রিয়ালে দ্বিতীয় অধ্যায়ে জিদানের পাঁচ চ্যালেঞ্জ
চাকরি ছাড়ার বছরখানেক পার না হতেই রিয়াল মাদ্রিদের হটসিটে ফিরেছেন জিনেদিন জিদান। হুলেন লোপেতেগি এবং সান্তিয়াগো সোলারির ব্যর্থতায় বিবর্ণ রিয়ালের সুদিন ফেরাতেই আবারও জিদানের দ্বারস্থ হয়েছেন রিয়াল প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। জিদানের ফেরায় মাদ্রিদ সমর্থকেরা যেন ফিরে পেয়েছেন গলার জোর। ২০১৬ তে যখন প্রথমবারের মত দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তখন চ্যালেঞ্জ ছিল প্রচুর। দলটাকে একেবারে হাতের তালুর মত চিনলেও এবারও প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে জিদানকে। ফিরে আসা জিদানের নতুন চ্যালেঞ্জগুলো কী হতে পারে? আসুন জেনে নেওয়া যাক।
১. মূল তারকাদের স্বরূপে ফেরানো
২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত প্রায় অজেয় রিয়াল এবং ২০১৮-১৯ মৌসুমের 'অচেনা' রিয়াল। ফলাফলে আকাশপাতাল পার্থক্য থাকলেও তিন বছর আগে পরে রিয়ালের স্কোয়াডে পরিবর্তন নেই খুব একটা। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, আলভারো মোরাতারা বিদায় নিয়েছেন; কিন্তু এখনও আছেন সার্জিও রামোস, লুকা মদ্রিচদের মত তারকারা। জিদানের প্রথম দফায় তারা প্রত্যেকেই ছিলেন দুর্দান্ত। মৌসুমে রিয়ালের গড়পড়তার চেয়েও খারাপ পারফরম্যান্সের অন্যতম কারণ অবশ্যই রোনালদোর শূন্যস্থান পূরণ করতে না পারা। তবে রিয়ালের ভরাডুবির জন্য হয়ত সমানভাবেই দায়ী মদ্রিচ, রামোস, বেলদের ফর্মহীনতা। এই মৌসুমের রিয়ালের 'সিনিয়র'রা এতটাই বিবর্ণ, জার্সির পেছনে নামটা না থাকলে হয়ত চেনাও যেত না তাদের।
গত তিন মৌসুমে ইউরোপে রিয়ালের শ্রেষ্ঠত্বের পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন ক্রুস-মদ্রিচরাই। রিয়ালের অভিজ্ঞ ফুটবলাররাই এখন হারিয়ে খুঁজছেন নিজেদের। পায়ের শৈল্পিক ছোঁয়ায় মদ্রিচ, ক্রুসরা মাঝমাঠকে বানাতে পারছেন না তাদের ক্যানভাস। রক্ষণে ভুলের কড়া মাশুল গুণতে হচ্ছে রামোস, মার্সেলোদের। আক্রমণে রোনালদোর উত্তরসূরি ধরা বেল যেন গোলই করতে ভুলে গেছেন। ফলাফল? বার্সেলোনা তো বটেই, লেভান্তের মত দলগুলোর বিপক্ষেও খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে 'লস ব্লাঙ্কোস'দের। রিয়ালের হটসিটে প্রত্যাবর্তনের পর মদ্রিচদের ফর্মে ফেরানোই হয়ত জিদানের মূল চ্যালেঞ্জ।
২. ড্রেসিংরুমকে এক সুতোয় গাঁথা
