৯৯ ফেরাতে পারবেন অলরাউন্ডাররা?
ব্যাটে বা বলে একাই একজন পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন বেশির ভাগ ম্যাচে, বিশ্বকাপে এমন কার কথা মনে করতে পারেন?
খুব একটা ভাবতেও হবে না হয়তো আপনাকে। নব্বই দশকে যাদের জন্ম, তাদের শতকরা ৯০ ভাগের উত্তরও মিলে যাওয়ার কথা। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ল্যান্স ক্লুজনার যা করেছিলেন, বিশ্বকাপের কোনো আসরে সেরকম অলরাউন্ডার পারফরম্যান্স আগে পরে কেউই করতে পারেননি। সেই বিশ্বকাপ কোথায় হয়েছিল মনে আছে? ২০ বছর পর যখন আবার ক্রিকেটের আঁতুড়ঘরে ফিরছে বিশ্বকাপ, এবার কি তার কাছাকাছি কিছুও কেউ ব্যাটে-বলে করতে পারবেন?
বিশ্বকাপ অলরাউন্ডারা জেতায়, কথাটা অবশ্য বলা কঠিন। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের কথাই ধরুন, শিরোপাটা ক্লুজনারের হাতেই দেখতে পাচ্ছিলেন অনেকে। কিন্তু নিয়তির খেয়ালে জুলু নিজেই তা হাত থেকে ফেলে দিয়েছেন। ক্লুজনারের ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেছেন, নইলে সেবার ব্যাটে-বলে আরও একজন ছিলেন দুর্দান্ত। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের নিল জনসন যা করেছেন, সেটাও ভুলে যাওয়ার উপায় নেই। ওপেনিং বোলিং আর ব্যাটিং দুই-ই করতেন, দুই জায়গাতেই সেবার রেখেছিলেন বড় অবদান।
পরিসংখ্যানও বলছে, বিশ্বকাপের সেরা অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে শুরুর দিকে দুজনের নাম থাকছে। সেখানে আবার ক্লুজনারের ধারেকাছে কেউই নেই। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ৯ ম্যাচে ক্লুজনার করেছিলেন ২৮২ রান। গড়টা অবিশ্বাস্য, ১৪০.৫০। উইকেট নিয়েছিলেন ১৭টি, গড় ২০.৫৮। ব্যাটিং আর বোলিং গড়ের পার্থক্য ১১৯.৯১।
অন্তত ২০০ রান করেছেন আর ১০ উইকেট নিয়েছেন, বিশ্বকাপে এমন কীর্তি আছে সাতজনের। এর মধ্যে ক্লুজনারের সঙ্গে জনসন আছেন অবশ্যই। ওপেন করতেন বলে জনসনের রান ছিল ৩৬৭, এই ছোট্ট তালিকায় সবচেয়ে বেশি। গড়টা ক্লুজনারের মতো না হলেও দুর্দান্ত, ৫২.৪২। সেই বিশ্বকাপে ১৯.৪১ গড়ে ১২টি উইকেটও নিয়েছিলেন এই জিম্বাবুইয়ান। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার অকালে থমকে যাওয়ায় সেই বিশ্বকাপই হয়ে ছিল তাঁর প্রতিভার সবচেয়ে বড় স্বাক্ষর।
একটু অদ্ভুতই বটে, সাতজনের এই তালিকায় ক্রিকেটের স্বীকৃত সেরা অলরাউন্ডারদের বেশির ভাগই নেই। বিগ ফোরের মধ্যে আছেন শুধু কপিল দেব। ১৯৮৩ বিশ্বকাপে ভারতের অধিনায়ক ৩০৩ রানের পাশাপাশি নিয়েছিলেন ১২ উইকেট। এর মধ্যে এক ম্যাচে খেলেছিলেন ১৭৫ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংস। সেবার অবশ্য মহিন্দর অমরনাথ নামের আরেক অলরাউন্ডার সেমিফাইনাল ও ফাইনালটা নিজের করে নিয়েছিলেন।
এই সাতজনের মধ্যে ক্লুজনার ছাড়া ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট আরেকজনই আছেন। যুবরাজ সিং ২০১১ সালে ভারতের ২৮ বছরের শিরোপাখরা ঘোঁচানোর অন্যতম নায়কই ছিলেন। ২০১১ বিশ্বকাপে ৩৬২ রানের পাশাপাশি নিয়েছিলেন ১৫ উইকেট। এক বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি আর ৫ উইকেট কপিল ছাড়া আছে শুধু তাঁরই। তার চেয়েও বড় কথা, ১৯৮৩ ও ২০১১- ভারতের দুই বিশ্বকাপ জয়েই বড় ভূমিকা ছিল অলরাউন্ডারদের। হার্দিক পান্ডিয়া , বিজয় শংকর, কেদার যাদবরা কি শুনতে পাচ্ছেন?
