রিয়াল মাদ্রিদকে শূলে চড়ালেন সুয়ারেজ
ম্যাচটা হতে পারত ভিনিসিয়াসের। অধারাবাহিক মৌসুমে কোপা ডেল রের ফাইনালে উঠে কিছুটা তৃপ্তিও পেতে পারত রিয়াল মাদ্রিদ। আগের দুইবারই কোপার সেমিফাইনালে বার্সেলোনাকে হারিয়েছিল তারা। খেলাও সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে। প্রথম লেগের ১-১ গোলের ড্রয়ের পর প্রথমার্ধে রিয়ালের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স রিয়ালকে ভালোকিছুর স্বপ্নই দেখাচ্ছিল। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে বার্সার অভিজ্ঞতার সঙ্গে আর শেষ পর্যন্ত পেরে উঠল না রিয়াল। আর রিয়ালের মাঠে বার্সার জয়ও যেন আরেকটু পরিণত হলো নিয়মিত ঘটনায়। রিয়াল মাদ্রিদকে এবার ৩-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছে কাতালানরা। আর দুই লেগ মিলিয়ে ৪-১ গোলে জিতে ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে টানা ষষ্ঠবারের মতো কোপা ডেল রের সেমিফাইনালে উঠে গেল বার্সেলোনা।
ম্যাচের আগে ভিনিসিয়াস জানিয়েছিলেন লিওনেল মেসিকে আর ভয় পায় না রিয়াল মাদ্রিদ। ওই এক মন্তব্যেই আলোচনায় চলে এসেছিলেন ১৮ বছর বয়সী রিয়াল ফরোয়ার্ড। প্রথমার্ধের খেলায় অবশ্য বোঝা গেল শুধুমাত্র মুখের কথাতেই নয়, খেলার মাঠে ভিনিয়াসের ভয়-ডর আসলেই নেই। ব্রাজিলিয়ানই প্রায় পুরোটা সময় তটস্থ করে রেখেছিলেন বার্সার রক্ষণকে। ৬ টি শট করেও কেবল গোলটাই পাননি তিনি। যে কাজটা তিনি পারেননি, সেই কাজটা করে দিয়েছেন অন্যপ্রান্তে লুইস সুয়ারেজ। তার জোড়া গোলেই বার্নাব্যু থেকে জয় ছিনিয়ে এনেছে এর্নেস্তো ভালভার্দের দল।
স্কোরলাইন দেখে অবশ্য বার্সার একচেটিয়ে আধিপত্যের ম্যাচ মনে পারে। তবে কোপার এল ক্লাসিকোটা মোটেই তেমন কিছু ছিল না। যদিও বার্নাব্যুতে ৮ মিনিটে ম্যাচের প্রথম গোছানো আক্রমণ এসেছিল বার্সার কাছ থেকেই। মেসি, ডেম্বেলের সাজানো আক্রমণ বিপদ বাড়ার আগেই ক্লিয়ার করেছেন রেগুইলন। এরপর দৃশ্যপটে ভিনিসিয়াস। ১৪ মিনিটে একটা পেনাল্টিও আদায় করে ফেলতে পারতেন তিনি, কিন্তু ভিএআরের সিদ্ধান্ত আর এবার গেল না রিয়ালের পক্ষে। ডিবক্সের ভেতর ঢুকে পড়া ভিনিয়সিয়াসকে আটকাতে গিয়ে আরেকটু হলেই নেলসন সেমেদো দলকে বিপদে ফেলে দিতে পারতেন তখন। এর মিনিট পাঁচেক পর প্রথমবার গোলে শট করেন ভিনিসিয়াস। অবশ্য সে দফায় আর অন টার্গেটে রাখতে রাখতে পারেননি শট।
