কীর্তিময় ক্লাব কাহিনী -২ : রিয়ালের গ্যালাক্টিকো আর অন্তরালের ধ্রুবতারা - শেষ পর্ব
ইয়ে-ইয়ে জেনারেশন
১৯৬০ সালের বিশ্বক্লাব কাপ জেতার পর থেকেই ৫ বার ইউরোপিয়ান কাপ জেতা দলের অনেকেই নেন অবসর। দু'একজন ক্লাব ছেড়ে যান। তবে তখনো রাজকীয় সাদাদের হয়ে খেলছিলেন ডি স্তেফানো, পুসকাস, জেন্টোরা। দলের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব নেন ১১ বছর দলের হয়ে খেলা তারকা মিডফিল্ডার মিগুয়েল ম্যুনেজ যিনি আবার ১৯৫৬ এবং ১৯৫৭ ইউরোপিয়ান কাপে অধিনায়ক হিসেবেও শিরোপা জিতেছিলেন।
ম্যুনেজ দায়িত্ব গ্রহণ করেই লা ফ্যাব্রিকা থেকে বেশ কিছু তরুণ খেলোয়াড়কে মূল দলে নিয়ে আসেন। অভিজ্ঞতা এবং তারুণ্যের মিশেলে দলটিকে নতুন পথ দেখাতে শুরু করেন তিনি। তরুণ স্প্যানিশদের মধ্যে ছিলেন গোলকিপার হোসে আরাকুইস্তা, ডিফেন্ডার পাচিন, ম্যানুয়েল সানচিস, পেদ্রো, মিডফিল্ডার পিরি, জোকো, সেরেনা, ফরোয়ার্ড আমানসিও, গ্রসো, ম্যানুয়েল ভ্যালকুয়েজ। দলের নেতৃত্ব ভার দেন অভিজ্ঞ ফরোয়ার্ড জেন্টোর হাতে।
১৯৬০-৬১ মৌসুমে অঘটনের শিকার হয়ে প্রথম রাউন্ডেই ইউরোপিয়ান কাপ থেকে বাদ পড়ে রিয়াল, তবে জেতে লা লিগা। পরের আসরে দারুণ খেলতে থাকা দলটি ফাইনালে পুসকাসের হ্যাটট্রিকে প্রথমার্ধে ৩-২ গোলে এগিয়ে থেকেও হেরে যায় বেনফিকার তরুণ স্ট্রাইকার ইউসেবিও ডি সিলভার অতিমানবীয় নৈপুণ্যে। ঐ মৌসুমে ঘরোয়া লীগ ও কিংস কাপের ডাবল জেতে রিয়াল।
১৯৬২-৬৩ মৌসুমে টানা তৃতীয় লীগ জেতে রিয়াল। ঐ মৌসুম শেষে দল ছাড়েন দু'বার ব্যালন ডি’অর জেতা ডি স্তেফানো। পরের মৌসুমে লীগ শিরোপা ধরে রাখলেও ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে ইন্টার মিলানের কাছে হেরে বসে মাদ্রিদ। ১৯৬৪-৬৫ মৌসুমে লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে টানা ৫ বার জেতার গৌরব অর্জন করে ম্যুনেজের শিষ্যরা। কিন্তু মিলছিল না অনেকদিন ধরে ইউরোপিয়ান কাপের দেখা (৫ বছর!)।
ইয়ে-ইয়ে জেনারেশন
