শিব-শ্রমিকের গান
দূর থেকে দেখা যায় একটা স্থাপনার ভগ্নাবশেষ। অথবা ধ্বংসাবশেষ হয়তো। যেন বহন করে হারানো জৌলুসের স্মৃতিচিহ্ন। কাছে গেলে একটা অদ্ভূত অনুভূতি হয়, কী সগৌরবে একদিন দাঁড়িয়ে ছিল এ স্থাপনা! এটি হয়তো বিখ্যাত এর নকশার জন্য। কোন বিখ্যাত শিল্পীর কর্ম যে তা। শিল্পীরই কর্ম বটে। যে শ্রমিক গড়ে তুলেছিলেন তিলে তিলে, তাঁকে বা তাঁদেরকে স্মরণ করা হয়না খুব একটা। ধারণ করা হয় কি?
****
রিচার্ড জোডাহ জর্জটাউন ক্রিকেট ক্লাবের সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠছেন। রোহান কানহাইয়ের সঙ্গে ক্লাব অধিনায়কের দেখা সেখানেই। কানহাই তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ম্যানেজার। শিবনারাইন চন্দরপলের দেখা পেতে চান তিনি। সেদিনই। শিব তখন জর্জটাউন থেকে বেশ দূরে, গায়ানার পূর্বাঞ্চলে, মাহাইকার গ্রাম ইউনিটিতে। সময়টা মার্চের মাঝামাঝি, ১৯৯৪ সাল। ইংল্যান্ডের সঙ্গে দু'দিন পরেই দ্বিতীয় টেস্ট ওয়েস্ট ইন্ডিজের।
রিচার্ড তখন গাড়ি চালাননা। বন্ধু মার্কের দেখা পেলেন, তাঁর বাবার একটা গাড়ি ছিল। রিচার্ড বললেন তাঁকে। যেতে হবে মাহাইকা। চন্দ্রকে (শিবনারাইন চন্দরপল) নিতে। কিন্তু কেন! প্রশ্নটা মার্ক করলেন কানহাইয়ের সামনেই। কানহাই বললেন, ‘তাঁকে দ্বিতীয় টেস্টের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে নেওয়া হয়েছে। তবে এ বিষয়ে চুপ থাকতে হবে এখন’।
‘অবশেষে অপেক্ষা ফুরোলো, সেই মাহেন্দ্রক্ষণের!’, রিচার্ড দেরী করলেন না তাই। বন্ধু মার্ককে নিয়ে ছুটলেন, গন্তব্য ইউনিটি। উদ্দেশ্য চন্দ্রকে আনা।
রাস্তায় কোন একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে সেদিন আবার। বেশ কিছুক্ষণ আটকে থাকতে হলো দুই বন্ধুকে। অপেক্ষার সঙ্গে বাড়ছিল দুশ্চিন্তাও। অবশেষে যখন শিবের বাড়িতে পৌঁছুলেন, তখন সূর্য ডুবি ডুবি করছে। এবং শিব বাড়িতে নেই। খেলতে গেছেন, সৈকতে।
লোক পাঠানো হলো। শিব এলেন। খোঁড়াতে খোঁড়াতে। পায়ে কাঁটাজাতীয় কিছু একটা ফুটেছে। রিচার্ড তাড়া দিলেন, বেড়ুতে হবে যে! যেতে হবে জর্জটাউন। শিব ভাবলেন, বোধহয় মজা করছেন রিচার্ড। ঘটনা খুলে বলতেই অবিশ্বাস যেন ঠিকরে পড়ছিল চোখ মুখ থেকে! অবশেষে ‘চন্দ্র’কে নিয়ে রিচার্ড পৌঁছুলেন, পেগাসাস হোটেলে। কানহাইয়ের রুমে নিয়ে গেলেন। উত্তেজনায় কাঁপছেন তখন দুজনই! শিবনারাইন চন্দরপল আর ভাইতুল্য তার ক্লাব অধিনায়ক রিচার্ড জোডাহ!