প্রথমার্ধে বার্সা বলার মতো আক্রমণে উঠতে পেরেছে কমই। মেসি, সুয়ারেজদের সেভাবেই বলই পেতে দেননি কাসেমিরো, ক্রুসরা। মেসি শেষে পুরো ম্যাচই কাটিয়েছেন নিজের ছায়া হয়ে থেকে। আক্রমণভাগে মেসির দুই সঙ্গী বাঁচিয়ে দিয়েছে তাকে। ম্যাচের আধঘন্টা চলার সময় বাম প্রান্ত দিয়ে দারুণ একটি ক্রস করেছিলেন উসমান ডেম্বেলে। কিন্তু কেইলর নাভাসের সঙ্গে সেই বলের নাগাল মিস করেছেন বার্সার আক্রমণভাগ থাকা খেলোয়াড়েরাও। বার্সাকে অবশ্য রক্ষণেও যথেষ্ট ভঙ্গুরই মনে হচ্ছিল। বিশেষ করে ভিনিসিয়াসকে আটকাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছিল ডিফেন্ডারদের। এরমধ্যে জেরার্ড পিকে মিডফিল্ডে একবার বল হারিয়ে ভিনিসিয়াসকে গোলের সামনে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন। মিডফিল্ডে পিকের পা থেকে বল ছিনিয়ে নিয়ে লবটা করেছিলেন কাসেমিরো, সোজা গোলের দিকে যাওয়া ভিনিসিয়াস তখন একটু দেরিই করে ফেলেছিলেন শট করতে। ফলো থ্রুতে করিম বেনজেমার কাছেও দারুণ সুযোগ ছিল গোল করার, কিন্তু মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগান বাধা হয়ে দাঁড়ান বেনজেমা আর গোলের মধ্যে।
কোপা ডেল রেতে বার্সার নিয়মিত গোলরক্ষক জ্যাস্পার সিলেসেন ছিলেন বেঞ্চে। ডাচ গোলরক্ষক পুরোপুরি ইনজুরি কাটিয়ে না ওঠায় স্টেগানই নেমেছিলেন বার্সার গোলবারের পাহারায়। দুই প্রান্তের গোলরক্ষকের মধ্যে প্রথমার্ধে ব্যস্ত সময়ও কাটিয়েছেন তিনিই। ৩৮ মিনিটে ভিনিসিয়াসের শট স্টেগান ঠেকিয়ে না দিলে রিয়ালই এগিয় যেত ম্যাচে। প্রথমার্ধের সেরা সুযোগও ছিল ভিনিসিয়াসের ওই শটটাই।
প্রথমার্ধ কেটেছে গোলশূন্যই। এল ক্লাসিকোতে এমনটা ঘটে না সচরাচর। গোলশূন্যভাবে শেষ কবে ক্লাসিকো শেষ হয়েছিল সেটা মনে করাও দায়।
রিয়াল মাদ্রিদ যখন বার্সার ওপর জেঁকে বসছিল তখনই ডেডলক ভাঙে বার্সা। শুরুটা জর্দি আলবার একটি সাধারণ পাস থেকে। বাম প্রান্ত দিয়ে সেই পাস ধরেই ডেম্বেলে ক্রস করলেন, এবার ডিবক্সের ভেতর বল পেলেন সুয়ারেজ। সময়টা ভালো যাচ্ছিল না উরুগুইয়ান স্ট্রাইকারের। কিন্তু সময়মতো জ্বলে উঠলেন তিনিই। দুর্দান্ত এক ফার্স্ট টাইম শটে রামোস, নাভাস দুইজনকেই বোকা বানিয়ে সুয়ারেজ বার্সাকে এগিয়ে দিলেন ম্যাচে। তাতে ন্যু ক্যাম্পে হজম করা বার্সার অ্যাওয়ে গোলটাও শোধ করা হয়ে গেল বার্সার ৫০ মিনিটে।
