ভালভার্দের ওপর বার্সার ভালো-মন্দ
গতবার মৌসুম শুরুর ঠিক আগে এই সময়ে একটা অস্বস্তি ভর করেছিল বার্সেলোনায়। সংশয় উড়িয়ে দিয়ে মৌসুমটা শেষ পর্যন্ত ভালোই কেটেছিল তাদের। লা লিগা পুনুরুদ্ধার, সঙ্গে কোপা ডেল রের শিরোপাটাও হাতছাড়া না করা। বার্সার মৌসুমটাকে সফল বলা যায় অনায়াসেই। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগে তৃতীয়বারের মতো কোয়ার্টার ফাইনাল না পেরুতে পারাটা গলায় কাঁটা হয়েছিল। বিশেষ করে রিয়াল মাদ্রিদের টানা তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জয় বার্সাকে চাপেই ফেলে দিয়েছে। লিগ, কোপা ডেল রে তো আছেই, এবার তাই শুরু থেকেই চ্যাম্পিয়নস লিগে ভালো কিছু করার প্রত্যয় নিয়েই শুরু করতে হবে এর্নেস্তো ভালভার্দের দলকে। হুয়ান গ্যাম্পার ট্রফির ম্যাচের আগে নতুন অধিনায়ক লিওনেল মেসির কন্ঠেও ঝরেছে একই প্রত্যয়।
দলটাও বেশ গোছানোই। দলবদলের বাজারে ব্যস্ত সময়ই পার করছে বার্সা। ক্লেমেন্ত ল্যাংলেট, আর্থার, ম্যালকমদের দলে ভিড়িয়ে ভবিষ্যৎ গোছানোর দিকে এক পা দিয়েছে তারা। অন্যদিকে আর্তুরো ভিদালকে কিনে তারুন্যের সঙ্গে দক্ষদের সমন্বয়টাও ঠিক রেখেছেন ভালভার্দে। এখন বাকি কাজটা তার ওপরই। গত মৌসুমে ভালো করলেও বার্সার স্বভাবসুলভ ছন্দটা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এবার হারানো গৌরব খুঁজে পেতে সেদিকেও মন দিতে হবে বার্সা কোচকে।
স্টেগান যখন স্টেনগান
বার্সেলোনার লিগ জয়ে বড়সড় ভূমিকা ছিল মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগানের। একাধিক ম্যাচে তার অতিমানব হয়ে ওঠা বার্সাকে বাঁচিয়েছে বেশ কয়েকবার। এই মতবাদটা অবশ্য সবার পছন্দ নাও হতে পারে, এর স্বপক্ষে দেখানোর মত পরিসংখ্যানও যথেষ্ট শক্ত নয়। কিন্তু পুরো মৌসুমের খেলা বিবেচনা করলেই স্টেগানের গুরুত্ব বোঝা যায়। নতুন মৌসুমে তাই এই জায়গা নিয়ে তেমন একটা দুশ্চিন্তা নেই ভালভার্দের। বদলি গোলরক্ষক জ্যাস্পাস সিলেসেনও আছেন। কোপা ডেল রের ম্যাচগুলোতে নিশ্চিতভাবেই জায়গা পাবেন। কিন্তু আপাতত স্টেগানকে সরানোর যোগ্যতা তার নেই।
দানি আলভেজের জায়গা শূন্য এখনও
রক্ষণে বার্সেলোনার পুরনো খেলোয়াড়েরাই আছেন। ইয়েরি মিনা কেবল নেই। সেটা খুব বেশি ভোগানোরও কথা নয় বার্সাকে। স্যামুয়েল উমতিতি, জেরার্ড পিকেদের ওপর ভরসা করাই যায়। জর্দি আলবা তো আছেনই। কিন্তু সমস্যাটা রাইটব্যাক পজিশন নিয়ে। সার্জি রবার্তো জায়গা বদলে রাইটব্যাক হিসেবে ভালো করেছেন আগের দুই মৌসুম। গতবার শুরুতে নেলসন সেমেদো ভালো শুরুর পরও মিলিয়ে গেছেন। পরে রবার্তোই নিয়মিত হয়েছেন, আরও থিতু হয়েছেন রাইটব্যাক পজিশনে। কিন্তু দানি আলভেজের ফেলে যাওয়া শূন্যস্থান পূরণ করার মতো পারফর্ম করতে পারেননি এখনও। