ভ্যালেন্সিয়ার কাছে হেরে ৫ বছর পর কোপার শিরোপা হারাল বার্সা
ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজতেই ভ্যালেন্সিয়া খেলোয়াড়রা দৌড়ে গিয়ে মাঠে ঢুকেছেন, শিরোপা জয়ের উৎসবে মেতেছেন পাগলাটে দৌড়ে। ম্যানেজার মার্সেলিনো গার্সিয়া কোলে চড়ে উঠেছেন কনডগবিয়ার। যেন বিশ্বজয়ের আনন্দে মেতেছে ভ্যালেন্সিয়া। উলটোটা হলে অবশ্য এমন দৃশ্য দেখার সম্ভাবনা কম ছিল। বার্সেলোনা একরকম নিয়ম বানিয়ে ফেলেছিল কোপা ডেল রের শিরোপা জেতা। চ্যাম্পিয়নস লিগের হতাশায় সব ঢাকা পড়ে যখন এর চেয়ে খারাপ কিছু আর হতে পারে না বলে রব উঠেছিল বার্সায়, তখন ঘটলো আরও খারাপটাই। কোপার ফাইনালে ভ্যালেন্সিয়ার কাছে ২-১ গোলে হারলো এর্নেস্তো ভালভার্দের দল। টানা পঞ্চম শিরোপাটা তাই তোলা হয়নি বার্সার, ট্রেবলের কমে আসা ডাবলও পূরণ হয়নি। তার চেয়েও বড় কথা, এই ম্যাচের পর চাকরিটাও ঝুলে গেল ভালভার্দের।
লিওনেল মেসি ম্যাচের আগেরদিন সতর্ক করে গিয়েছিলেন দলকে, এই ম্যাচ হারলে অবস্থা হবে আরও খারাপ। সেটাই হলো দিনশেষে। বার্সা সতর্ক বার্তায় কান দেয়নি সেটা বোঝা গেল প্রথমার্ধের খেলাতেই। স্টাডিও ভিয়া মারিনে শুরু থেকেই ভ্যালেন্সিয়ার চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা, ইউ শ্যাল নট পাস। বার্সার পায়ে বল, ভ্যালেন্সিয়ার অর্ধে প্রায় সবাই। কিন্তু রক্ষণের ফাঁক গলে বেরুনোর সুযোগ নেই মেসিদের। প্রথম ২০ মিনিটে একবার মাত্র আক্রমণে উঠেছিল ভ্যালেন্সিয়া। কিন্তু সেখান থেকেও শিক্ষা নেয়নি বার্সা। লং বল ক্লিয়ার করতে ভুল করেছিলেন ক্লেমেন্ত ল্যাংলেট। সেখান থেকে রদ্রিগো মরেনো গোলরক্ষক জ্যাস্পার সিলেসেনকে কাটিয়ে চলে গেলেন ফাঁকা বারের সামনে। শট করলেন, কিন্তু সুপারম্যানের মতো জেরার্ড পিকে এসে বল ক্লিয়ার করে ফেললেন গোললাইন থেকে। ম্যাচশেষে পিকেও মনে রাখবেন না সে কথা, মনে রাখবেন না রদ্রিগোও।
২১ মিনিটে সেই লং বল আবার টোটকা ভ্যালেন্সিয়ার। তাতে বিবশ বার্সা। গ্যাব্রিয়েল পাউলিস্তার নিজের অর্ধ থেকে পাঠানো লং বল ডিবক্সের বাম দিয়ে রিসিভ করেছিলেন হোসে গায়া। এরপর ডিবক্সের ঠিক সামনে করলেন ক্রস। কেভিন গ্যামেইরো বল পেলেন, সামনে থাকা জর্দি আলবাকে ফাঁকি দিলেন। এরপর ডান পায়ের শটে বল জড়ালেন জালে। ভ্যালেন্সিয়া এগিয়ে গেল এক গোলে।
কিন্তু বার্সার দুর্দশা থামলো না তাতেও। এবার ভুল করলেন জর্দি আলবা। কার্লস সলারের সঙ্গে বামপ্রান্তে বল দখলের লড়াইয়ে গতিতে হার মানলেন। সলার ক্রস করলেন সিক্স ইয়ার্ড বক্সের ভেতর, গোলের মাঝামাঝি জায়গায়। রদ্রিগোর সামনে পিকে ছিলেন, কিন্তু তিনি এবার নাগালই পেলেন না। ওপরে লাফিয়ে উঠে হেডে ফাঁকা বারে রদ্রিগো করলেন আরেক গোল। মাঝের কুলিং ব্রেক ধরে ম্যাচের বয়স ৩৩ মিনিট, ভ্যালেন্সিয়া দুই, বার্সা শূন্য।