গত বিশ্বকাপে যেমন কোরি অ্যান্ডারসনের কথা আলাদা করে মনে রাখার কথা অনেকের। কিউই অলরাউন্ডারের বড় ভূমিকা ছিল নিউজিল্যান্ডকে প্রথমবারের মতো ফাইনালে তোলায়। ২৩১ রানের পাশাপাশি নিয়েছিলেন ১৪টি উইকেট, পরে চোট অবশ্য তাঁকে পূর্বসূরি হ্যাডলির গ্রেটনেস পেতে দেয়নি। এক বিশ্বকাপে অন্তত ২০০ রান আর কমপক্ষে ১০ উইকেট আছে সনাৎ জয়াসুরিয়ারও। তবে এখানে একটা নাম বিস্ময়ই জাগাবে। ২০০৩ বিশ্বকাপে কানাডার জন ডেভিসন ব্যাটে-বলে চমকে দিয়েছিলেন অনেককে। ২১১ রানের পাশাপাশি নিয়েছিলেন ১০ উইকেট, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলেছিলেন ৭৬ বলে ১১১ রানের একটা ইনিংস।
১৯৯৯ বিশ্বকাপে বলার মতো অলরাউন্ড পারফরম্যান্স অবশ্য ছিল আরও দুজনের। পাকিস্তানের আবদুল রাজ্জাক (১৭০ রান ও ১৩ উইকেট) ও নিউজিল্যান্ড ক্রিস কেয়ার্ন্স (১৮২ রান ও ১২ উইকেট) নিজেদের সময়ের তো বটেই, সর্বকালেরই সেরা ওয়ানডে অলরাউন্ডারদের তালিকায় থাকবেন। সেই বিশ্বকাপে পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের সাফল্যে দুজনের ছিল বলার মতো ভূমিকা। ইংল্যান্ডে সর্বশেষ বিশ্বকাপে অলরাউন্ডারদের জয়জয়কার ছিলই সেটা অবশ্য দিব্যি দিয়ে বলা যাচ্ছে না। তিন সেমিফাইনালিস্ট দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান,নিউজিল্যান্ডে একজন করে অলরাউন্ডার থাকলেও চ্যাম্পিয়নস অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল স্পেশালিস্ট বোলার-ব্যাটসম্যানদের দিয়েই।
এই বিশ্বকাপটা তাহলে কে ব্যাটে-বলে স্মরণীয় করে রাখবেন? জেনুইন অলরাউন্ডার ধরলে সেই তালিকা খুব বড় নয়। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে কাল পর্যন্ত ওয়ানডেতে অন্তত ১০০০ রান করেছেন ও ৫০ উইকেট নিয়েছেন এমন আছেন পাঁচজন। জেসন হোল্ডার, মোহাম্মদ নবী, সাকিব আল হাসান, সিকান্দার রাজা ও থিসারা পেরেরা। ব্যাটিং আর বোলিং গড়ের পার্থক্যকে যদি শ্রেষ্ঠত্বের সূচক ধরা হয়, এখানে সাকিব সবচেয়ে এগিয়ে (ব্যাটিং গড় ৩৮.৬, বোলিং গড় ৩৫.২২; পার্থক্য ৩.৩৭)। এই সময়ে ১৫৪৪ রানের পাশাপাশি সাকিব নিয়েছেন ৫৯ উইকেট। আবার একই সময়ে ইংল্যান্ডের বেন স্টোকসের রান ও গড় সাকিবের চেয়ে বেশি হলেও বোলিং গড় (৪৫.৬) আবার বেশ খারাপ, উইকেটও পেয়েছেন ৪৩টি। সাকিবের সবচেয়ে কাছাকাছি আছেন মোহাম্মদ নবী। আফগান এই অলরাউন্ডারের রান (১৪৩৩) সাকিবের চেয়ে কম হলেও উইকেট বেশি (৭৩টি)। ব্যাটিং গড় (২৯.২৪) আর বোলিং গড়ের (২৭.২৯) পার্থক্যও (২.০৫) সাকিবের কাছাকাছি। আবার এই সময়ে এই পাঁচজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উইকেট হোল্ডারের(৭৫টি), রান অবশ্য অনেক কম (১২৫৭)।
এঁদের বাইরেও অলরাউন্ডার আছেন আরও বেশ কজন; রাসেল, পান্ডিয়া, স্টোয়নিসরা টুর্নামেন্ট নিজের করে নিতেই পারেন। বা হতে পারেন অন্য কেউ। ২০ বছর আগের যদি পুনরাবৃত্তি হয়, এবারের বিশ্বকাপ অলরাউন্ডারদের তো হতেই পারে!