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সালে বার্সার সব সাফল্যের অন্যতম কারিগর ছিলেন আলভেজ। ওই সময়ে মেসির সঙ্গে তার বোঝাপড়াটা ছিল দারুণ। সেই তুলনায় রবার্তো-মেসি জুটিটা এখনও আলো ছড়ায়নি। আলবা-মেসি জুটি কার্যকর হয়েছে বেশি। তবে রবার্তোর সঙ্গে সমন্বয়টা ঠিক হলে এই বার্সা হয়ে উঠতে পারে অপ্রতিরোধ্য। বিশেষ করে বার্সার খেলার যে ধরন তাতে মেসির সঙ্গে রাইটব্যাকে খেলা সতীর্থের সঠিক সমন্বয়টা আরও জরুরী।
ভালভার্দের কৌশলে ৪ জনের ব্যাকলাইনে পরিবর্তন আসার কোনো কারণ নেই। আর রক্ষণটা হুট করেই দূর্গে পরিণত হয়ে যাবে সেই আশা করাও যৌক্তিক নয়। সেই হাই ডিফেন্সিভ লাইনেই পিকে, উমতিতিরা খেলবেন সেটা নিশ্চিত। ভালভার্দের অধীনে দ্বিতীয় মৌসুমে সেই অভ্যাসটা কতখানি পোক্ত হয়েছে, সেটার ওপরই আসলে নির্ভর করছে বার্সার রক্ষণ কেমন হবে।
মিডফিল্ডে ৪ জন না ৩ জন?
গতবার বেশিরভাগ ম্যাচেই ৪-৪-২ ফর্মেশন অনুসরণ করেছিলেন ভালভার্দে। এবার সেটা বদলে যেতে পারে। তাতে বদলে যেতে পারে বার্সার খেলার ধরনও। ৩ জনের মিডফিল্ড অনেকটাই নির্ভর করছে আক্রমণভাগের ওপর। সার্জিও বুস্কেটস নিজের বিচারে গেল মৌসুমে কিছুটা খারাপই খেলেছেন। ৩ জনের মিডফিল্ড হলে সেখানে বুস্কেটসই যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হবেন তাতে সন্দেহ নেই। ৪ জনের মিডফিল্ডেই বরং কিছুটা সমস্যায় পড়েন বুস্কেটস।
ম্যালকম, ল্যাংলেট, আর্থাররা আপাতত একাদশে সুযোগ পাবেন না কী না সেটা বলা মুশকিল। দারুণ এক বিশ্বকাপ কাটিয়ে আসা ইভান রাকিটিচের কাছে সমর্থকদের এবার প্রত্যাশাটা থাকবে আরও বেশি। এই দুইজনের জায়গাটা মিডিফিল্ডে পাকাই।
আর আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা দলে থাকার সময় নিজের পছন্দের জায়গায় অল্পই খেলতে পেরেছেন ফিলিপ কৌতিনহো। এবার তিনিই সর্বেসর্বা। ইনিয়েস্তার ফেলে যাওয়া জায়গা পূরণ করতে হবে তাঁকেই। শীতকালীন দলবদলের বাজারে যোগ দিয়ে প্রস্তুতিটাও নিয়ে রাখার সময় পেয়েছিলেন। এবার গোঁড়া থেকেই আছেন দলে। ব্রাজিলের বিশ্বকাপটা ভালো না গেলেও, তিনি ছিলেন দুর্দান্ত। সেই দুর্দান্ত কৌতিনহোকেই এবার দরকার বার্সার।
যথেষ্ট পরিমাণ অপশন থাকায় ভালভার্দের কাছে থাকছে পরীক্ষা করার সুযোগও। কৌতিনহোকে আরেকটু ওপরে উঠিয়ে দিয়ে, তিন জনের মিডফিল্ডে বুস্কেটস, রাকিটিচের সঙ্গে ভিদাল যোগ করতে পারেন আলাদা মাত্রা। বিশেষ করে ভিদালের ওয়ার্করেট গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতে সাহায্যই করার কথা বার্সাকে। আর ভালভার্দে যদি নিজের পুরনো কৌশলেই থাকতে চান, তাহলে চারজনের মিডফিল্ডে ভিদালের জায়গাটাও পাকা ধরে নেওয়া যায়। মিডফিল্ড নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ভালভার্দের সিদ্ধান্তের ওপরই আসলে নির্ভর করছে সবকিছু।
