলোনারিওসের সাথে একটা সমঝোতা চুক্তি হলেও রিভার প্লেট করে বসলো মামলা। তাদের দাবি, খেলোয়াড় তাদের, তাই তাকে বিক্রি করার সিদ্ধান্তও তাদের। মামলা গড়ালো ফিফার আদালতে। ফিফা ঝামেলা এড়াতে চেয়ে স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের কোর্টে বল ঠেলে দিলেন।

     

    ডি স্তেফানো হয়ত বার্সার খেলোয়াড়ই হয়ে যেতেন কিন্তু দৃশ্যপটে হাজির হলেন এতদিন পর্দার আড়ালে থেকে স্তেফানোকে কেনার জন্য মরিয়া সান্তিয়াগো বার্নাব্যু। স্তেফানো মামলার রায় জানার জন্য মাদ্রিদের বিমানবন্দরে নামার কিছুক্ষণ পরেই বার্নাব্যু তাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে রাজি করালেন মাদ্রিদের হয়ে খেলতে! চুক্তিও স্বাক্ষরিত হল! এ খবর যখন প্রচার হল, বার্সার কর্মকর্তারা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। করে বসলেন পাল্টা মামলা। স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন তখন বেজায় বিপদে! ফিফার পাস করা বল সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে তারা। অনেক দিন ধরে মামলার রায় পেছালো। সবদিক বুঝে শুনে স্পেনের আদালত যে রায় দিলেন তা বড়ই অদ্ভুত।

     

    ৪ বছর স্পেনে খেলতে পারবেন স্তেফানো। এক মৌসুম রিয়ালে, পরের মৌসুম বার্সায়, এভাবে করে দুবছর মাদ্রিদে খেলবেন তিনি, দুবছর কাতালান ক্লাবের হয়ে। বার্সেলোনার পরিচালকদের মাঝে এ রায় নিয়ে লেগে গেল ঝগড়া। সবশেষে বার্সা এ রায় প্রত্যাখ্যান করে স্তেফানো থেকে সরে আসলো। তিনি হয়ে গেলেন রিয়াল মাদ্রিদের। স্তেফানো রিয়াল মাদ্রিদকে নিয়ে ইতিহাস বদলাবেন, এটা জানলে বোধ করি এই সিদ্ধান্ত থেকে তারা সরে আসতেন। স্তেফানোর এই ট্রান্সফার ছিল বোধহয় বিংশ শতাব্দীর ক্লাব ফুটবলে সবচেয়ে আলোচিত দল বদল।

     

     

    বিশ্বের প্রথম বহুজাতিক দলঃ

     

    স্তেফানোকে কেনার পরপর তিনি ধীরে ধীরে তাকে কেন্দ্র করে পুরো দলটা সাজাতে থাকেন। কম মূল্যে ভাল প্লেয়ার কিনতে সিদ্ধহস্ত এই প্রেসিডেন্ট নিয়ে আসেন একের পর এক তারকাকে।

     

    '৫০-র দশকের শেষার্ধে দলটা দেখতে ছিল অনেকটা এরকম। গোলকিপার স্পেনের জুয়ানিতো এবং আর্জেন্টিনার ডমিঙ্গুয়েজ; ডিফেন্সে উরুগুয়ের হোসে সান্তা মারিয়া, স্পেনের ম্যানুয়েল তোরেস; মিডফিল্ডে আর্জেন্টিনার হেক্টর রিয়াল, স্পেনের মিগুয়েল ম্যুনেজ এবং জেন্টো, ব্রাজিলিয়ান দিদি। ফরোয়ার্ড লাইনে আর্জেন্টাইন ডি স্তেফানো, ফরাসী রেমন্ড কোপা, সাথে ৫৪’র বিশ্বকাপ কাঁপানো হাঙ্গেরির ''গ্যালোপিং মেজর'' ফেরেঙ্ক পুসকাস। সাথে রুবিও, রাফায়েল লেসমেসের মত আরও কিছু স্প্যানিশ তারকা খেলোয়াড়।

     

    রিয়ালের সেই দলের আক্রমণভাগের পাঁচ সিংহ: (বাঁ থেকে) রেমন্ড কোপা, হেক্টর রিয়াল, স্তেফানো, পুসকাস, জেন্টো 

     

    ছয়টা দেশের খেলোয়াড় একসাথে খেলছেন সেই সময়ের ফুটবলে এ দৃশ্য কল্পনাতীত। সেটা সম্ভব করেছিলেন বার্নাব্যু। দলের ম্যানেজার হিসেবে ১৯৫৫-৫৭ সময়ে ছিলেন স্পেনের বিখ্যাত কোচ হোসে ভিলালোঙ্গা আর ৫৭-৫৯ সময়ে আর্জেন্টিনার ট্যাক্টিকাল মাস্টার মাইন্ড লুইস কারনিলিয়া। সাথে ১৯৬০ থেকে ১৫ বছর ম্যানেজার থাকা দলের একসময়ের মিডফিল্ড জেনারেল মিগুয়েল ম্যুনেজ।

