বিপিএল কেলেঙ্কারি নিয়ে মুখ খুললেন পন্ট
ইয়ান পন্ট, বাংলাদেশী ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে নামটা অপরিচিত ঠেকার কোন কারণ নেই। বছরখানেক বাংলাদেশ জাতীয় দলের বোলিং কোচের দায়িত্ব পালনের পর দুই মৌসুমে ছিলেন বিপিএলের দল ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের প্রধান কোচ। ২০১৩ সালে টুর্নামেন্টটির দ্বিতীয় সংস্করণেই ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ ওঠে তাঁর দলের বিপক্ষে। জুয়াড়িদের ধরিয়ে দিতে জীবন আর ক্যারিয়ারের ঝুঁকি নিয়েই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন আইসিসির দুর্নীতি দমন কমিশন আকসু’র প্রতি। মূলত তাঁর দেয়া তথ্যের সূত্র ধরেই ম্যাচ পাতানোর বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
কিন্তু দিন শেষে বেশীরভাগ অপরাধীই থেকে গেলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে, মাঝ থেকে ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়লো ইয়ান পন্টের। দীর্ঘদিন চুপ থেকেও এর কোন প্রতিকার পাওয়া দূরে থাক, একের পর এক লোভনীয় চাকুরির প্রস্তাব যখন এসে এসে ফিরে যাচ্ছে ‘অজানা’ কারণে, ৫৩ বছর বয়সী এই পেশাদার কোচ বাধ্য হয়েই মুখ খুলেছেন ক্রিকইনফোর কাছে। অনলাইন গণমাধ্যমটির সাথে তাঁর সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশে চলুন জানা যাক ২০১৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঠিক কিভাবে সংঘটিত হয়েছিল ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরস আর চিটাগং কিংসের মধ্যকার ম্যাচ পাতানোর কেলেংকারি।
পন্টের ভাষ্যমতে, শুরুটা হয়েছিল ২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের অন্যতম কর্ণধার শিহাব জিসান চৌধুরী আরেকজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি পন্টের হোটেল কক্ষে যান। সে পর্যন্ত খেলা ছয় ম্যাচের পাঁচটি জিতে ঢাকা তখন পয়েন্ট টেবিলে সবার উপরে। জিসান পন্টকে বলেন যে পরদিন চট্টগ্রামের বিপক্ষে ম্যাচটা তাঁরা পাতাতে চান। একটি কাগজে তিনি ম্যাচের কখন, কিভাবে, কি ‘পূর্ব নির্ধারিত’ভাবে ঘটবে সেসবও লিখে আনেন। পন্টের ভাষায়, “পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে তিনি পুরো ফলটাই পাতাতে চাইছিলেন, ম্যাচের কোন অংশবিশেষ নয়।”
পন্ট আরও জানান, তাঁদের কথাবার্তায় প্রতীয়মান হচ্ছিল এই চক্রান্তে আরও অনেকেই জড়িত। তাঁরা পন্টকে জানান যে ওই ম্যাচের জন্য নিয়মিত ক্যাপ্টেন মাশরাফিকে বসিয়ে আশরাফুলকে অধিনায়কত্ব দিতে চান। ইতিপূর্বে একবার মাশরাফিকে দেয়া জনৈক জুয়াড়ির প্রস্তাবের বিষয়টি মাশরাফি সরাসরি গণমাধ্যমের কাছে বলে দেওয়ায় তাঁকে নিয়ে জিসান চৌধুরীদের ভয় ছিল। এছাড়া তাঁরা নিয়মিত আরও দু’জন বোলার ও একজন ব্যাটসম্যানকে বসিয়ে তাঁদের ‘সাহায্য করবে এমন’ তিনজন খেলোয়াড়কে ওই ম্যাচের দলে রাখার বিষয়েও পন্টকে অবহিত করেন।
ওই তিনজনের একজন ওয়াইস শাহ পরবর্তীতে তাঁকে দেয়া এমন প্রস্তাবের বিষয়ে অভিযোগ করেন এবং আরেকজন ড্যারেন স্টিভেন্স ম্যাচের আগে পন্টকে বলেন যে তিনি এসবে জড়াতে চান নি।