১৯৬৫-৬৬ মৌসুমের প্রাথমিক রাউন্ডে ডাচ ক্লাব ফেয়েনুর্দকে দুই লেগ মিলে ৬-২ গোলে হারিয়ে ম্যুনেজবাহিনী শুরু করে হেক্সা মিশন। এরপর প্রথম রাউন্ডে স্কটিশ ক্লাব কিলমারনক-কে (দুই লেগ মিলে ৭-৩), কোয়ার্টার ফাইনালে বেলজিয়ামের আন্ডারলেখটকে (দুই লেগ মিলে ৪-৩) হারিয়ে সেমিতে উঠে রিয়াল মাদ্রিদ। সেমিফাইনালে গত আসরের চ্যাম্পিয়ন ইন্টার মিলানকে হারিয়ে (দুই লেগ মিলে ২-১) প্রতিশোধ নেয় ৬৪’র ফাইনালের। ফাইনালে মুখোমুখি হয় সার্বিয়ান ক্লাব পার্টিজান বেলগ্রেডের। প্রথমে পিছিয়ে পড়েও ২-১ গোলে তাদের হারিয়ে ৬ বছর পর শিরোপা জেতে রিয়াল মাদ্রিদ। টুর্ণামেন্টে ৫ গোল করেন ''দ্য উইজার্ড'' খ্যাত আমানসিও (৭ গোল করে টুর্ণামেন্ট সর্বোচ্চ স্কোরার ছিলেন ইউসেবিও আর ফ্লোরিয়ান আলবার্ট)। সাথে টুর্ণামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হন স্বর্গীয় বাঁ-পায়ের জনক হিসেবে পরিচিত পিরি।
ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে ফাইনালে শুধুমাত্র নিজেদের দেশের খেলোয়াড় অর্থাৎ ''অল স্প্যানিশ'' একাদশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হবার রেকর্ড গড়ে রিয়াল মাদ্রিদ। এই রেকর্ড পরে স্পর্শ করে মাত্র দুটি ক্লাব; সেল্টিক (১৯৬৭) এবং স্টুয়া বুখারেস্ট (১৯৮৬)। রিয়ালের এই ৬ বার ইউরোপিয়ান কাপ জেতা দলের প্রত্যেকটিতে খেলে খেলোয়াড় হিসেবে সবচেয়ে বেশি ইউরোপিয়ান কাপ জেতার রেকর্ড গড়েন অধিনায়ক ফ্রান্সিসকো জেন্টো। পাশাপাশি ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে খেলোয়াড় এবং ম্যানেজার হিসেবে ইউরোপিয়ান কাপ জেতেন ম্যুনেজ। এই ফাইনালে চোটের কারণে খেলেননি পুসকাস। এই মৌসুম পর অবসর নেন তিনি।
নামের পেছনে রহস্য
১৯৬৬ সালের ইউরোপিয়ান কাপ জেতার পর স্পেনের বিখ্যাত পত্রিকা মার্কা’র জন্য ছবি তোলেন চ্যাম্পিয়ন দলের ৪ তারকা। সেসময় পুরো ইউরোপে ব্রিটিশ ব্যান্ড বিটলসের ভয়াবহ প্রভাব, যা ইতিহাসে পরিচিত ''বিটলসম্যানিয়া'' হিসেবে। এই ৪ তারকা খেলোয়াড়সহ পুরো দলই ছিল এই ব্যান্ডের ভক্ত। তারা মজা করে বিটলস সদস্যদের মত করে ঝাঁকড়া চুলের উইগ পরে পোজ দেন ক্যামেরার সামনে; সাথে গাইতে থাকেন বিটলসের বিখ্যাত ট্র্যাক ''শী লাভস ইউ''-র কোরাস অংশ ‘ইয়াহ, ইয়াহ, ইয়াহ’। হঠাৎ করেই সেই কোরাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে দলটির নাম হয়ে যায় ‘ইয়ে ইয়ে জেনারেশন’। এই নামের পেছনে আরেকটি কারণ ছিল, এই স্প্যানিশ খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া দলের অধিকাংশই ছিলেন বয়সে তরুণ, বিটলসের মত করে লম্বা চুল ছিল প্রায় সবার। বলা হত, একদল হিপ্পি খেলছে একসাথে!