রিয়ালের সাবেক কোচ কার্লো আনচেলত্তির সহকারী হিসেবেই সর্বোচ্চ পর্যায়ের ইউরোপিয়ান ফুটবলে 'অভিষেক' হয়েছিল জিদানের। আনচেলত্তির মতই 'ট্যাকটিক্যাল মাস্টারক্লাস'-এর চেয়ে 'ম্যান ম্যানেজমেন্ট'-ই জিদানের মূল অস্ত্র। দায়িত্ব যখন নিয়েছিলেন, তখন রিয়ালের ড্রেসিংরুমের অবস্থা তথৈবচ। ফলাফল আশানুরূপ নয়, রোনালদো-রামোসরা ফর্মে নেই, খেলোয়াড়দের সাথে তখনকার কোচ রাফা বেনিতেজের বিবাদ তো ছিলই। জিদান এসেই এক সুতোয় বাঁধলেন পুরো দলকে। তাঁর অধীনে রিয়াল যেন এক 'পরিবার'-এর পরিণত হল। ফিরে এল সংহতি। ড্রেসিংরুমের চনমনে আবহতে পরের ৩ বছর রিয়াল কেমন খেলেছে, জানা আছে সবারই।
দায়িত্বে ফেরার পর আবারও জিদানের জন্য অপেক্ষা করছে সেই একই চ্যালেঞ্জ। লোপেতেগি, সোলারির অধীনে ফলাফল ভাল না হওয়ায় খেলোয়াড়দের অনেকেই ভুগছেন মানসিকভাবে। দলের অন্যতম দুই খেলোয়াড় ইস্কো এবং মার্সেলো তো মৌসুমে ম্যাচই খেলেছন হাতেগোনা। আবার গুঞ্জন উঠেছে দীর্ঘদিনের সতীর্থ রামোস, মার্সেলোর মাঝে কথা কাটাকাটির। সব মিলিয়ে খুব একটা শান্তিতে নেই রিয়ালের স্কোয়াড। ২০১৬-এর মত এবারও জিদানের সামনে চ্যালেঞ্জ, ড্রেসিংরুমের কালো ঘনঘটা কাটিয়ে প্রশান্তিময় চনমনে পরিবেশ ফিরিয়ে আনা।
৩. আগামী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলা
কোপা ডেল রে, চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে রিয়াল ছিটকে গেছে আগেই। লা লিগার ১১ ম্যাচ বাকি থাকতে বার্সার চেয়ে পিছিয়ে আছে ১২ পয়েন্টে। লা লিগা জেতার স্বপ্ন আগেই বিসর্জন দিয়েছে রিয়াল। শিরোপাহীন মৌসুমে এখন রিয়ালের একমাত্র লক্ষ্য, শীর্ষ চারে থেকে আগামী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলা নিশ্চিত করা।
২৭ ম্যাচে ৫১ পয়েন্ট নিয়ে তিন-এ আছে রিয়াল। ৬ পয়েন্ট কম নিয়ে চার-এ গেটাফে। পাঁচ-এ থাকা আলাভেসের সাথে রিয়ালের পয়েন্টের ব্যবধান ১০। আপাতদৃষ্টিতে রিয়ালের শীর্ষ চারে থাকা নিশ্চিত মনে হলেও কাজটা যে সহজ হবে না, হয়ত সেটা জানেন জিদান নিজেও। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে লিগে খুব সম্ভবত নিজেদের সবচেয়ে বাজে মৌসুমই কাটাচ্ছে রিয়াল। যে টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বেশিবার জিতেছে তারা, যেখানে 'হ্যাটট্রিক' করেই কোচ হিসেবে জাত চিনিয়েছেন জিদান; রিয়ালের সেই চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলা নিয়েই আছে সংশয়। হতাশাজনক মৌসুমের একমাত্র লক্ষ্য নিশ্চয়ই হাতছাড়া করতে চাইবেন না 'জিজু'।
৪. 'হারানো' জৌলুস ফিরিয়ে আনা