সব শুনে পন্টের প্রথমেই মনে হয় তাঁর বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু তাঁর স্ত্রী তাঁকে ফোনে এভাবে চলে না এসে বিষয়টি আকসু’র প্রতিনিধিকে জানিয়ে আসতে বলেন। পরদিন সকালে পন্ট একই হোটেলে অবস্থানরত আকসু কর্মকর্তা পিটার ও’শেয়ার কাছে সবিস্তারে সব খুলে বলেন। সঙ্গে এ-ও জানান যে তিনি আর এই টুর্নামেন্টে কাজ করতে ইচ্ছুক নন, বাড়ি ফিরে যেতে চান। ওই কর্মকর্তা প্রথমে তাঁর বাড়ি ফিরে যাওয়ার বিষয়টি সমর্থন করলেও পরবর্তীতে তাঁকে বলেন যে যদি তিনি (পন্ট) সত্যিই চান এই অপরাধীরা ধরা পড়ুক, তবে যেন তিনি ঢাকায় থেকেই আকসু’কে তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করে দিয়ে সাহায্য করেন।
ভদ্রলোকের কথামতো পন্ট আকসুকে একটি ফাঁদ পাততে সহায়তা করার বিষয়ে সম্মত হন। পরিকল্পনামতো পন্টের হোটেল কক্ষে একটি গোপন ক্যামেরা ও অডিও রেকর্ডার স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে পন্ট জিসান চৌধুরীকে রুমে ডেকে ম্যাচ পাতানোর পুরো পরিকল্পনাটি পুনরায় বলতে বলেন। ভদ্রলোকও তাঁর কথামতো সবিস্তারে তাঁদের পরিকল্পনা তুলে ধরেন যেখানে কোন কোন খেলোয়াড় পাতানোর অংশ হিসেবে থাকছে, তাঁরা কিভাবে কি করবে এসবও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই আলাপচারিতার পুরোটাই আকসুর গোপন ক্যামেরায় ধারণ হয়। জিসান চৌধুরীর ভাষ্যমতে ঢাকার পাঁচজন খেলোয়াড় তাঁদের পরিকল্পনার অংশ ছিলেন এবং এখানে চিটাগং কিংসের কারও কোন সম্পৃক্ততা ছিল না।
জিসান চৌধুরী কক্ষ ত্যাগ করার পরপরই পন্ট ওই ক্যামেরার রেকর্ড পিটার ও’শেয়ার হাতে তুলে দেন। পন্ট বলছিলেন, “আমি তখন বাড়ি ফিরে যাবার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলাম। একটা দলে এমন কিছু খেলোয়াড় আছে যারা ম্যাচ পাতাবে এবং কারা তাঁরা তাও আমি জানি, এসবের পর আসলে ওই দলকে কোচিং করানোর কোন মানসিকতা থাকে না।”
ওই সময় জিসান চৌধুরী পন্টকে এ পরিকল্পনায় অংশ হবার বিনিময়ে ৬ হাজার ডলার সম্মানী দেয়ার কথাও জানান। পন্ট তখন বলেন যে এই টাকা তিনি চান না, বরং তিনি তাঁর পাওনা পারিশ্রমিক ১০ হাজার ডলার পেলেই খুশী থাকবেন। মি. চৌধুরী তাঁর পারিশ্রমিকের টাকাও কয়েক দিনের মধ্যে পরিশোধের আশ্বাস দেন।
পরিকল্পনামতো পরদিনের ম্যাচে মাশরাফিকে ‘হাঁটুর সমস্যা’র অজুহাতে বসিয়ে রাখা হয়। পন্ট বলেন, “এটা ঠিক যে মাশরাফির হাঁটুর অবস্থা তখন ভালো ছিল না। কিন্তু ওইদিন ড্রেসিং রুমে গিয়ে মাশরাফিকে সেটা জানাতেই তিনি রাগে-ক্ষোভে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন। সম্ভবত তিনি আসল ঘটনা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন।”
কেমন হয়েছিল সেই পাতানো ম্যাচ? পন্টের ভাষায়, “হাস্যকর। পূর্ব নির্ধারিতভাবে কিছু অতিরিক্ত রান দেয়া হল, হাস্যকর ফুল টস বল করা হল। এরপর আমাদের ব্যাটিংটা হল রীতিমতো আতংকজনক। ওপেনিংয়ে নেমে আশরাফুল আউট হন ১৯তম ওভারে গিয়ে, মাত্র ৩৩ রান করে।” ম্যাচ শেষে করমর্দনের সময় পন্ট চিটাগংয়ের একজন খেলোয়াড়কে এও বলতে শোনেন যে, “তোমরা বিষয়টা এতো স্পষ্ট করে না বোঝালেও পারতে!”