'মার্কা'র বিখ্যাত ফটোগ্রাফটি
'ইয়ে ইয়ে জেনারেশন' মূলত ১৯৬১ থেকে ১৯৭২ মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদকে প্রতিনিধিত্ব করেছিল। ১২ বছরে লীগ জিতেছিল ৯ বার। সাথে ২ বার কিংস কাপ আর '৬৬ সালের সেই ইউরোপিয়ান কাপ। দলটি প্রমাণ করে দেখিয়েছিল, ১৯৫৬-৬০ এর রাজত্ব ফ্লুক না। আর, শুধুমাত্র দেশি খেলোয়াড়দের নিয়েও ইউরোপিয়ান আসরে সেরা হওয়া যায়।
'ইয়ে ইয়ে জেনারেশন' ছিল ম্যুনেজের ছাত্রদের দল। ম্যুনেজ প্রায় ১৫ বছর রিয়ালের ম্যানেজার হিসেবে থেকে '৭৪ সালে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন। এরপরে '৭৪-'৭৮ সময়কালেও রিয়াল ৪ বার লীগ জেতে; সাথে দু'বার কিংস কাপ।
বার্নাব্যুরা ইতিহাসে একবারই আসেন...
২ জুলাই, ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ চলাকালীন বার্নাব্যু মারা যান। তাঁর মৃত্যু পুরো ফুটবল বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। শোক পালন করার জন্য বিশ্বকাপে দু'দিন সব খেলা স্থগিত করে রাখা হয় তাঁর সম্মানে।
ফুটবলের অন্যতম বিখ্যাত এই ভদ্রলোক রিয়াল মাদ্রিদের যুবদল থেকে শুরু করে মূল দল, সহকারী ম্যানেজার, ম্যানেজার, ক্লাব পরিচালক, সবশেষে হয়েছিলেন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ছিলেন এই পদে। ৩৫ বছর ধরে প্রেসিডেন্ট পদে থেকে রিয়াল মাদ্রিদকে ভগ্নদশা থেকে সত্যিকারের ফিনিক্স পাখির মত শুধুমাত্র টেনেই তোলেননি, স্পেন, ইউরোপ এবং পুরো বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ক্লাবে পরিনত করেন তিনি।
বেঁচেছিলেন ৮৩ বছর, তার মধ্যে ৬৯ বসন্ত কাটিয়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদে। রিয়ালের প্রতি তাঁর ভালোবাসাকে তুলনা করা অসম্ভবের চূড়ান্ত পর্যায়ে পড়ে।
১৯৫৫ সালে রিয়াল মাদ্রিদের স্টেডিয়ামের নাম বার্নাব্যুর নামে নামকরণ করা হয়। তার মৃত্যুর পর তৎকালীন রিয়াল মাদ্রিদ খেলোয়াড়দের আগ্রহে ১৯৭৯ সাল থেকে প্রতি বছর 'সান্তিয়াগো বার্নাব্যু ট্রফি' আয়োজিত হয় মাদ্রিদে।
বার্নাব্যু মধ্যবয়সে যখন পরিচালক পদে ছিলেন, মাদ্রিদের প্রতি ভালোবাসাকে একটা শব্দে প্রকাশ করেছিলেন, শব্দটা হাল আমলের অনেকের চেনা : ''মাদ্রিদিসমো''। তারপর থেকেই মাদ্রিদিস্তা এবং মাদ্রিদিসমো মাদ্রিদ সমর্থকদের মাঝে জনপ্রিয় হয়।
বার্নাব্যু এবং তাঁর রিয়াল মাদ্রিদকে নিয়ে প্রকাশিত সিরিজের গল্পটা এখানেই শেষ। কিন্তু বার্নাব্যু কখনই শেষ হন না। মাদ্রিদকে নিয়ে কিছু বলতে হলেই চলে আসেন স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল হয়েই। কারণটা জানা। ‘বার্নাব্যুরা ইতিহাসে একবারই আসেন’।
আরো পড়ুনঃ
"বুসবি বেবস" ও একটি ট্র্যাজেডির গল্প
রিয়ালের গ্যালাক্টিকো আর অন্তরালের ধ্রুবতারা- পর্ব ১
রিয়ালের গ্যালাক্টিকো আর অন্তরালের ধ্রুবতারা - পর্ব ২