আবারও জিরোনায় পা কাটল রিয়াল মাদ্রিদের
লা লিগায় তাদের বয়সটা দুই বছরের। গত মৌসুমেই নিজেদের মাঠে রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে রীতিমত আলোড়ন তুলেছিল জিরোনা। আজ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে যখন কাসেমিরোর গোলে লিড নিয়েছিল রিয়াল, তখন হয়ত দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সান্তিয়াগো সোলারির দলের আরও এক সহজ জয়ই আশা করছিলেন অনেকে। এই মৌসুমে বার্সেলোনাকে ন্যু ক্যাম্পে আটকে দিয়ে জিরোনা যেন প্রমাণ করেছিল, গত মৌসুমে রিয়ালের বিপক্ষে জয়টা কোনও অঘটন ছিল না। আর আজ তো নিজেদের সামর্থ্যের সম্পূর্ণ জানানটাই দিল তারা। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে আজ ২০১৮-১৯ লা লিগার অন্যতম বড় অঘটনের জন্ম দিল জিরোনা। রিয়ালকে তাদেরই মাঠে ২-১ গোলে হারিয়েছে তারা। গত সপ্তাহে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদকে হারিয়ে টেবিলের দুইয়ে উঠে এসেছিল রিয়াল। গতকাল ডিয়েগো সিমিওনের দল জিতে যাওয়ায় আবারও তিন-এ নেমে গেল 'লস ব্লাঙ্কোস'রা। ৫৪ পপয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে আছে বার্সেলোনা।
গত সপ্তাহে আয়াক্সের বিপক্ষে গোলের পুরষ্কারস্বরূপ আজ শুরু থেকেই ছিলেন মার্কো আসেন্সিও। রিয়ালের বর্তমান সময়ের 'হট কেক' ভিনিসিয়াস জুনিয়রের বদলে নেমেছিলেন তিনি। লুকা মদ্রিচের বহিষ্কারাদেশের কারণে মাঝমাঠে ফিরেছিলেন দানি সেবায়োস। কিন্তু প্রায় পূর্ণশক্তির রিয়ালের বিপক্ষে বার্নাব্যুতে গোলের প্রথম সুযোগটা পেয়েছিল জিরোনাই। ২ মিনিটেই ক্রিশ্চিয়ান পর্তুর থ্রু পাস থেকে ডিবক্সে বল পেয়ে যান ক্রিশ্চিয়ান স্তুয়ানি। কিন্তু উরুগুইয়ান স্ট্রাইকারের জোরাল শট ফিরিয়ে দিয়েছেন থিবো কর্তোয়া। শুরুতেই জিরোনার এমন সতর্কবাণী পেয়ে নড়েচড়ে বসে রিয়াল। মাঝমাঠের দখলটা নিজেদের করে নেন কাসেমিরো এবং টনি ক্রুস। কিন্তু আক্রমণভাগের সাথে যোগসাজশটা হচ্ছিল না ঠিকঠাক। ভিনিসিয়াসের অভাবটা বেশ ভালমতই টের পেয়েছে রিয়াল। ম্যাচে নিজেদের প্রথম সুযোগ পেতে ১৭ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে রিয়ালকে। ক্রুসের পাস থেকে দুজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে জিরোনা গোলরক্ষক ইয়াসিন বোনোকে একা পেয়ে যান লুকাস ভাজকেজ। কিন্তু স্প্যানিশ ফরোয়ার্ডের 'চিপ' দক্ষহাতেই ফিরিয়েছেন বোনো। জিরোনাও হাল ছাড়ার পাত্র নয়।
মিনিট দুয়েক পরই দুর্দান্ত এক প্রতি-আক্রমণে আবারও কর্তোয়াকে পরীক্ষায় ফেলেন স্তুয়ানি, কিন্তু বেলজিয়ান গোলরক্ষক এবারও ফিরিয়ে দেন তাকে। ম্যাচের প্রথমদিকে রিয়ালকে চেপে ধরেও লিড নিতে না পারার চড়া মাশুলই দিতে হয়েছে জিরোনাকে। গত সপ্তাহে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে রিয়ালকে লিড এনে দিয়েছিলেন তিনিই। ২৫ মিনিটে ক্রুসের ক্রস থেকে হেড করে আবারও দলকে এগিয়ে নেন কাসেমিরো। মিনিট পাঁচেক পর ব্যবধান দ্বিগুণের দারুণ সু্যোগ পেয়েছিলেন করিম বেনজেমা। কিন্তু ৩০ মিনিটে আলভারো ওদ্রিওজোলার ক্রসে গোলের সামনে থেকেও বলে পা ছোয়াঁতে পারেননি ফ্রেঞ্চ স্ট্রাইকার। ৩৬ মিনিটে আবারও রিয়ালকে রুখে দেন বোনো, দূরপাল্লার শটেও মরক্কোর গোলরক্ষককে পরাস্ত করতে পারেননি আসেন্সিও। ৪৪ মিনিটে অবশ্য জিরোনার জালে বল ঠিকই পাঠিয়েছিলেন মার্সেলো, কিন্তু অফসাইডে বাতিল হয় গোলটি। রিয়ালের ফুটবলারদের আবেদনে ভিডিও রেফারির সাহায্য নিয়েও বদলায়নি সিদ্ধান্ত। বোনো না থাকলে হয়ত আরও বড় লিড নিয়েই প্রথমার্ধ শেষ করত রিয়াল।