একজন ফুটবলারের অনুপস্থিতি দলকে কীভাবে পঙ্গু করে দিতে পারে, সেটা জানতে রোনালদোহীন রিয়ালের অবস্থাই যথেষ্ট। 'সিআর৭'-এর বিদায়ের পর পেরেজের কোনও বিশ্বমানের ফরোয়ার্ড দলে না ভেড়ানোর সিদ্ধান্তে হয়েছে হিতে বিপরীত। গোলমুখে এখন রিয়ালকে চেনাই দায়। বেনজেমা ছাড়া কেউই নিজেদের মেলে ধরতে পারেননি। প্রতিপক্ষের জালে প্রতিনিয়তই ৩-৪ গোল করা রিয়াল এখন হিমশিম খাচ্ছে ১-২ গোল করতেই। জিদানের অধীনে স্কোয়াডের হারানো জৌলুস ফিরে পাওয়ার আশায় বুক বাঁধছেন সমর্থকেরা।
জিদানের ওপর সমর্থকদের এই আস্থা রাখার কারণ জিদান নিজেই। ২০১৫-১৬ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার পরই মোরাতা, আসেন্সিওদের দলে নিয়েছিলেন জিদান। বেনজেমার 'আন্ডারস্টাডি' হিসেবে মোরাতা ছিলেন দুর্দান্ত। কিন্তু এবার রিয়ালের 'স্কোয়াড ডেপথ' আক্ষরিক অর্থেই হতাশাজনক। জিদান নিজেও যে এই ব্যাপারে অবগত, তার প্রমাণ মিলেছে গত সপ্তাহেই।
এই মৌসুমে রক্ষণভাগের কারণে বেশ ভুগতে হয়েছে রিয়ালকে। নাচো ফার্নান্দেজ ছাড়া তেমন 'ব্যাক আপ' সেন্টারব্যাক ছিল না রিয়ালের। ফলাফল? জিদান আসার দুই দিনের মাথায় পোর্তোর ব্রাজিলিয়ান সেন্টারব্যাক এডার মিলিতাওকে দলে নিয়েছে রিয়াল। এখনই আগামী মৌসুমের জন্য দল সাজানো শুরু করে দিয়েছেন জিদান। শোনা যাচ্ছে এডেন হ্যাজার্ড, কিলিয়ান এম্বাপ্পেদের নামও। জিদানের অধীনে আগামী মৌসুমে এই দুজনের কাউকে রিয়ালের জার্সিতে দেখা গেলে অবাক হওয়ার অবকাশ থাকবে না খুব একটা।
৫. ঘরে বিড়াল, বাইরে বাঘ!
গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। রিয়ালের সাম্প্রতিক সময়ের অবস্থা বোঝাতে এর চেয়ে ভাল উপমা হয়ত পাওয়া যাবে না খুঁজে। টানা তিনবার ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হলেও লা লিগা এবং কোপা ডেল রে-তে রিয়ালের অবস্থা রীতিমত শোচনীয়। এই জিদানের অধীনেই ২০১৬-১৭ মৌসুমে স্প্যানিশ লিগ জিতেছিল রিয়াল, তাও ৫ বছর পর। মাঝে দুই বছর পেরিয়ে গেলেও লা লিগার শিরোপা আর ছুঁয়ে দেখা হয়নি তাদের। আনচলেত্তির অধীনে ২০১৩-১৪ মৌসুমের পর আর কোপা ডেল রে-ও জেতা হয়নি রিয়ালের। ইউরোপে নিজেদের প্রমাণ করলেও স্পেনে রিয়ালের পারফরম্যান্স একেবারেই হতাশাজনক।
রিয়াল যেখানে বিবর্ণ, বার্সা সেখানে দুর্দান্ত। লা লিগা এবং কোপা ডেল রে-তে এখন একচ্ছত্র আধিপত্য এর্নেস্তো ভালভার্দের দলের। কোচ হয়ে আসার বছরখানেকের মাথায়ই রিয়ালের লা লিগা গেরো কাটিয়েছিলেন জিদান। কোপা ডেল রে অবশ্য জেতা হয়নি এখনও। গত তিন মৌসুমে জিদানের দলের চ্যাম্পিয়নস লিগের পারফরম্যান্সটাই আগামী মৌসুম থেকে লা লিগাতেও দেখতে চাইবে সমর্থকেরা।