রক্ষণ তো ছিলই, ঝামেলা ছিল গোল কিপিংয়েও। জ্যাস্পার সিলেসেন পুরোটা সময়ই ধুঁকেছেন। সাবলীল ছিলেন না মোটেই, বড় ধরনের ভুলও করে বসতে পারতেন। মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগান সুস্থ্য থাকলেও হয়ত ম্যাচটা খেলতেন বার্সার দ্বিতীয় পছন্দের গোলরক্ষকই। এমন ম্যাচে তার কাছ থেকে আরেকটু সাহায্য আশা করেছিল বার্সা। লুইস সুয়ারেজ ছিলেন না ইনজুরির কারণে। ফিলিপ কৌতিনহো নেমেছিলেন একাদশে। কিন্তু বার্সার আক্রমণ পুরোপুরি মেসিনির্ভর। স্ট্রাইকার ছাড়া খেলতে নামাটা কাজে আসেনি বার্সার। তারওপর ভ্যালেন্সিয়া গোলরক্ষক জাউমি ছিলেন দুর্দান্ত। প্রথমার্ধ শেষের আগে দুইবার দারুণ দুইটি সেভে বার্সাকে ফিরিয়েছিলেন তিনি। প্রথমবার ইভান রাকিটিচকে, পরেরবার মেসিকে। এছাড়া অসাড় ছিল বার্সার সব আক্রমণ।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই তাই ভালভার্দের দুই বদলি। নেলসন সেমেদোর জায়গায় ম্যালকম, আর আর্থারের জায়গায় আর্তুরো ভিদাল। তাতে ধারও বাড়ল বার্সার আক্রমণে। কিন্তু এসব কিছুই যেন জানা ছিল গ্যারায়, পাউলিস্তাদের। রক্ষণে তাই দ্বিগুণ মনোযোগী হয়ে ভ্যালেন্সিয়া কেবল হতাশ করে গেল বার্সাকে। তবে বড় হতাশাটা বার্সাকে পেয়ে বসল ৫৫ মিনিটে। ডিবক্সের ভেতর বাম দিক থেকে কাটিয়ে আউট সাইড অফ দ্য ফুট মেরে কোণাকুণি যে শটটা মেসি করেছিলেন সেটা ক্রসবারে না লাগলে ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা গোল হয়ে যেত পারত তার। বারে লেগে আবার সেটা ভিদালের কাছেই ফেরত গিয়েছিল। কিন্তু গোলের সামনে থেকে ভিদাল সুযোগ কাজে লাগাতে পারলেন না, মারলেন অনেক ওপর দিয়ে।
দ্বিতীয়ার্ধে বেশিরভাগ সময়ই জেরার্ড পিকে খেলেছেন স্ট্রাইকার হিসেবে। তিনিও দারুণ একটি সুযোগ পেলেন এরপর, ম্যালকমের ক্রস থেকে। কিন্তু দিনশেষে যে তিনি ডিফেন্ডারই সেটা মনে করিয়ে দিলেন ফিনিশে। স্পটকিক নেওয়ার কাছাকাছি জায়গা থেকে বল মারলেন বাইরে দিয়ে। এরপর অবশ্য ভাগ্য খুলল বার্সার, ৭৩ মিনিটে কর্নার থেকে। ল্যাংলেটের হেড জাউমি আরেকবার ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু এবার মেসি পেলেন একেবারে জায়গা মতো। ফাঁকা বারে গোল করে এরপর খানিকটা স্বপ্ন দেখালেন সেই মেসিই।
কিন্তু স্বপ্ন আর পূরণ করতে পারলেন না। বাকিটা সময় আক্রমণের জোয়ারেও ভ্যালেন্সিয়াকে আর ভাসিয়ে নিতে পারেনি বার্সা। নিখুঁত ডিফেন্সে শেষ পর্যন্ত মাথা ঠান্ডা রাখা ভ্যালেন্সিয়া জয়ের ব্যবধানটাও বাড়িয়ে নিতে পারত। গন্সালো গুইদেস দুইবার ফাঁকা বারেও গোল করতে পারেননি ইনজুরি সময়ে।
এসব নিয়ে অবশ্য কোনো আফসোস করতে হয়নি ভ্যালেন্সিয়াকে। অধিনায়ক দানি পারেহোকেও যেমনটা করতে হলো না ম্যাচশেষে। ইনজুরি পড়ে দ্বিতীয়ার্ধে কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছেড়েছিলেন পারেহো। কিন্তু শেষে শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছেন তিনিই। ২০ বছর পর জেতা কোপা ডেল রের শিরোপা!
ফাইনালে হারের পর তাই এবার একটি শিরোপা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে বার্সাকে। গতবার কোপা ডেল রের ফাইনালের আগেও গুঞ্জন রটেছিল ডাবল জিততে না পারলে বরখাস্ত হবেন ভালভার্দে। এবারও বাতাসে ভাসছে গুজব। গতবার এরপর ফাইনালে দারুণ এক পারফরম্যান্সে সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়েছিল ভালভার্দের দল। এবার লিভারপুলের কাছে হারের সেই বৃত্ত থেকে থেকে বার্সা এখনও ঘোরাফেরা করছে সেটা বোঝা গেছে তাদের খেলা দেখেও। মেসি বা বোর্ডের যতই সমর্থন থাকুক, তারাও এবার বেঁকে বসবেন না তো?