ইউনিটির সৈকত থেকে গায়ানার রাজধানী জর্জটাউনের বোর্দা স্টেডিয়ামে উঠে এলেন শিব। প্রথমবারের মতো নয়, তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মেরুন রঙ গায়ে মাখলেন সেই প্রথমবার। খেমরাজের সেই শীর্ণ, ছোট্ট ছেলেটা। সেই ক্রিকেটপাগল ছেলেটা। যে ক্রিকেটের জন্য স্কুল ছেড়েছিল ১৩ বছর বয়সে।
যার একসময় ব্যাটের হ্যান্ডেল ছিল বাঁশ দিয়ে তৈরী, প্যাড বানানো হতো কাপড় সেলাই করে। চেস্ট গার্ড হিসেবে যে ছেলেটা একসময় বুকের কাছে বেঁধে নিত বালিশ। ছোট্ট এক চিলতে কংক্রিটের ওপর পানি ছিটানো হতো। বাবা খেমরাজ ক্রিকেট বলের শক্ত অংশ ‘কর্ক’ ছুড়ে দিতেন শিবের দিকে। শিব ঠেকাতেন, ছেড়ে দিতেন, প্রতি-আক্রমণ করতেন। আর আদিগন্ত সৈকতে ক্রিকেট খেলে বেড়াতেন। সেই ছেলেটাই। ১৯৯৪ সালের মার্চ মাসের ১৭ তারিখ নামলো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। পায়ে কিন্তু তখনো সেই কাঁটার আঘাত! বয়েই গেছে তাতে!
ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখনও বিশ্বের এক নম্বর দল। ওপেনার ডেসমন্ড হেইন্সের সেটি ১১৩তম টেস্ট, রিচি রিচার্ডসনের ৭৪তম। বোলিংয়ে কার্টলি অ্যামব্রোস ও কোর্টনি ওয়ালস। মিডল অর্ডারে ব্রায়ান লারা, যিনি কদিন পরেই গ্যারি সোবার্সের সর্বোচ্চ রানের ইনিংসের রেকর্ড ভেংগেছিলেন। আর ছিলেন জিমি অ্যাডামস, ক্যারিয়ারের উষালগ্নে। ৬ টেস্টে জিমির গড় তখন ৯৪! দুনিয়াকাঁপানো ওয়েস্ট ইন্ডিজের তখনও একটি প্রজন্ম টিকে ছিল; হেইন্স, লারাদের ওপর ভর করে।
সেই দলেই এলেন গায়ানার ১৯ বছরের এক তরুণ। টেস্টের শার্ট তখন শিবের ঢিলেঢালা, হেলমেট এই বুঝি খুলে পড়বে! স্টান্স তখনও এতো ‘সম্মুখমুখী’ ছিল না। তবে ব্যাট ধরার সময় এতো হেলে থাকতেন যে, পিঠ প্রায় সমান্তরাল থাকতো ভূমির সঙ্গে! একটা করে বাউন্ডারি মারেন, আর গায়ানিজরা চিৎকার করে ওঠেন। ফিফটি করার পর তো মাঠেই ঢুকে পড়লেন কিছু দর্শক। যখন আউট হলেন ৬২ রান করে, জর্জটাউনে যেন তখন নেমে এলো ক্ষণিকের নিস্তব্ধতা! লেগস্পিনে ১৬ ওভার বোলিংও করেছিলেন প্রথম ইনিংসে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সে ম্যাচ জিতেছিল ইনিংস ব্যবধানে। ১৬৭ রান করে ব্রায়ান লারা হয়েছিলেন ম্যান অব দ্যা ম্যাচ। সেই ব্রায়ান লারাকেই ক্যারিবীয় ক্রিকেটের সমার্থক ভাবা হয়েছে কতোদিন! অথচ একজন চন্দরপল ছিলেন সবসময়। সেই জর্জটাউন টেস্টে, যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বের এক নম্বর দল। এই শেষ ব্রিজটাউন টেস্টেও, যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্যালিপসো সুরে ছেদ পড়েছে বহুদিন আগে, রূপকথা হয়ে গেছে বিশ্বজয়ী সব ইতিহাস।