“প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল। এমন খেলা দেখা দর্শকের জন্যও অপমানজনক। নিজেকে এর একটা অংশ ভাবতেই ভিতরটা ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছিল। কিন্তু ক্রিকেটের দীর্ঘস্থায়ী মঙ্গলের কথা ভেবে, এসব লোকের হাত থেকে ক্রিকেটকে বাঁচানোর অভিপ্রায়ে হাল ছাড়লাম না। তবে ঠিক ওই মুহূর্তে আমার সেখানে থাকতে একদমই ইচ্ছে হচ্ছিল না। ম্যাচ-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনেও যেতে অস্বীকৃতি জানিয়ে হোটেলে ফিরে যাই।”
দিন দুয়েক বাদে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের সব খেলোয়াড় ও কোচের কাছে নির্দিষ্ট অংকের অর্থসহ একটি করে খাম পৌঁছায়। নিজেরটা খুলে পন্ট দেখেন সেখানে ৬ হাজার ডলার, যেটা তাঁকে ম্যাচ পাতানোর জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল। আকসু কর্মকর্তাকে ফোনে বিষয়টি জানালে তিনি পন্টকে সেটা রেখে দিতে বলেন। পিটার ও’শেয়ার যুক্তি ছিল, যেহেতু দলের কাছে তাঁর দশ হাজার ডলার পাওনা আছে তাই ওই অংকের বেশী এক পয়সা না নেয়া পর্যন্ত তিনি কোন অন্যায় করছেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই ছয় হাজার টাকা রেখে দেয়াটাই পন্টের জন্য এবং পুরো ম্যাচের তদন্তের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
আকসুর তরফে আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ আসার পর বাংলাদেশের স্থানীয় আদালতে বিষয়টি নিয়ে মামলা হয়। সে মামলার শুনানিতে একজন বিচারক বারবার প্রশ্ন করতে থাকেন, এমন একটি পরিকল্পনা টের পেয়েও কেন আকসু ম্যাচটি বন্ধ করার উদ্যোগ নেয় নি? যেহেতু ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে তাই এর পিছনে পাতানোর যত প্রমাণই থাকুক সেসব আর গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি আদালতের রায়ের লিখিত প্রতিবেদনে এ-ও বলা হয় যে, ইয়ান পন্ট ম্যাচ পাতানোর বিনিময়ে যে অর্থ পেয়েছিলেন সেটা তিনি কেন রেখে দেন সে ব্যাপারেও তিনি কোন ‘সন্তোষজনক’ ব্যাখ্যা দিতে পারেন নি। এ কারণে তাঁর দেয়া কোন তথ্য-প্রমাণেরও কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ফলস্বরূপ, ওই ঘটনায় জড়িত অনেকের বিপক্ষেই শক্ত প্রমাণ থাকলেও ‘প্রমাণদাতার সততা প্রশ্নবিদ্ধ করে’ তাঁদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ খারিজ করে দেয়া হয়।
পন্ট বলছিলেন, “এটা তো একেবারেই ঠিক না। আমি আকসুকে জিগ্যেস করেই নিয়েছিলাম যে আমি এই টাকাটা রাখবো কিনা। আমি আমার বেতন পাই নি জেনে (যেটা আমি এখনও পুরোপুরি পাই নি) তাঁরা আমাকে সেটা রেখে দিতে বলে। এটা তো আমার পারিশ্রমিক ছিল!”
আকসু’র বিরুদ্ধে ম্যাচ বন্ধ না করার যে অভিযোগ আদালতে উঠেছিল সেটার যৌক্তিকতা নিয়েও সন্দিহান পন্ট, “গ্যালারীর সাধারণ ধারণ ক্ষমতা ছাপিয়ে মাঠে প্রায় ৪৭ হাজারের মতো দর্শক উপস্থিত ছিল। এমন একটা ম্যাচ বন্ধ করার উদ্যোগ সেখানে নিশ্চিতভাবেই দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিত।”
আদালতের রায়ে আইসিসি, বিসিবি কোনপক্ষই যে সন্তুষ্ট হয়নি তা আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করেই জানানো হয়েছিল। উভয়পক্ষ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করার কথাও জানায়। কিন্তু সেটা কথাতেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। তবে আইসিসির প্রধান নির্বাহী ডেভ রিচার্ডসন স্বয়ং ইয়ান পন্টকে লেখা চিঠিতে তাঁর ‘সততা ও সাহসিকতার’ প্রশংসা করে বলেন, “এমন আর কিছু লোক ক্রিকেটটা বদলে দিতে পারে।”
আরও ক’জন ইয়ান পন্ট ক্রিকেটটাকে ইতিবাচকভাবে বদলাতে পারবেন কিনা সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। কিন্তু পন্ট ভদ্রলোক নিজের চোখে দেখছেন তাঁর ক্যারিয়ারের নেতিবাচক পরিবর্তন। ঘটনার ধারাবাহিকতায় ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের চাকুরি খুইয়েছেন। সেটা যে তিনি হারাবেন তা ভালো করেই জানতেন। কিন্তু জুয়াড়িদের ধরিয়ে দিতে গিয়ে যে নিজেকেই সে অপবাদ মাথায় নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে সেটা কিভাবে মেনে নেবেন! ভারতে একটি লোভনীয় চাকুরির প্রস্তাব এসেও ফিরে গেছে অজানা কারণে। ইংল্যান্ড দলে তাঁর ফিল্ডিং কোচ হয়ে যাওয়ার বিষয়টিও ঝুলে গেছে। কেন এমন হচ্ছে তা পন্ট ভালো করেই বোঝেন, “লোকে যদি ভাবে আমি খারাপ কোচ, আমার টেকনিক কোন কাজের না...তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু যখন আমার সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়, সেটা নিয়ে নীরবে বেঁচে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থার তরফে ভূয়সী প্রশংসা শ্রুতিমধুর হতে পারে। কিন্তু সেটা যখন প্রশংসিত ব্যক্তির ক্যারিয়ারের নিশ্চয়তাটুকুই দিতে পারে না তখন সে প্রশংসার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক বৈকি! পন্টের ভাষায় ‘ভুল ও বিভ্রান্তিকর’ তথ্যের উপর ভিত্তি করে যেসব কটূক্তি তাঁকে শুনতে হচ্ছে, তাঁর ক্যারিয়ারের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে...এসবের প্রতিকার তিনি আদৌ কোনদিন পাবেন কি?
ছবিঃ ক্রিকইনফো