প্রথমার্ধে গোল করতে না পারায় চড়া মাশুলই গুণতে হয়েছে জিরোনাকে। লিড নিলেও প্রথমার্ধে ব্যবধান বাড়াতে না পারায় ভুগতে হয়েছে রিয়ালকেও। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই লোজানোকে নামিয়ে দেন জিরোনা ম্যানেজার ইউসেবিও। প্রথমার্ধে বাঁ-প্রান্তে খেলা পর্তু চলে আসেন ডানপ্রান্তে, তার জায়গায় খেলেন লোজানো। রিয়ালের বাঁ-প্রান্তে মার্সেলোকে পেয়েই পুরো দ্বিতীয়ার্ধ রিয়ালের রক্ষণভাগে রীতিমত ত্রাস ছড়িয়েছেন পর্তু, আবারও প্রমাণিত হয়েছে ডিফেন্ডার হিসেবে মার্সেলোর অক্ষমতা। ৫৬ মিনিটে প্রথম সুযোগটা পেয়েছিলেন পর্তুই। তবে লোজানোর ক্রস থেকে তার হেড ফিরিয়ে দিয়েছেন কর্তোয়া। প্রথমার্ধের মত দ্বিতীয়ার্ধেও দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন কর্তোয়া। ৫৯ মিনিটে রিয়ালকে আবারও বাঁচিয়ে দেন কর্তোয়া। তবে এক্ষেত্রেও ভাগ্যকেও ধন্যবাদ জানাতে পারে রিয়াল। লোজানোর ক্রস থেকে অ্যালেক্স গার্সিয়ার হেড দুর্দান্তভাবে ফিরিয়ে দেন কর্তোয়া। ফিরতি বলে গোলের সামনে থেকেও লক্ষ্যে রাখতে পারেননি স্তুয়ানি। তবে ৬৩ মিনিটে দলকে সমতায় ফিরিয়েছেন তিনিই। দ্বিতীয়ার্ধে মার্সেলোকে নাকানিচুবানি খাওয়ানো পর্তুর ক্রস থেকে লোজানোর হেড ফিরিয়ে দেন কর্তোয়া, কিন্তু ফিরতি বলে স্তুয়ানির শট লাগে রিয়াল অধিনায়ক সার্জিও রামোসের হাতে। পেনাল্টি পায় জিরোনা। ১২ গজ থেকে অবশেষে গোল পেয়ে যান স্তুয়ানি। সমতায় ফিরে যেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে জিরোনা।
স্তুয়ানি গোল করলেও পুরো দ্বিতীয়ার্ধে জিরোনার সেরা খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। ৭১ মিনিটেই দলকে লিড এনে দিতে পারতেন পর্তু। কিন্তু ডানপ্রান্ত থেকে তার আগুনে শট কর্তোয়াকে পরাস্ত করলেও প্রতিহত হয় বারপোস্টে। তবে এজন্য খুব একটা ভুগতে হয়নি জিরোনা এবং পর্তুকে। ৭৩ মিনিটে স্তুয়ানির পাস থেকে বাঁ-প্রান্তে বল পান লোজানো। জিরোনা ফরোয়ার্ডের ডানপায়ের বাঁকানো শট দুর্দান্তভাবে ফিরিয়ে দেন কর্তোয়া, কিন্তু ফিরতি বলে মার্সেলোকে ফাঁকি দিয়ে গোল করেন পর্তু। এতক্ষণ উৎসবমুখর পরিবেশের বার্নাব্যু মুহূর্তেই পরিণত হয় মৃত্যুপুরিতে, বুনো উল্লাসে ভাসেন মাঠে উপস্থিত জিরোনা সমর্থকেরা। ম্যাচের বাকিটা সময় রীতিমত সম্ভাব্য সবই চেষ্টা করেছেন সোলারি। নামিয়ে দিয়েছিলেন ভিনিসিয়াস এবং মারিয়ানো দিয়াজকেও, কিন্তু কাজের কাজ আর হয়নি। উল্টো মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আসে ৯০ মিনিটে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখে রামোসের মাঠ ছাড়া। দ্বিতীয়ার্ধের যোগ করা সময়ের একদম শেষদিকে কর্ণার পেয়েছিল রিয়াল। ম্যাচ বাঁচানোর আশায় জিরোনা ডিবক্সে চলে এসেছিলেন কর্তোয়া। ক্রুসের কর্ণার থেকে হেডও করেছিলেন, কিন্তু বল চলে যায় গোলের সামান্য বাইরে দিয়ে। মাথা নিচু করে নিজ গোলের দিকে ফিরে যান কর্তোয়া। সেই সাথে হয়ত শেষ হয়ে গেল রিয়ালের লা লিগা জেতার ক্ষীণ সম্ভাবনাটুকুও।