নায়ক, খলনায়ক
ফিক্সিং এর ইতিহাস খুব নতুন নয়। তবে প্রথম যে ফিক্সিং-ঝড় টালমাটাল করে দিয়েছিল পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে, সেই ঘটনার জন্মদাতা ছিলেন একজন দক্ষিণ আফ্রিকান। জ্যাক ক্যালিস, মার্ক বাউচার যাঁকে এখনো নেতা মনে করেন; বন্ধু জন্টি রোডস যাঁকে মিস করেন প্রতিনিয়ত। শন পোলক চেনেন সামনে থেকে লড়াই করা একজন হিসেবে। আর গ্যারি কার্স্টেনের মতে, তিনি ‘বিশাল মাপের এক ক্রিকেটার আর পারফর্মার’। যে দক্ষিণ আফ্রিকানরা মনে করে তাদের ক্রিকেটীয় ভাবমূর্তিকে তিনি চুরি করেছেন, সেই তারাই আবার সেরা দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যক্তিত্বদের তালিকায় তাঁকে ১১ নম্বরে স্থান দেন। যাঁকে নিয়ে তৈরী হয়েছে সিনেমা। আজকের এই দিনে সবকিছু ছেড়ে ওপারে চলে গিয়েছিলেন এই 'ঝরে পড়া তারকা'।
হ্যান্সি ক্রনিয়ে - ক্রিকেটের এই ট্র্যাজিক হিরোকে স্বল্প পরিসরে জানার চেষ্টা করে হয়েছে...
*****
দক্ষিণ আফ্রিকার ফ্রি স্টেট প্রভিন্সের রাজধানী ব্লুমফন্টেইন। ব্লুমফন্টেইনেরই এক মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, ধার্মিক, ক্রিকেট পরিবারে জন্ম ছেলেটার। দেশের তৃতীয় প্রাচীন কলেজের নাম গ্রে কলেজ। সেই কলেজেরই এককালের হেড বয়- হ্যান্সি ক্রনিয়ে। স্কুল পর্যায়ে খেলতেন রাগবী আর ক্রিকেট। প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন নিজ প্রদেশের হয়ে।
ফ্রি স্টেট ক্রিকেট দলের (তৎকালীন অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট) হয়েই প্রথম শ্রেণীতে অভিষেক, ১৮ বছর বয়সে। ভাই ফ্র্যান্স যে দলে আগেই খেলতেন, বাবা এউই খেলেছিলেন ষাটের দশকে।
২১ বছর বয়সে সে দলেরই অধিনায়ক হয়ে গেলেন। স্কুলেই গড়ে ওঠা শিক্ষা, পরিশ্রম, নিয়মানুবর্তিতা নামক গুণগুলো সাহায্য করেছিল বড্ড! এডি বার্লো তখন সে দলের কোচ। ক্রনিয়ে অরেঞ্জ ফ্রি স্টেটকে সেবার ‘কুরি কাপ’ এ রানার্স-আপ বানিয়েছিলেন, জিতিয়েছিলেন সীমিত ওভারের টুর্নামেন্টেও।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে তখন ‘সাংস্কৃতিক বয়কট’ চলছে। ক্রিকেট থেকেও ‘নির্বাসিত’ তখন ক্রনিয়ের দেশ। ১৯৯১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা ফিরে পেল আইসিসির সদস্যপদ। ‘নতুন’ আফ্রিকার প্রথম টেস্টেই অভিষেক হয়ে গেল ক্রনিয়ের, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে। পরের বছর বিশ্বকাপের দলেও ডাক পেলেন। সাক্ষী হন ১ বলে ২২ রানের সেই অভাবনীয় ট্র্যাজেডির। ১৯৯৪-৯৫ সেশনে অস্ট্রেলিয়া সফরের সিডনি টেস্টের আগে অধিনায়ক কেপলার ওয়েসেলসের চোট অধিনায়কত্বের ভার এনে ফেলে সহ-অধিনায়ক ক্রনিয়ের কাঁধে।
পূর্ণ মেয়াদে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পান সে বছরেরই শেষের দিকে নিউজিল্যান্ড সফরে। তাঁর মেয়াদে দক্ষিণ আফ্রিকা ৫৩ টেস্টের ২৭টিতে জিতেছিল, হেরেছিল মাত্র ১১টিতে। আর ১৩৮ ওয়ানডের ৯৯টিতেই জয়।
একটি ‘টাই’ ছিল। সাল ১৯৯৯, এজবাস্টন। মহাকাব্য। ট্র্যাজেডি। যে অভিধায় অভিসিক্ত করুন না কেন, সেই ‘টাই’ বদলে দিয়েছিল ক্রিকেট ইতিহাসের রুপরেখা। ক্রনিয়ে অংশ ছিলেন সে ম্যাচের। ট্র্যাজেডির অংশেই!
ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন, দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিশ্বকাপ জেতাবেন। ’৯২ এর ‘বৃষ্টি ট্র্যাজেডির’ পর এবার 'টাই ট্র্যাজেডি’! স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পুড়লেন আবার!
১৯৯৮ সালের বাংলাদেশের মাটিতে জেতা মিনি বিশ্বকাপই (অধুনা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি) তাই তাঁর একমাত্র বড় শিরোপা, যা আবার দক্ষিণ আফ্রিকারও এখন পর্যন্ত একমাত্র বৈশ্বিক অর্জন।
নাহ্, ক্রনিয়ের ট্র্যাজেডির শেষ নয় এতেই।
২০০০ সালে ভারত সফরে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। টেস্ট সিরিজও জেতে ২-০ তে। কিন্তু শুরু হয় এক নতুন ট্র্যাজেডির, শুরু হয় ক্রিকেট বিশ্বকেই নাড়িয়ে দেয়া এক ঘটনা।
সেবারই দিল্লি পুলিশ ফোন-কলে আড়ি পেতে বুঝতে পারে, ক্রনিয়ে ম্যাচের আগে সন্দেহজনক কাউকে ম্যাচ-সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করছেন। ক্রনিয়ে অস্বীকার করেন। দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট বোর্ড (তৎকালীন ইউসিবিএসএ) ক্রনিয়ের ‘প্রশ্নাতীত সততা আর শুদ্ধতার’ প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায়। ক্রিকেট বিশ্বও তা মেনে নেয়। ক্রনিয়ে এমন কিছু করতে পারেন না। আসলে কিন্তু পারেন। এবং করেছিলেন।
তবে ক্রনিয়ে চুপ থাকলে হয়তো চিত্রটা অন্যরকম হতো। হয়নি। তাঁর সেই ‘ধার্মিক’ সত্ত্বাটা জেগে উঠেছিল। হাতে ‘ডব্লিউ ডব্লিউ জে ডি (হোয়াট উড জিসাস ডু)’ আক্ষরিত ব্রেসলেট পড়া ক্রনিয়ে, ৪ দিন বাদে রাত ৩টার সময় ফোন করেন ইউসিবিএসএ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালককে। স্বীকার করেন- তাঁরা যেমন ভাবেন, ক্রিকেট বিশ্ব যতটা ভেবে শ্রদ্ধা করে, ক্রনিয়ে নামক মানুষটা ঠিক ততটা ‘সৎ’ নন!
বেরিয়ে আসে ‘থলের বাঘ’। বিড়াল নয়।
ভারত সফরের ১ম টেস্টে পিটার স্ট্রাইডমকে দিয়ে কথামত পারফরম্যান্স করিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ২য় টেস্টের আগে ক্যালিস, ক্লুজনার আর বাউচারকে বলেন, তাঁরা টাকার বিনিময়ে ম্যাচ ছেড়ে দিতে চান কি-না।
ক্যালিসরা তা বিশ্বাস করেননি, নিয়েছিলেন কৌতুক হিসেবেই। তবে সেই দলে ক্যালিসরা ছাড়াও এমন কেউ ছিলেন যারা ক্রনিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন। হার্শেল গিবস আর হেনরী উইলিয়ামস। সবই হয়েছিল এক ভারতীয় বুকির মাধ্যমে, যার সাথে ক্রনিয়েকে পরিচয় করে দিয়েছিলেন মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন, ১৯৯৬ ভারত সফরে।
এর আগে সে বছরই সেঞ্চুরিয়ন টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকা দ্বিতীয় ইনিংস ঘোষণা করেছিল শূন্য রানে, ইংল্যান্ডও ঘোষণা করেছিল ১ম ইনিংস। বৃষ্টিতে তিনদিন ভেসে যাওয়ায় ফলাফলের সম্ভাবনা ছিল শুন্য। রোমাঞ্চ আনতে ক্রনিয়ের চ্যালেঞ্জে রাজি হয়েছিলেন নাসের হুসেইন, তাঁর ইংল্যান্ড জিতেছিল ২ উইকেটে। কিন্তু ভেতরের ব্যাপার যদি জানতেন হুসেইন!
