মেসির '৫০'-এ পুড়লো সেভিয়া
শেষ চার ম্যাচে হাসেনি তার পা জোড়া। ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে ন্যু ক্যাম্পে ২-২ গোলের পর থেকে গোলই পাওয়া হয়নি তার। বার্সাও যেন জিততে ভুলে গিয়েছিল। লা লিগার শিরোপা ধরে রাখার পথটা সুগম করতে আজকে জিততে হত বার্সেলোনাকে,। আবারও বার্সার সংকটময় সময়ে জ্বলে উঠলেন লিওনেল মেসি। আর তাতেই পুড়ল সেভিয়া। ক্যারিয়ারে ‘হ্যাটট্রিক’-এর ‘হাফসেঞ্চুরি’ পূরণ করেই ক্ষান্ত দেননি। গোলখরায় ভুগতে থাকা সতীর্থ লুইস সুয়ারেজকে দিয়েও করিয়েছেন গোল। মেসি যেদিন এমন দুর্দান্ত ফর্মে, সেদিন অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া হয়ত আর কিছুই করতে পারত না সেভিয়া। লা লিগায় আরও এক মেসিময় ম্যাচে সেভিয়াকে ৪-২ গোলে হারিয়েছে বার্সা।
সেভিয়ার বিপক্ষে আজ ইনজুরি কাটিয়ে মাস তিনেক পর বার্সার মূল একাদশে ফিরেছিলেন স্যামুয়েল উমতিতি। কিন্তু ফিরলেও উমতিতি যেন জানান দিলেন, এখনও সম্পূর্ণ ‘ম্যাচ ফিট’ নন তিনি। সেভিয়ার স্বভাবসুলভ প্রেসিং ফুটবলে প্রথমার্ধে বেশ কয়েকবার বল হারিয়েছেন, রক্ষণে জেরার্ড পিকের সাথেও বোঝাপড়ার অভাবটা ছিল সুস্পষ্ট। পিকে নিজেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। উইসাম বেন ইয়েদেররা প্রথমার্ধে রীতিমত নাচিয়ে ছেড়েছেন তাকে। বেন ইয়েদের সহজ দুটি সুযোগ হাতছাড়া না করলে হয়ত তখনই লিড নিতে পারত সেভিয়া। পিকে, উমতিতিরা স্বরূপে না থাকলেও ম্যাচের শুরুতেই বার্সার পিছিয়ে না পড়ার কারণ অবশ্যই গোলরক্ষক মার্ক আন্দ্রে টার স্টেগান। প্রথম ২০ মিনিটে উইঙ্গার কুইন্সি প্রোমিস এবং পাবলো সারাবিয়ার দুটি নিশ্চিত গোল বাঁচিয়েছেন জার্মান গোলরক্ষক। কিন্তু ২২ মিনিটে টার স্টেগানও রুখে দিতে পারেননি সেভিয়াকে। দুর্দান্ত এক প্রতি-আক্রমণে বেন ইয়েদেরের পাস থেকে ডিবক্সে স্টেগানকে একা পেয়ে যান সেভিয়া অধিনায়ক হেসুস নাভাস। ডানপায়ের মাপা শটে সেভিয়া সমর্থকদের বুনো উল্লাসে মাতান তিনি। তবে পাবলো মাচিনের দলের উল্লাস দীর্ঘস্থায়ী হয়নি খুব একটা। নাভাসের গোলে লিড নিলেও ম্যাচের শুরুর দিকে বেন ইয়েদেরের সুযোগ হাতছাড়া করার চড়া মাশুলই দিতে হয়েছে সেভিয়াকে। গোল করার দিক দিয়ে সেভিয়া কেন তার ‘প্রিয়’ প্রতিপক্ষ, আজ তা-ই প্রমাণ করলেন মেসি।
২৬ মিনিটে বাঁ-প্রান্ত থেকে ইভান রাকিটিচের ক্রসে শরীর বাঁকিয়ে বাঁ-পায়ের দুর্দান্ত ভলিতে দলকে সমতায় ফেরান বার্সার অধিনায়ক। উল্লাসে মাতা রামোন সানচেজ পিজুয়ান স্টেডিয়াম তখন যেন নিঃশব্দ মৃত্যুপুরী। লিড হারালেও হাল ছাড়েনি সেভিয়া। দুর্দান্ত প্রেসিংয়ের বিপক্ষে বার্সাকে ঠিকই বেগ পেতে হয়েছে। মাঝমাঠে আর্তুরো ভিদাল বা আক্রমণে ফিলিপ কুতিনিয়ো- নিচে নেমে রক্ষণে পিকেদের সাহায্য করেননি কেউই। মাঝমাঠে সেভিয়ার প্রেসিংয়ের বিপক্ষে তাই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি বার্সা। ৪২ মিনিটে আবারও লিড নেয় সেভিয়া। সারাবিয়ার ক্রসে বার্সার ডিফেন্ডারদের ভুলে বল পেয়ে যান গ্যাব্রিয়েল মার্কাদো। আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডারের গোলে লিড নিয়েই প্রথমার্ধ শেষ করে বার্সা।
