• আইসিসি বিশ্বকাপ ২০১৫
  • " />

     

    বিশ্বকাপের সেরা ম্যাচ?

    বিশ্বকাপের সেরা ম্যাচ?    

    বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের সবচে প্রতীক্ষিত ম্যাচ নিয়ে নিজের ভাবনাটুকু লিখেছেন শেখ মিনহাজ হোসেন।

     

    বিশ্বকাপ শুরুর আগে লিখেছিলাম বিশ্বকাপ জয়ে অধিনায়কদের ভূমিকা নিয়ে। ম্যাককালাম, ক্লার্ক দেখাচ্ছেন একজন অধিনায়ক কিভাবে দলের মানসিকতাই অন্যরকম করে দিতে পারে!

     

    সাউদি, বোল্ট, মিলনে, ভেট্টোরীকে নিয়ে নিউজিল্যান্ডের অসাধারণ বোলিং আক্রমণ তো আছেই, কিন্তু সেটাকে ম্যাক যেভাবে ব্যবহার করছে সেটাই সবচেয়ে বিস্মতকর। ইংল্যান্ডের সাথে ম্যাচটার কথাই ধরুন; ২৫ ওভার পর্যন্ত ইংল্যান্ডের রান ছিল ১০২/৩। সেই ওভারে ভেট্টোরী মরগানকে ফেরালেন। আগের ওভার কোরি অ্যান্ডারসন করেছিলো। ম্যাক একটা উইকেট পড়তে দেখেই সাউদিকে নিয়ে আসলেন অ্যাটাকে! বাকিটুকু ইতিহাস! হঠাৎ একটা উইকেট পড়েছে দেখে ইনিংসের ২৬ নাম্বার ওভারে দলের ওপেনিং বোলারকে হঠাৎ করে আর কোন অধিনায়ক বোলিং-এ নিয়ে আসবে?  ১০৪/৪ উইকেট থেকে সাউদি তাণ্ডবে ইংল্যান্ড ১২৩ রানে অল আউট!

     

    আজ অসিদের শুরুটা কিন্তু হয়েছিলো দুর্দান্ত। প্রথম ৬ ওভারে  ৫১ রান। ম্যাক ভেট্টোরীকে নিয়ে আসলেন খুব তাড়াতাড়ি। ভেট্টোরীর টাইট বোলিংয়ে অস্ট্রেলিয়ার রানের গতি কমলো। এই চাপ থেকেই ভেট্টোরীর বলে ওয়াটসনের বিদায়। এই বিশ্বকাপের সেরা স্পিনার এখনও ভেট্টোরীই! অন্যদের মতো প্রচার পাচ্ছেন না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আসল ব্রেক থ্রুটা তিনিই এনে দেন। চশমাচোখী ছোটবেলার নায়ক, ক্রিকেটের হ্যারি পটারকে বিশ্বকাপ শেষে খুব মিস করব!

     

    মাত্রই ২ উইকেট পড়েছে। কিন্তু ম্যাককালাম আবার স্লিপ, গালি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো অস্ট্রেলিয়ার উপরে। ৮০/২ উইকেট থেকে মুহূর্তেই ১০৬/৯। শেষে হ্যাডিনের হার না মানা মানসিকতায় অস্ট্রেলিয়া ১৫১ পর্যন্ত গেলো। এখানে ম্যাকের মানসিকতাটাও দেখার মতো। ইংল্যান্ডের সাথেও, আবার আজকেও। ম্যাক কিন্তু বোল্ট, সাউদি, ভেট্টোরীকে দিয়ে পুরো ১০ ওভার করে শেষ করে দিয়েছে যখন দেখেছে যে উইকেট পড়ছে। কতটুকু আগ্রাসী মনোভাব থাকলে কোন অধিনায়ক এমনটা ভাবতে পারে? আমি হলফ করে বলতে পারি, এই বিশ্বকাপে আর যেকোন অধিনায়ক এদের সর্বোচ্চ ৬-৭ ওভারের স্পেল করিয়ে অন্য বোলারের হাতে বল দিতো। পাওয়ার প্লে তো করাতে হবে এই চিন্তায়। ম্যাক সেই চিন্তাই করে না। বোলারের উপর কী আশ্চর্য আত্মবিশ্বাস!