প্রায় ২১ বছর আগের সেই ১৭ মার্চের পর চন্দরপল প্রায় শ'খানেক ক্রিকেটারের সঙ্গে টেস্ট খেলেছেন। হেইন্স চলে গেছেন, রিচার্ডসন চলে গেছেন। ওয়ালশ নেই, অ্যামব্রোস এখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং কোচ। গিয়েছেন জিমি অ্যাডামসও। পরবর্তী প্রজন্মের ক্রিস গেইল বা রামনরেশ সারওয়ানও যাওয়া আসা করে এখন হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। কিন্তু ছিলেন একজন চন্দরপল। সেই অদ্ভূত স্ট্যান্সে, স্ট্যাম্পের বেল দিয়ে গার্ড নেওয়ার সময়। সেঞ্চুরির পর পিচে চুমু খাওয়ার সময়। অসাধারণ টাইমিংয়ে, তিলে তিলে গড়ে তোলা একেকটা ইনিংসে। চন্দরপল ছিলেন। চন্দরপল তাই সবচেয়ে বেশী বল ধরে অপরাজিত থাকার রেকর্ড গড়েছেন (১০৫১ বল, ২০০২ সালে ভারতের বিপক্ষে)।
চন্দরপলের টেস্ট গড় (৫১.৩৭) তাই স্ট্রাইক রেটের (৪৩.৩১) চেয়ে বেশী। মুগ্ধ নয়নে হয়তো পুরো ইনিংস দেখা যায় না, তবে যখন স্ট্রোক খেলেন, তাকিয়ে থাকতে হয়। আলতো করে, শুধু টাইমিং। অফস্ট্যাম্পের বাইরের বলকে তিনি নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় ছেড়ে দেন। ফুল লেংথের বলকে বুঝে ফেলেন কতো আগেই, একটু এগিয়ে যান, ফ্লিক করেন। শর্ট বলকে ডাক করেন তাচ্ছিল্যভরে। কখনওবা পুল করার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন।
চন্দরপলের ইনিংস এমনই। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। ধৈর্যের চরমতম পরীক্ষা দিতে এবং নিতে বসেছেন যেন!
তবে চন্দরপল ‘মিরাকল’ ঘটাতেও পারতেন। ৬৯ বলে টেস্ট সেঞ্চুরি করে। তখনকার প্রবল প্রতিক্রমশালী অস্ট্রেলিয়ার সাথে, জর্জটাউনে, ২০০৩ সালে।
ব্রেট লির এক বাউন্সারে একবার ভূপাতিত হয়েছিলেন। মনে হচ্ছিল অচেতন হয়ে গেছেন, কিংবা আরও আশঙ্কা, মারা-টারাই গেলেন নাকি! চন্দরপল উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, গা ঘেঁষে লেগস্ট্যাম্প দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া পরের বলটাই ছেড়ে দিয়ে যেন বলেছিলেন, ‘আমি আছি!’ চন্দরপল সে ম্যাচেও সেঞ্চুরি করেছিলেন।
চন্দরপল সবচেয়ে বড় মিরাকলটা ঘটিয়েছিলেন ত্রিনিদাদে। ২০০৮ সালে, তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে। চামিন্দা ভাসের শেষ দুই বলে লাগতো ১০ রান। শেষ উইকেট। পঞ্চম বলটা লং অনে ‘ঠেলে দিয়ে’ চার। শেষ বলটা ছিল লো ফুলটস, মিডউইকেট দিয়ে ছয়! মিরাকল!