বার্সার লা লিগা শিরোপা ধরে রাখার মিশনের অন্যতম বাধা ছিল সেভিয়া। পিছিয়ে থাকা ম্যাচ বাঁচাতে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই সার্জি রবার্তো এবং উসমান ডেম্বেলেকে নামিয়ে দেন কোচ এর্নেস্তো ভালভার্দে। ডেম্বেলে, কুতিনিয়ো, মেসি ,সুয়ারেজদের পেয়ে জ্বলে উঠে বার্সা। ৫৫ মিনিটেই সমতায় ফিরতে পারত তারা। কিন্তু সুয়ারেজের পাস থেকে সেভাই গোলরক্ষক টমাস ভাচলিককে একা পেয়েও গোল করতে পারেননি ডেম্বেলে। মিনিট দশেক পর আবারও গোলের সুযোগ পায় বার্সা। কিন্তু ডেম্বেলের মতই বল জালে পাঠাতে ব্যর্থ হন সুয়ারেজ। সতীর্থদের মিসের মহড়ায় হারের আশঙ্কা যেন পেয়ে বসতে থাকে বার্সাকে। কিন্তু তখনই আবারও ত্রাণকর্তা হয়ে আসেন তিনি।
সুয়ারেজের মিসের পর ক্যামেরায় ধরা পড়ে মেসির অভিব্যক্তি। হতাশ, শূন্যদৃষ্টি। কিন্তু হাল যেন না ছাড়ার চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা নিয়েই নেমেছিলেন মেসি। হাতের আর্মব্যান্ডটা আরও শক্ত করে বাঁধলেন। মেসির নিজেকে ফিরে পাওয়ার দিনে কোনও বাঁধাই আটকাতে পারত না তাকে। ডানপায়ে মেসির সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন পেলে। ৬৭ মিনিটে ডেম্বেলের পাস থেকে সেই ডানপায়েরই দুর্দান্ত এক বাঁকানো শটে দলকে আবারও সমতায় ফেরান মেসি। দ্বিতীয়বার দলকে সমতায় ফেরালেও কোনও উদযাপন করেননি মেসি, উল্টো বল হাতে দৌড়ে এসেছেন সেন্টার বৃত্তের দিকে। খেলা যে এখনও বাকি অনেকটাই! মেসি যখন এতটাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দলকে জেতাতে, সেদিন আর কীইবা করতে পারত সেভিয়া।
সেভিয়া পারেনি। পারেননি প্রথমার্ধে রীতিমত দুর্ভেদ্য দেয়াল হয়ে থাকা সেভিয়ার ডিফেন্ডার সাইমন কিয়ের এবং মার্কাদোরা। ৭২ মিনিটেই হ্যাটট্রফিক পূরণ করতে পারতেন। কিন্তু দুর্দান্ত সেভে মেসিকে ফিরিয়েছেন ভাচলিক। ৭৮ মিনিটে আবারও সুযোগ পেয়েছিলেন মেসি। ভাচলিক এবার পরাস্ত হলেও বল চলে যায় গোলের সামান্য উপর দিয়ে। কিন্তু দিনটা যে কেবলই মেসির। ৭২ ও ৭৮ মিনিটে যে ভাগ্য সহায় হয়নি, সেই ভাগ্যের কিছুটা সহায়তায়ই হ্যাটট্রিকটা পেয়ে গেলেন। ৮৪ মিনিটে কার্লোস অ্যালেনার শট কিয়েরের পায়ে লেগে আসে মেসির দিকে। প্রথম টাচেই আগুয়ান ভাচলিককে চিপ করে হ্যাটট্রিক পূরণ করেন ‘লিও’। ম্যাচের পুরোটা সময়ই দুয়ো শুনেছেন সেভিয়া সমর্থকদের থেকে। সেই সেভিয়া সমর্থকেরাই দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানালেন হ্যাটট্রিকের পর। হ্যাটট্রিক করেও শেষ হয়নি ‘মেসি ম্যাজিক’। দ্বিতীয়ার্ধের যোগ করা সময়ে দুর্দান্ত এক থ্রু পাসে বাড়ান সুয়ারেজের দিকে। মেসির হ্যাটট্রিক গোলের মতই চিপ করে সেভিয়ার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেন সুয়ারেজ। আগামী সপ্তাহেই রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে কোপা ডেল রে সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে মুখোমুখি হচ্ছে বার্সা। এমন সময়েই জ্বলে উঠেছেন মেসি। লা লিগার শিরোপার ধরে রাখার পথের অন্যতম বাঁধা সেভিয়াকে হারানোর দিনে আর কীইবা চাইতে পারতেন ভালভার্দে।