ক্রনিয়েকে পড়ে মনে...
প্রিয় ক্রনিয়ে,
আপনাকে প্রিয় বলে সম্বোধন করছি। কিন্ত আপনি কি এখনো আমার প্রিয় আছেন? কি জানি! তবে মিথ্যা বলবো না, একসময় আমি আপনার বড়ো ভক্ত ছিলাম! মাঠে আপনার হাঁটাচলা, অ্যাটিচুড সবকিছুই আমার বড্ড ভালো লাগতো। '৯৯-এ এজবাস্টনের সেই মৃত্যুসম টাই ম্যাচের পরে ক্যামেরা যখন আপনার দিকে ধরলো, টিভিতে দেখলাম আপনার অশ্রুসজল চোখ। অনেক চেষ্টা করছেন কান্না চেপে রাখতে। সেও প্রায় ১৬ বছর আগের কথা। তখন কি ভাবছিলাম নিজেরও মনে নেই।
৯৯ বিশ্বকাপে আমি পড়ি ক্লাস সিক্সে। মাসুদ রানার সাথে বেড়িয়ে পড়া হয়নি তখনো। তাই তখন না বুঝলেও পরে বুঝেছিলাম '৯৯ বিশ্বকাপে আপনার আর বব উলমারের যুগলবন্দী ছিল অনেকটাই মাসুদ রানা আর রাহাত খানের কম্বিনেশন। বব উলমারের ক্ষুরধার ক্রিকেট বুদ্ধি আর মাঠে আপনার তা এক্সিকিউশন; দক্ষিণ আফ্রিকাকে করে তুলেছিলো অপ্রতিরোধ্য এক দল। মাঠে ইয়ারফোন দিয়ে কোচের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাখা নিয়ে কত কান্ডই না হলো! সেবার নাহয় ক্লুজনারের এক পাগুলে দৌড়ে লর্ডসের বারান্দায় কাপ হাতে নিতে পারলেন না। কিন্তু নিজের দেশে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ নিতে দেখার প্রস্তুতি আমি তো মনে মনে নিয়েই ফেলেছিলাম। কিন্তু তার আগেই তো স্বর্গ থেকে পতন হলো আপনার। ফিক্সিংয়ের দায়ে অভিযুক্ত হলেন আপনি।
২০০০ সালের ভারত সফরের কথা মনে আছে আপনার? ঐ যে যেবার ভারতকে তাদের মাঠেই টেস্টে ২-০ তে হারানোর পরপরই ‘থলের বিড়াল’ বেরিয়ে আসলো। আপনি নাকি ম্যাচ ফিক্সিং করেছেন। কি হাস্যকর কথা বলুন তো!! এর চেয়ে হাস্যকর কথা কে কবে শুনেছে? পরে জানা গেলো আমিই ভুল, দিল্লির পুলিশই ঠিক। এই একটা কারণে কতবার ঘৃণা করতে চেয়েছি আপনাকে। মনকে বুঝাতে চেয়েছি সব বিভ্রম; ক্রনিয়ে নামে আসলে কেউ কখনো ছিলই না। আসলে আপনি হচ্ছেন সেই প্রথম প্রেমের মতো, যাকে ঘৃণা করা যায় না। ভোলা তো অনেক পরের ব্যাপার।
আপনার শেষ ওয়ানডের কথা এখনো মনে আছে আমার। ২০০০ সালের কোকাকোলা কাপের ফাইনাল। ৩০ রানে ২ উইকেট পড়ার পরে আপনি নিজেকে ব্যাটিং অর্ডারের উপরের দিকে তুলে আনলেন। টু ডাউনে নেমে করলেন ৭৩ বলে ৭৯। দল জেতেনি কিন্তু দলের বিপদে সামনে থেকে বুক চিতিয়ে লড়েছিলেন। নেতা তো এরকমই হওয়া উচিত। তাই না?
কিসের লোভে ফিক্সিং করতে গেলেন আপনি? আর করলেনই যখন, স্বীকার করার দরকার কি ছিল? আমি না হয় ধোঁকাই খেতাম সারাজীবন। তবুও নায়কের পতন তো আর দেখতে হত না।
ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হলেন আপনি। ক্রিকেট ছাড়াই জীবন চলছিল আপনার। কিন্তু হঠাৎই এক বিমান দুর্ঘটনায় আপনি চলে গেলেন মৃত্যুর শীতল স্পর্শে। কি হয়েছিল সেদিন বলুন তো? আসলেই বিমানের যান্ত্রিক গোলযোগ? নাকি আপনাকে খুন করা হয়েছিল সেদিন?
এখনকার তরুণ দর্শকদের অধিকাংশই আপনাকে চেনে না। আর যারা চেনে তারা আপনার নাম শুনলে মুখ বাঁকিয়ে বলে, ‘ঐ ম্যাচফিক্সার’। বলুন তো, আপনার কি এইরকম বিদায় প্রাপ্য ছিল? আপনার নাম না সর্বকালের সেরা অধিনায়কের তালিকায় থাকার কথা ছিল? হ্যান্সি ক্রনিয়ের নামটা না বিশ্বকাপজয়ী প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকান অধিনায়কের নাম হওয়ার কথা ছিল?
আসলে মানুষ ভিলেনকে মনে রাখে না। মানুষ মনে রাখে নায়ককে। সেটা সিনেমা বলুন অথবা ক্রিকেট।
আজ আপনার ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনে আপনার এক ভক্ত আপনাকে স্মরণ করছে গভীর শ্রদ্ধা ভরে।
যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।
ইতি,
আপনার একজন গুনমুগ্ধ ভক্ত
যে কিনা ‘ক্রনিয়ে’র মতো একজন নেতা হতে চেয়েছিল!
আরও পড়ুনঃ
নায়ক, খলনায়ক