     

    তখনকার চিরচেনা ফর্মেশন ছিল ১-৪-৫, অর্থাৎ ৪ জন ডিফেন্ডার আর ৫ ফরোয়ার্ডের খেলা। এই ফর্মেশন বদলে ভিলালোঙ্গা নিয়ে আসেন ৪-৩-৩ ফর্মেশন। আজকের যুগের আলোচিত এই তিন ফরোয়ার্ড ফর্মেশন মাদ্রিদকে নতুন ফুটবল খেলতে সাহায্য করে। ডি স্তেফানো-জেন্টো-কোপা এই ফরোয়ার্ডের কম্বিনেশন গোলের বন্যা বইয়ে দেয় ইউরোপের ফুটবলে। পরে যুক্ত হন পুসকাস। জেন্টো নেমে যান কিছুটা নিচে। এই নতুন কম্বিনেশন পুরো বিশ্বকে স্তম্ভিত করতে থাকে বারংবার। 

     

    এই নতুন ফর্মেশন, সাথে গোল না খাওয়াকে অভ্যাসে পরিণত করা রক্ষণদুর্গ, আর সেই প্রজন্মের বাঘা বাঘা সব তারকায় ভরা মধ্যভাগ আর আক্রমণভাগ, কি লাগে আর?

     

    রিয়াল সম্পর্কে সেসময় বলা হত, এই দল যখন তখন খেলায় পরিবর্তন আনতে পারে, ইচ্ছে করলেই গোল করতে পারে আর দলটায় একই সঙ্গে কয়েকজন ঈশ্বর খেলে!

     

    এই দলটা প্রায় ৮-৯ বছর একসাথে ছিল। বার্নাব্যুর স্বপ্নপূরণের সারথীরা দু'পা আর মাথার খেলায় দু'হাত ভরে দিয়েছিলেন মাদ্রিদকে। প্রথমে অ্যাতলেটিকোকে হটিয়ে মাদ্রিদের সেরা ক্লাব, তারপর বার্সা আর অ্যাতলেটিকোর সাথে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে স্পেনের সেরা ক্লাব, আর ইউরোপের বড় আসরে একের পর এক সাফল্য বার্নাব্যুর সন্তান রিয়ালকে এই কয়েক বছরে বানায় বিশ্বের সেরা ক্লাবে। ১৯৫৩-৬০ এই ৮ বছর সময়ের মধ্যে রিয়াল ৫ বার লীগ জেতে।

     

    ইউরোপের সিংহাসন দখলঃ

     

    বার্নাব্যু ছিলেন ইউরোপিয়ান কাপের অন্যতম পরিকল্পনাকারী। তিনি এবং হাঙ্গেরির 'ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স' খ্যাত দলের ম্যানেজার গুস্তাভ সেবেস মিলে এই টুর্নামেন্টের রূপরেখা তৈরি করেন।

     

    এই টুর্ণামেন্টের প্রথম আসর অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৬-তে। ইউরোপিয়ান বড় লীগগুলোর কেবল চ্যাম্পিয়ন দলগুলোকেই নিয়েই হইয়েছিল শুরুর দিককার আসরগুলো। ফাইনালে ফ্রান্সের স্তাদে রেইমস-র বিপক্ষে ৪ গোল সহ ৭ ম্যাচে ২০ গোল করে প্রথম আসরের শিরোপা ঘরে তোলে রিয়াল। সেই থেকে শুরু। টানা ৫ বছর ইউরোপে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখে রিয়াল।

     

    পরের আসর ১৯৫৭ তে ৮ ম্যাচে ১৮ গোল করে আবার চ্যাম্পিয়ন রিয়াল। ফাইন্যালে ২-০ গোলে হারায় ইতালির দল ফিওরেন্টিনাকে। ১৯৫৮ তে ৭ ম্যাচে ২৫ গোল করে রিয়াল। এবার ৩-২ গোলে এসি মিলানকে হারিয়ে আবার ইউরোপের রাজা হয় রিয়াল মাদ্রিদ। 

     

    এর মাঝেই বাদে ঝামেলা। পুসকাসকে মাদ্রিদে নিয়ে আসেন বার্নাব্যু। কিন্তু তখন পুসকাসের বয়স ৩১; শরীরও হয়ে গিয়েছিল ভারী। দু'বছরের বেশি সময় ধরে খেলেননি পেশাদার ফুটবল। নতুন ম্যানেজার লুইস কারনিলিয়া এসব কারণে সন্দিহান ছিলেন পুসকাসকে নিয়ে। পুসকাসকে খুব একটা পছন্দ করতেন না অতিরিক্ত ওজনের কারণে। এমনকি ১ মাসের মধ্যে পুসকাসকে ১৫ কেজি ওজন কমাতে বাধ্য করেন তিনি। পুসকাসকে খেলাননি ১৯৫৯ ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালেও। তারপরও জিতেছিলেন। কিন্তু এর জের ধরে পরবর্তীতে বরখাস্ত হতে হয় তাকে।