অথচ দ্বিতীয়ার্ধেও শুরুটা ভালো করেছিল সান্তিয়াগো সোলারির দল। সুয়ারেজের প্রথম গোলের আগে আর পরে দুইটি সেন্টার থেকে হেডে গোল পেয়ে যেতে পারত রিয়াল। প্রথমবার বেনজেমা হেড করেছেন ওপর দিয়ে, পরেরবার কাসেমিরোর হেড চলে যায় অনেক বাইরে দিয়ে। তবে বার্নাব্যুতে তবুও স্বপ্ন টিকেছিল ভালোমতোই। লস ব্লাংকোদের স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন সেই দুই তরুণই, ভিনিসিয়াস আর মার্সেলোর জায়গায় খেলতে নামা রেগুইলন। ৫৯ মিনিটে রেগুইলন একটি ক্রস ভাসকেজ পাওয়ার আগেই ক্লিয়ার করেন ক্লেমেন্ত লংলে। কিছুক্ষণ পর রেগুইলনকেই সুযোগ তৈরি করে দেন ভিনিসিয়াস। কিন্তু আরও একবার স্টেগানের কাছে হার মানে রিয়ালের ভাগ্য। রেগুইলনের হেডটা নিজের বামদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠেকিয়ে দেন বার্সার জার্মান গোলরক্ষক।
ভিনিসিয়াস তবুও হার মানেননি, ৬৮ মিনিটে বার্সার দুই ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন বার্সার গোলের কাছাকাছি, এরপর শটও করেছিলেন। কিন্তু দিনটা যে তাঁর হবে না, সেটা হয়ত আগেই লেখা হয়ে গিয়েছিল। নাহলে নিশ্চিত গোলের দিকে যেতে থাকা শট সেমেদোর পায়ে লেগে অল্পের জন্য লক্ষ্য মিস করবে কেন! এরপরই ভাসকেজকে উঠিয়ে গ্যারেথ বেলকেও মাঠে নামিয়ে দেন সোলারি। কিন্তু বেল মাঠে নেমে কেবল হতাশই হয়েছেন।
৬৯ মিনিটেই আসলে ম্যাচ থেকে ছিটকে যায় রিয়াল। ডেম্বেলে এবার ডানদিক দিয়ে উঠলেন আক্রমণে, করলেন ক্রস। সুয়ারেজ সেখানে ছিলেন, নিশ্চিতভাবেই তিনিই হয়ত গোলটি পেতেন। তাকে আটকাতে গিয়ে রাফায়েল ভারান নিজের জালেই গোল করে বসেন। ম্যাচের ফল আসলে তখনই লেখা হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু স্বপ্ন ভঙ্গের কষ্ট তখনও বাকি ছিল ঘরের দলের জন্য। সুয়ারেজকে ডিবক্সের ভেতর ফাউল করে ৭২ মিনিটে বার্সাকে পেনাল্টি দিয়ে বসেন কাসেমিরো। মেসি নন, সুয়ারেজই নেন স্পটকিক। ভুল করেননি তিনি, আত্মবিশ্বাসী পানেনকায় রিয়ালের বিপক্ষে নিজের ১১ তম গোল তুলে নেন উরুগুইয়ান স্ট্রাইকার। পুরো ম্যাচেই বার্সার চেয়ে ভালো খেলা রিয়ালের হারটা তাই শেষ পর্যন্ত হয়েছে অস্বস্তিকরই।
স্কোরলাইন ৩-০ হওয়ার পর বাকি সময়টুকু আক্ষরিক অর্থেই আনুষ্ঠানিকতারই হয়ে গিয়েছিল। এই ম্যাচ যে দল জিতত, ট্রেবলের পথে একধাপ এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তাদের। কখনই ট্রেবল না জেতা রিয়ালের স্বপ্নটা অধরাই থেকে যাচ্ছে অন্তত আরেকটি মৌসুম। তবে বার্নাব্যুতে চাপে পড়েও পথ না হারিয়ে মেসির বার্সা হাঁটা ধরলো ঠিক পথেই। আগামীকাল ভ্যালেন্সিয়া ও রিয়াল বেটিসের ম্যাচের পরই জানা যাবে ফাইনালে বার্সার প্রতিপক্ষ কারা।