বিদায়, পার্শ্বনায়ক!
টনি ক্রুসের কর্নার থেকে করিম বেনজেমার হেডে রিয়াল ভায়াদোলিদের মাঠে লিড নিল রিয়াল মাদ্রিদ। রিয়ালের সবাই মাতলেন উল্লাসে, কিন্তু ডাগআউটের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। হাত-পা গুটিয়ে গম্ভীর হয়ে চুপচাপ বসে আসেন রিয়ালের কোচ সান্তিয়াগো সোলারি। ১০ জন নিয়েও শেষ পর্যন্ত রিয়াল জিতল ৪-১ ব্যবধানে। রেফারির শেষ বাঁশির পরই সোজা ড্রেসিংরুমের পথ ধরলেন সোলারি, অপেক্ষা করলেন না কারও জন্য। চাকরি যায়যায় অবস্থা। এই জয়ের পর আরও কিছুদিন থাকছেন সোলারি, জানিয়েছিল মার্কা। কিন্তু সোলারি হয়ত জানতেন আসল খবর।
ভায়াদোলিদের বিপক্ষে সোলারির এমন নির্বিকার অভিব্যক্তির কারণ পরিষ্কার হয়ে গেছে গতকাল সোমবারেই। টানা ৪ ‘হোম’ ম্যাচে হার, কোপা ডেল রে এবং চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বিদায়- রিয়ালের মত সাফল্যবুভুক্ষু ক্লাবে সোলারির টেকারও কথা নয়। গতানুগতিক ধারা ‘অক্ষুণ্ণ’ রাখলেন প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। বরখাস্ত হলেন সোলারি, রিয়ালের হটসিটে ফিরে আসলেন জিনেদিন জিদান। স্বাভাবিকভাবেই রিয়াল সমর্থকেরা মেতেছেন বাধভাঙ্গা উল্লাসে। ইউরোপিয়ান ফুটবল গতকাল থেকে ভুগছে ‘জিদান’ জ্বরে। বিবিসি থেকে পাড়ার সংবাদপত্র, সবখানেই জিদানের ফেরার খবর। নীরবে নিভৃতে বিদায় নেওয়া সোলারি থেকে গেলেন আড়ালে, রিয়ালও মুহূর্তেই ভুলে গেল এই মৌসুমে তাদের ‘পার্শ্বনায়ক’কে।
সোলারিকে ‘পার্শ্ব নায়ক’ উপাধি দেওয়া কি ভুল কিছু? যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন, রিয়ালের অবস্থা তখন যাচ্ছেতাই। গত তিন মৌসুমের ইউরোপসেরা রিয়াল যেন গোল করতেই ভুলে গিয়েছে। জিদানের বিদায়ের পর হুলেন লোপেতেগির অধীনে রিয়ালকে চেনাই ছিল দায়। বার্সেলোনার কাছে ৫-১ গোলে হারের পর বিদায় নিলেন লোপেতেগি। রাফা বেনিতেজ, ম্যানুয়েল পেলেগ্রিনি, আন্তোনিও কন্তেদের সাথে চুক্তি করতে চেয়েছিল রিয়াল, রাজি হয়নি কেউই। শেষমেশ যুবদলের দায়িত্বটা ছেড়ে কোচ হয়েছিলেন সোলারিই। ভঙ্গুর এক রিয়ালকে নিয়ে সোলারির থেকে তেমন কোনও প্রত্যাশাই হয়ত ছিল না কারোই।
সোলারিকে কি আসলেই ব্যর্থ? ৩২ ম্যাচে ২২ জয়, ২ ড্র, ৮ হার। গোল করতে ভুলে যাওয়া রিয়াল তার অধীনে প্রথম ৪ ম্যাচে অন্তত ৪ বা তারও বেশী গোল করল ৩ বার। রিয়ালকে জিতিয়েছেন ক্লাব বিশ্বকাপ। তার অধীনেই নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন করিম বেনজেমা। সোলারির জন্যই রিয়াল পেয়েছে ভিনিসিয়াস জুনিয়র এবং সার্জিও রেগুলিয়ন, ফেদেরিকো ভালভার্দের মত তরুণদের। তবে শিরোপাদৌড়ের কথা হিসেব করলে অবশ্য সোলারি ঠিকই ব্যর্থ। যে রিয়াল গত তিন বছরের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন, সেই দলটাই এবার বিদায় নিল শেষ ষোল থেকে। শিরোপা জেতার সম্ভাবনা তো শেষই, আগামী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলা নিয়েই রিয়ালের টানাটানি। ফলাফল? রিয়ালকে ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড় করানো সোলারির প্রস্থান।
‘পার্শ্বনায়ক’ বা পাদপ্রদীপের আলোর আড়ালে থাকাটা নতুন কিছু নয় সোলারির জন্য। ২০০২ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে জিদানের দুর্দান্ত সেই গোল সবারই মনে আছে। মনে আছে রবার্তো কার্লোসের ক্রসও। কিন্তু মাঝমাঠ থেকে কার্লোসকে পাস বাড়ানো মানুষটার নাম হয়ত জানেন না রিয়ালেরই অনেক সমর্থক। ব্রাজিলিয়ান লেফটব্যাককে পাসটা বাড়িয়েছিলেন সোলারিই। ম্যাচ শেষে সতীর্থদের সাথে মেতেছেন ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হওয়ার উল্লাসে, আড়াল থেকেই।
রিয়ালের জার্সিতে যখন মাঠে নামতেন, তখন উন্মাদনাটা ছিল লুইস ফিগো, জিদান, রোনালদো লিমাদের নিয়ে। নীরবে নিভৃতে মাঝমাঠে নিজের কাজটা ঠিকই করে গেছেন। কোচ হয়ে গত কয়েক মাসেও এরকমই নিঃস্বার্থ ছিলেন তিনি। তার বিদায়ে হয়ত তেমন ক্ষতি হবে না রিয়ালের। পার্শ্বনায়কদের বিদায়ে কেই বা কখনও চোখের জল ফেলেছে। কিন্তু রিয়াল হারাল খুব সম্ভবত নিজেদের ইতিহাসের এক পার্শ্বনায়ককে, যিনি ক্লাবের স্বার্থকেই সবসময় গুরুত্ব দিয়েছেন আগে।