     

    ১৯৫৯ আসর জমজমাট হয়ে ওঠে স্তাদে রেইমসের স্ট্রাইকার জাঁ ফঁতের ('৫৮ বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচে ১৩ গোল করেছিলেন ফঁতে; বিশ্বকাপের এক আসরের সর্বোচ্চ গোলের 'প্রায়' অমর রেকর্ড) সাথে স্তেফানোর গোলের লড়াইয়ের কারণে, ফাইনালে ৫৬’র ফাইনালিস্ট জাঁ ফঁতের দলকে আবার ২-০ গোলে হারিয়ে টানা ৪র্থ শিরোপা দখল করে মাদ্রিদ।

     

    ১৯৬০ সালে সব রেকর্ড ভেঙ্গে দেয় রিয়াল। ৭ ম্যাচে করে ৩০ গোল। আগের আসরে ম্যানেজারের সাথে ঝামেলার কারণে পুসকাসকে ফাইনালে পায়নি রিয়াল। এই ফাইনালে তাই আরো বিধ্বংসী ছিল রিয়াল; ৭-৩ গোলে হারায় এইনট্রাক্ট ফ্রাঙ্কফুর্টকে। যা এখন পর্যন্ত ফাইনালে সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয়। ফাইনালে ৪ গোল করেন পুসকাস, সাথে হ্যাটট্রিক করেন স্তেফানো।

     

    ১৯৬০ ইউরোপিয়ান কাপ ফাইন্যালে গোল করার পর ডি স্তেফানোর বিখ্যাত উদযাপন 

     

    এই টানা ৫ ফাইনালে গোল করে স্তেফানো এক অনন্য রেকর্ড গড়েন। আর, টানা ৫ বার জেতার সুবাদে আসল কাপটি সারাজীবন রেখে দেওয়ার অধিকার পায় রিয়াল।

     

    ১৯৬০ সালে প্রথম ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে (বিশ্ব ক্লাব কাপের পূর্ব আসর) উরুগুয়ের পেনারোলকে হারিয়ে শিরোপা অর্জন করে মাদ্রিদ। এটা ছিল অনেকটা কেকের মাঝখানে চেরী ফল বসানোর মত।

     

    ১৯৬০ পরবর্তী সময়ে এই সর্বজয়ী মাদ্রিদ দলের অনেকেই নেন অবসর, কেউ কেউ দল ছেড়ে যান। রিয়ালের ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় মিগুয়েল ম্যুনেজ দলের দায়িত্ব নেন। দলকে গড়ে তোলেন নিজের মত করে।

     

    ৫ লা লিগা, ৫ ইউরোপিয়ান কাপ আর ১টি আন্তঃমহাদেশীয় শিরোপা নিয়ে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেয় এই দল। বার্নাব্যুর দূরদর্শী পরিকল্পনা, সাথে দুর্দান্ত সব তারকায় ভরা দল আর ফুটবল বদলে দেওয়া কয়েকজন ম্যানেজার, এদের নিয়ে মাত্র ৮-৯ বছরে ইউরোপের অন্য সব দল থেকে যোজন যোজন দূর এগিয়ে যায় রিয়াল মাদ্রিদ।

     

    তাঁদের বলা হত রাজাদের রাজা! স্তেফানোকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই দল রিয়ালকে পৌঁছে দেয় সাফল্যের এভারেস্ট চূড়ায়। আজ পর্যন্ত রিয়ালকে কেউ ছুঁতে পারেনি এই বিধ্বংসী দলটার কারণে। 

     

    ১৯৬০ সালের ইউরোপিয়ান কাপ ফাইন্যালের আগে সর্বজয়ী রিয়াল মাদ্রিদ দল 

     

     

    ১৯৬০ পরবর্তী সময়ে কি ইউরোপ আর স্পেনের ফুটবলে আধিপত্য ধরে রেখেছিল রিয়াল মাদ্রিদ? নাকি একটা সোনালী প্রজন্মতেই আবদ্ধ ছিল রাজকীয় মাদ্রিদ দলটি?

     

    প্রশ্নের উত্তর জানতে অপেক্ষায় থাকুন পরের পর্বের জন্য।

     


    আরো পড়ুনঃ 

    রিয়ালের গ্যালাক্টিকো আর অন্তরালের ধ্রুবতারা- শেষ পর্ব