সবসময় মিরাকল ঘটে না। চন্দরপলের অধিনায়কত্বও তাই। ১৪ টেস্টে ১ জয়, ৩ ড্র। ১৬ ওয়ানডেতে ২টি মাত্র জয়। চন্দরপলের তা নিয়ে আক্ষেপ নেই। তিনি নিভৃতচারী। অধিনায়ক হলে অনেক খোলামেলা হতে হয়। চন্দরপল তা নন। অনেকেই বলেন, চন্দরপল দলের জন্য নয়, খেলেন নিজের জন্য। সবচেয়ে বেশীবার রানআউটে অংশ থাকা ব্যাটসম্যান তিনি (২৫ বার, এর মধ্যে চন্দরপলের ব্যাটিং-সঙ্গী আউট হয়েছিলেন ২১ বার)।
চন্দরপল অধিনায়কত্ব পারেননি। চন্দরপল এতবার রানআউট করা থেকে বিরত রাখতে পারেননি। চন্দরপল ওয়েস্ট ইন্ডিজের সুদিন ফিরিয়ে আনতে পারেননি।
চন্দরপল তাহলে কী পেরেছেন? ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে সবচেয়ে বেশী টেস্ট খেলেছেন (১৬৪টি)। ‘লং সার্ভেন্ট’ কথাটা তার সঙ্গেই যায় খুব করে। ব্রায়ান লারার পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে সবচেয়ে বেশী সেঞ্চুরি তাঁর (৩০টি)। ৩৫ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কমপক্ষে ২৫০০ রান করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে চন্দরপলের গড়ই সবচেয়ে বেশী, ৫৭.৭৩। ৩০ রানের ভেতরেই দলের তিন বা এর বেশী উইকেট পড়ে যাওয়ার পরও কোনো ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ রানের তালিকায় চন্দরপল ওপরে সবার। এমন ২৩ ইনিংসে ১৫০২ রান করেছেন তিনি। চন্দরপল ত্রাতা হিসেবে ছিলেন। দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়নি বেশীরভাগ সময়েই, তবে লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।
১৬৪ ম্যাচে জয়ের স্বাদ পেয়েছেন মাত্র ৩৯ বার। ক্যারিয়ার গড় ৫১ থেকে বেড়ে ৬৬ হয়ে গেছে এ ম্যাচগুলোতে। পরাজয় মেনে নেওয়া ব্যাটসম্যানদের মধ্যেও সবচেয়ে বেশী রান তাঁর। আর মাত্র ৮৭ রান হলেই তিনি ব্রায়ান লারাকে টপকে টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে সবচেয়ে বেশী রানের মালিক হবেন বা হতেন।
সে সুযোগ হয়তো শিব পাবেন না। শেষ ১১ ইনিংসে ১৬.৬৩ গড়ে ১৮৩ রান হয়তো বেলাশেষের সুরই ধরেছে। সামনের আগস্টে ৪১ পূর্ণ করবেন। ছেলে তেজনারাইনের সঙ্গে একই টেস্টে নামাও এখন সুদূরের কল্পনা। শিবনারাইন চন্দরপলের দিন যে ফুরিয়ে এসেছে বলে মনে করছেন নির্বাচকরা!
****
দিন ফুরিয়ে আসবেই। একটা স্থাপনাও টিকে থাকেনা যেমন অনন্তকাল। স্থায়িত্ব শেষ হয়, প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসে। সংস্কারে চেহারা বদলে যায়। তবু কিছু স্মৃতিচিহ্ন রয়ে যায়। আর নকশাকারীদের স্মরণ করা হয়। ক্যারিবীয় ক্রিকেটের স্থাপনায় ব্রায়ান লারা, ভিভ রিচার্ডস, গ্যারি সোবার্সরা একেকজন শিল্পী। ক্যারিবীয় ক্রিকেটের কথা বললেই তাই তাঁদের নাম আসে। সেখানে শিবনারাইন চন্দরপলের অবদান হয়তো অসংখ্য ইট-সুড়কির গাঁথুনি। ধ্বংসাবশেষে যা নজরে আসে না তেমন। সংস্কারে যা চাপা পড়ে।
রিচার্ডস তাই ‘রাজা’ হন। লারা হয়ে ওঠেন ‘রাজপুত্র’। শিবনারাইন কী হতে চান বা চেয়েছিলেন, জানা যায়না।
আজ হতে অনেকদিন পর ক্যারিবীয় সমুদ্রাঞ্চলে যদি ক্রিকেট নিয়ে কথা হয়, হয়তো আসবে লারা-রিচার্ড-সোবার্সদেরই নাম। তবে নির্জনবেলায়, অসীম নিস্তব্ধতায় ক্যারিবীয় সমুদ্রাঞ্চলে কান পাতলে হয়তো ভেসে আসবে এক অস্পষ্ট সুর। হয়তো ক্যালিপসোই। একটু ভিন্নধারার।
আরেকটু মনোযোগ দিলে শোনা যাবে, হয়তো তা ছিল কোনো এক ক্যারিবীয় ‘শ্রমিকের’ জয়গান।
আরও পড়ুনঃ