বাজিকরদের সঙ্গে ক্রনিয়ের চুক্তি ছিল, সে ম্যাচে ফলাফল আনবেনই! ক্রিকেট দেখেছিল এমন এক অদ্ভুত ‘রোমাঞ্চকর’ দুইদিনের টেস্ট ম্যাচ! আদতে যা ছিল ক্রনিয়ের ‘ধুরন্ধর’ ক্রিকেট মস্তিস্কের ‘অপব্যবহার’-র ফল!
ক্রনিয়ে বোমা ফাটালেন। অস্ট্রেলিয়া সফর থেকেও প্রত্যাহার করে নেয়া হলো তাঁকে।নবগঠিত কিং কমিশনের সামনে ক্রনিয়ে এবার বললেন তাঁর ভিতরের কথা, অজানা কথা:“এটা একটা দুর্ভাগ্যজনক নেশা,টাকার নেশা। আমি এ্যালকোহল কিংবা নিকোটিনের প্রতি আসক্ত নই, কিন্তু এ নেশাও তাদের থেকে কম নয়!”
সত্যি কি তাই নয়! টাকার নেশা। কতজনই তো মত্ত! যাক সে কথা।
কিং কমিশন এরপর সবধরনের ক্রিকেটে যে কোন ধরনের অংশগ্রহণ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে তাদের সবচেয়ে 'আলোচিত' নেতাকে। ক্রনিয়ের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল খারিজ হয়ে যায় ২০০১ সালে।
ক্রনিয়ের ক্রিকেট থেমে গেল, জীবন তো আর নয়!
এরপর একটা স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তি হন। ২০০২ সালে যোগ দেন স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত এক কোম্পানীতে, অর্থ ব্যাবস্থাপক হিসেবে,জোহানেসবার্গে। ক্রনিয়ে সপ্তাহজুড়ে থাকতেন জোহানেসবার্গেই, আর সপ্তাহের শেষে ফিরতেন জর্জে, স্ত্রী বার্থার কাছে।
তেমনই এক দিন। জুন মাসের ১ তারিখ। তুষারপাতের কারণে রাস্তায় আটকা পরে ফ্লাইট মিস করলেন। পরে এক কার্গো বিমানে দুই পাইলট বন্ধুর সাথে ভ্রমণের ব্যবস্থা হলো। পাইলট বহু বছরের অভিজ্ঞ।
জর্জ বিমানবন্দরের কাছাকাছি এসে পরিচিত আবহাওয়ায় মেঘের মাঝে পথ হারিয়ে ফেললেন সে পাইলট! ব্যর্থ হলেন সঠিকভাবে অবতরণে!
ঠিক যেমন ওয়েসেল জোহানেস 'হ্যান্সি' ক্রনিয়েও হঠাৎ জুড়ে আসা মেঘে ব্যর্থ হয়েছিলেন ক্রিকেট-জীবনের সঠিক রানওয়েতে অবতরণ করতে!
ক্রনিয়ে ক্রিকেট থেকে ফুরিয়ে গিয়েছিলেন আগেই, এবার জীবন থেকেই হারিয়ে গেলেন!
আসলেই কি ক্রনিয়েরা হারিয়ে যান?
আরও পড়ুনঃ
ক্রনিয়েকে পড়ে মনে...