     

    ম্যাককালাম ইংল্যান্ডের সাথে যা করেছিলো আজকেও তা-ই করতে নামলো যেন। টানা দুই বলে ছয়, চার খেয়ে জনসন শর্ট লেগে ম্যাক্সিকে দাঁড়া করিয়ে হাত বরাবর বাউন্স দিলেন। ম্যাকের হাত ফুললো, কিন্তু আগ্রাসন বন্ধ হলো না। আক্রমণ করে শুরুতেই প্রতিপক্ষের বোলিংয়ের মনোবল ভেঙে দেবার চেষ্টা তার ছিল।

     

     

    কিন্তু এতো ইংল্যান্ড না, এ অস্ট্রেলিয়া। হারার আগে হার মানার মানসিকতা এদের নেই। ২৫ বলে ৫০ করে ম্যাক আউট হবার পরে ক্লার্ক তার খেল দেখাতে এলেন। সাথে পেলেন স্টার্ককে। ৭৯ রানে ৪ উইকেট পড়ার পরে যখন উইকেট পড়ছে না, তখন জুয়াটা খেললেন ম্যাক্সিকে দিয়ে। ফলাফল ১৩১/৫, অ্যান্ডারসন আউট। ওই এক ওভারই। আবার স্টার্ক জাদু। হঠাৎ হঠাৎ বাউন্স আর টানা ইয়র্কারে নিউ জিল্যান্ড দাঁড়ালো ১৪৬/৯ এ। মাইকেল ক্লার্ক আর মিচেল স্টার্ক চেপে ধরেছিলেন থিংকিং ক্রিকেটের চূড়ান্তটা দিয়ে। দেখাচ্ছিলেন ক্রিকেট কেন পৃথিবীর সবচেয়ে গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা।

     

     

    কিন্তু পারলেন না কেন উইলিয়ামসন নামের পৃথিবীর সবচেয়ে আন্ডাররেটেড শ্রেষ্ঠ তরুণ ব্যাটসম্যানের কাছে। হাতে মাত্র ১ উইকেট নিয়ে স্টাম্প ছেড়ে ছক্কা মারতে সাহস লাগে, টেম্পারামেন্ট লাগে!

     

     

    তর্কাতীতভাবেই নিউজিল্যান্ড ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান মার্টিন ক্রো আজ মাঠে এসেছিলেন ম্যাচ দেখতে। পেয়েছেন আইসিসির "হল অফ ফেম" এ ঢুকবার স্বীকৃতি। ক্রোকে সরিয়ে উইলিয়ামসন নিউজিল্যান্ড ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান হবেন, এমনটা সবাই ধরে নিয়েছেন। পূর্বসূরীর সামনেই যেন উত্তরসূরী তার পরীক্ষা দিলেন। নিউজিল্যান্ড জিতলো চ্যাপেল-হ্যাডলি ট্রফি।

     

     

    এবার নিউজিল্যান্ডের দুর্বলতা নিয়ে কথা বলি। বোলারদের দুর্দান্ত সাফল্যে আলোচনায় আসছে না।শুরুতে ম্যাককালামের ধ্বংসলীলা বাদ দিলে কিন্তু কিউই মিডল অর্ডার ভেঙে পড়ছে বারেবার! স্কটল্যান্ডের সাথে মাত্র ১৪২ তাড়া করতে গিয়ে ৭ উইকেট পড়ে গিয়েছিলো। আজ অস্ট্রেলিয়ার সাথেও মিডল অর্ডার ব্যর্থ হলো। ম্যাক এমন শুরু না করলে খেলাটা হয়তো অস্ট্রেলিয়াই জিততো! তবে কিউইদের ভরসা হতে পারে সবার অফ ফর্ম একসাথে বেশিদিন টেকে না। আজকের নখ কামড়ানো প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা দরকার ছিল। সবসময় একপেশে থাকলে কিউইরা আসল ম্যাচে গিয়ে হয়তো ভেঙে পড়তো!

     

    অসিদের আজ ব্যাটিংটা ঠিক হয়নি, কিউইদের দুর্দমনীয় বোলিংয়ের কারণে। অস্ট্রেলিয়া এমনভাবে হুড়মুড় করে প্রতি ম্যাচে ভেঙে পড়বে এমন আশা না করাই ভালো। তবে ওয়াটসনের পরিবর্তে বেইলিকে মূল একাদশে নেয়াই যায়।

     

    সবমিলিয়ে ক্রিকেট তার সব সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয়েছিলো আজকের ম্যাচে। দুই পক্ষের থেকেই দুর্দান্ত, সৃষ্টিশীল আক্রমণাত্মক অধিনায়কত্ব, সাথে অসাধারণ বোলিং আর চাপের মুখে হার না মানার অসাধারণ মানসিকতা। কে বলে ওয়ানডে শুধু ব্যাটসম্যানদের খেলা?  বোলিং করতে জানলে খেলাটা যেকোন দিনেই শ্রেষ্ঠতম হতে পারে। বিশ্বকাপের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত ম্যাচটি টুর্নামেন্টের মানটা উঁচু করে দিলো। বাকিদের জন্য এখন এটাকে সমান করবার পরীক্ষা।