আইপিএল টানে নি ফ্লিনটফকে
যুগটাকে বলা হয় পেশাদারিত্বের। কথিত পেশাদার ক্রিকেটের মোড়কে আদতে চলছে বাইশ গজের দ্বৈরথটাকে বানিজ্যিকীকরনের সম্ভব সব আয়োজন। সাদা পোশাকে পাঁচদিনের ক্রিকেট এখন আর দর্শক টানে না, লোকে আজকাল আলোর ঝলকানিতে কুড়ি ওভারের ধুন্দুমার ক্রিকেটেই বুঁদ হচ্ছে। কেবলই কি দর্শক? ক্রিকেটাররাও তো পিছিয়ে নেই! দেশের হয়ে টেস্ট খেলার সুযোগ জলাঞ্জলি দিয়ে আইপিএলের অর্থকড়িকে দু’হাত ভরে নেয়ার নজিরও দেখা হয়ে গেছে। তবে এসব দিয়েই যদি এ যুগের ক্রিকেট চিনতে চান তাহলে আপনার সাথে ভিন্ন মত পোষণ করবেন সাবেক ইংলিশ তারকা ক্রিকেটার অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ। ডেইলি মেইলে নিজের কলাম এক সময়ের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডার জানাচ্ছেন ক্রিকেটের নামে টাকাকড়ির খেলা তাঁকে কখনই টানে নি।
২০০৯ সালে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের দ্বিতীয় আসরে চেন্নাই সুপার কিংসে ১৫ লাখ ডলারের এক বিশাল অংকে বিক্রি হয়েছিলেন। কিন্তু ক্যারিয়ার শেষ করে দেয়া ইনজুরির হানায় মাত্র ৩টি ম্যাচ খেলে দেশে ফিরে যেতে হয় তাঁকে। ক্রিকেট খেলে টাকাপয়সার অর্জন জীবনে কম না হলেও এসব টুর্নামেন্টের প্রতি আকর্ষণটা কোনকালেই ঠিক তৈরি হয় নি বলে দাবী ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়কের, “যখন আইপিএল খেলতে গেলাম, উদ্ভট অ্যালেন স্ট্যানফোর্ড ম্যাচ (১ কোটি ২৪ লাখ পাউন্ড প্রাইজমানির ম্যাচটায় ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ) খেলতে গেলাম তখন আমি ক্রিকেটের সাথে আমার আত্মিক সম্পর্ক নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলাম। নিজের সেরাটুকু ওসবে দিতে পারি নি। মনে হত টাকার জন্য তো আমি খেলি না। স্রেফ পয়সার জন্য কোন ম্যাচ কোনদিন খেলতে পারতাম কিনা সন্দেহ আছে। অর্থ বড় জিনিস, এটা নিয়ে মিথ্যে বলব না।”
আইপিএলে নিজের ক্ষণস্থায়ী উপস্থিতির অভিজ্ঞতাটুকু তিক্তভাবেই উঠে এসেছে তাঁর বর্ণনায়, “আমি আমার নিজের দলের সব খেলোয়াড় আর কোচের নামও জানতাম না। শুধু মনে আছে হলুদ একটা জার্সি পড়ে মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতাম, গরমে-ঘামে শরীরে জ্বলুনি উঠে যেত। কেন যেন সবকিছু ঠিক মেলাতে পারতাম না। ওদেরকে দোষ দিচ্ছি না, আমিই আসলে দলটাকে ওভাবে আপন ভাবতে পারি নি।”
ঠিক কি কারণে? ফ্লিনটফ যেন স্বগতোক্তিই করছেন, “অনেক চেয়েছি আইপিএলের প্রতি একটা অনুরাগ তৈরি করতে। কিন্তু হয় নি। আমার কোনকিছুতে ভালোলাগা তখনই আসে যখন সেখানে আবেগের যোগসূত্র থাকে। আর ঠিক এ কারণেই আমার ক্যারিয়ারের একমাত্র ভালোবাসা হয়ে আছে আমার প্রদেশ, ল্যাঙ্কাশায়ার।”
যে ইংল্যান্ডের হয়ে ৭৯টি টেস্ট আর ১৪১টি একদিনের আন্তর্জাতিক খেলেছেন সেই দলটার প্রতিও তাঁর সেভাবে কোনদিন অনুরাগ তৈরি হয় নি বলে মন্তব্য ২০০৫ সালের অ্যাশেজ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ইংলিশ অলরাউন্ডারের, “মনে করেন ইংল্যান্ডের সাথে জিম্বাবুয়ের খেলা চলছে। আমার বয়স ২১। আমি যখন ব্যাট করতে নামছি ততক্ষণে ইংল্যান্ডের স্কোরবোর্ডে ৪০০ রান হয়ে গেছে। নিজেকে আমি তখনও বোঝাবো কিছু করে দেখাতে। কিন্তু জানি ভিতর থেকে কিছু একটা বলে বসবে, ‘বাদ দাও, কোন মানে হয় না’। ব্যাপারগুলো চাকরির মতো লাগে। আমার সাথে ঠিক যায় না।”
৩৭ বছর বয়সী ইংলিশম্যান নিজস্ব দর্শন বর্ণনা করছেন দার্শনিকের ভাষাতেই, “উচ্চাশা ব্যাপারটা হাস্যকর। অন্য অনেক পেশার মতো ক্রিকেটেও এটা আপনাকে অনেক দূর নিয়ে যেতে চাইবে। ওটা ভালো, হয়তো অনিবার্যও। কিন্তু কেউ আপনাকে কোনদিন বলবে না যে সাফল্যের দিনগুলোই আপনার জীবনের সেরা দিন নয় আর সবচেয়ে দামী পুরস্কারটাকেই আপনি সারা জীবন মনে রাখবেন না।”
ব্যাখ্যা করে বোঝাতে নিজেকেই উদাহরণ টানলেন ফ্লিনটফ, “ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে আমি কিছু মেডেল জিতেছিলাম, একটা ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি আর কিছু সানডে লিগও। কিন্তু আমি খুব করে চেয়েছিলাম কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপটাই জিততে। এখনও তাই চাই...লর্ডসে আরও একটাবার ওদের নিয়ে জয়োৎসব করতে। ওগুলোই আমার জীবনের সেরা সময়। স্মৃতিকাতরতা নয়, এটাই সত্যি।”