মেসি নির্ভরতা কমাতে হবে, ডেম্বেলের অগ্নিপরীক্ষা
চ্যাম্পিয়নস লিগে রোমার সঙ্গে দুই লেগেই বিবর্ণ ছিলেন মেসি। তাতেই কুপোকাত বার্সেলোনা। আক্রমণভাগে এই মেসি নির্ভরতাই কমাতে হবে তাদের। ৩১ বছর বয়সে এসে মেসি প্রতি ম্যাচেই ঝলক দেখাবেন, সেটা যে বাস্তবসম্মত চাওয়া নয়- তাও বুঝতে হবে ভালভার্দেকে।
দলে মেসি থাকাটাই বার্সাকে স্পেনের বাকি দুই শিরোপাপ্রত্যাশীর চেয়ে আলাদা করে দিচ্ছে। অধিনায়ক হিসেবে মেসির দায়িত্বটাও বেড়েছে। কিন্তু উপলব্ধির সময়টাও বোধ হয় এসে গেছে বার্সার। তুলনামূলক সহজ দলগুলোর সঙ্গে ম্যাচগুলোতে জয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পরও মেসিকে খেলিয়ে যাওয়ার চিন্তায় কিছুটা পরিবর্তন আনলে তাতে বার্সারই লাভ হওয়ার কথা। বিশেষ করে মৌসুমের শেষদিকে মেসির ক্লান্তি জেঁকে বসলে সেটা তো হিতে বিপরীতই হতে পারে।
৩ জনের আক্রমণভাগে মেসি বরাবরই যে কোনো প্রতিপক্ষের জন্য ভয়ঙ্কর। কিন্তু দুইজনের আক্রমণভাগে তার দুর্বলতাটা স্পষ্টই। প্রতিপক্ষের কৌশলের কাছ হার মেনে গেলে, মাঠেই একা পড়ে যান মেসি। রোমার বিপক্ষে গত মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচেও ঘটেছে একই ঘটনা। বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাতেও ছিল একই অবস্থা। মেসি বরং কিছুটা নেমে এসে খেলাতেই বেশি পারদর্শী। মেসিকে ঘিরেই পুরো দলের কৌশলের আবর্তন করে। সেই হিসেবে মেসি, সুয়ারেজের সঙ্গে ডেম্বেলেকে দেখা যেতে পারে এবার। কিন্তু ডেম্বেলে নিয়মিত হতে পারবেন তো? ন্যু ক্যাম্পে নিজের প্রথম মৌসুমের বেশিরভাগ সময় ইনজুরিতে ছিলেন মাঠের বাইরে। শেষদিকে অবশ্য ভালোকিছুর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। সেই ইঙ্গিতগুলোই বাস্তবে পরিণত করার সময় এসেছে ডেম্বেলের। বিশেষ করে লুইস সুয়ারেজের ফর্ম যখন নিম্নগামী, ডেম্বেলের আরও বড় ভূমিকা পালন করা তখন দলেরই প্রত্যাশা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ছোট কাঁধে সেই চাপ সামলাতে পারবেন?
ডেম্বেলেকে কাজে লাগাতে না পারলে কৌতিনহোকেও তার জায়গায় বাজিয়ে দেখা যেতে পারে। ভালভার্দের হাতে আসলে অপশন অনেক। গতবারের তুলনায় পরিস্থিতিও পুরো বিপরীত। মনমতো দল পেয়ে ভালভার্দে সঠিক সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারেন কী না- সেটার ওপরই আসলে নির্ভর করছে বার্সার ভালো মন্দ।