কার্ডিফের সব ফিরিয়ে নেওয়া ঠেকাতে পারলেন না সাকিবও
ইংল্যান্ড ৫০ ওভারে ৩৮৬/৬ (রয় ১৫৩, বাটলার ৬৪, বেইরস্টো ৬১; মিরাজ ২/৬৭, সাইফ উদ্দিন ২/৭৮)
বাংলাদেশ ৪৮.৩ ওভারে ২৮০ (সাকিব ১২১, মুশফিক ৪৪, মাহমুদউল্লাহ ২৮, মোসাদ্দেক ২৬; স্টোকস ৩/২৩, আর্চার ৩/২৯)
ফল: ইংল্যান্ড ১০৬ রানে জয়ী
এই কার্ডিফ বাংলাদেশকে দুহাত ভরেই দিয়েছে আগে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্বকাপের ম্যাচ মানে গত দুবার অন্তত দারুণ সুখস্মৃতি। কে জানত সেই ইংল্যান্ডই আরেকবার কার্ডিফে সবকিছু ফিরিয়ে নেবে এভাবে? যে ম্যাচে এক ইনিংসের পরেই আসলে ম্যাচের ফল ঠিক হয়ে যায়, সেখানে আসলে ম্যাচের বর্ণনা দেওয়াটাও আদিখ্যেতা হয়ে যায়।
একজনের জন্য সেটা করা গেল না। সাকিব আল হাসান এই বিশ্বকাপে যে অন্যরকম একটা প্রতিজ্ঞা নিয়ে নেমেছিলেন, সেটা বোঝা যাচ্ছিল এবারের প্রথম বল থেকেই। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দলকে জিতিয়ে বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ম্যাচসেরা হয়েছিলেন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আবারও ফিফটির সঙ্গে দুই উইকেট, এবার পারলেন না জেতাতে। ইংল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করতে পারল না, অথচ সেখানেও বাংলাদেশের প্রায় পুরোটাই সাকিবময়। উইকেট না পেলেও বিশ্বকাপে নিজের প্রথম সেঞ্চুরিতে রাঙিয়ে দিয়েছেন দিনটা।
বোলিংয়ের কথাই ধরুন। দুই দিন বৃষ্টির পর সকালের উইকেটে বল নিয়েও মাশরাফি ভরসা করলেন সাকিবের ওপর। ক্রিজে যে দুই ডানহাতি ব্যাটসম্যান বেইরস্টো আর জেসন রয়। সাকিব সম্ভাব্য সবভাবেই প্রলুব্ধ করান চেষ্টা করলেন, কিন্তু লাভ হলো না। সাকিবের ফাঁদ এড়িয়ে বাকিদের শিকার করে গেছেন দুই ওপেনার। রয়ের কথাটাই বলতে হবে আলাদা করে, যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই খেলতে পেরেছেন আজ। শুরুতে সাকিবকে সমীহ করলেও পরে তাকেও ছাড়েননি, এক ওভারে নিয়েছেন ১৮ রান। ৩৮ বলে পেয়েছেন ফিফটি, সেঞ্চুরি করেছেন ৯২ বলে। এরপর আরও বেশি রুদ্রমূর্তি হয়ে উঠেছিলেন, মিরাজকে এক ওভারে তিন ছয় মেরে ভয়ংকর কিছুর আভাস দিচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত মিরাজ আউট করেছেন ঠিকই, তবে তাতে বাংলাদেশের তৃপ্তির চেয়ে অনেক বেশি ছিল স্বস্তি।
ইংল্যান্ড যে বড় কিছু করবে, তার ভিতটাও গড়ে দিয়েছিলেন দুই ওপেনার। কিন্তু বাংলাদেশও বোলিং আর ফিল্ডিংয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে দুহাত ভরে। ক্যাচ সেভাবে মিস হয়নি বটে, তবে এমন বাজে গ্রাউন্ড ফিল্ডিং শেষ কবে করেছে সেটা ভেবে আপনি জেরবার হতে পারেন। অন্তত ২০ রান এসেছে শুধু মিসফিল্ডিং থেকেই, আর গা ছাড়া ফিল্ডিংয়ে অনেক সিঙ্গেলস হয়ে গেছে ডাবলস। মাশরাফি মাঝের স্পেল থেকে একটু ছন্দে ফিরেছিলেন, একটি উইকেটও পেয়েছিলেন। শেষ স্পেলে আবার খেই হারিয়ে ফেলেছেন। আর সাইফ উদ্দিনের শুরুটাই হয়েছিল দুঃস্বপ্নের মতো, প্রথম ৩ ওভারেই রান দিয়েছেন ত্রিশের বেশি। শেষের দিকে একটু ভালো করেও ইকোনমি আটের নিচে রাখতে পারেননি। মোস্তাফিজও লাইন লেংথ হারিয়ে খুঁজেছেন, এই বছর আরও একবার ছিলেন ভীষণ খরুচে।
তবে এটাও মানতে হবে, ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরাও বাংলাদেশকে আরো নির্বিষ মনে করিয়েছেন। জেসন রয় ১২১ বলে ১৫৩ রান করে আউট হয়েছেন শেষ পর্যন্ত, কিন্তু ব্যাটনটা দিয়ে গেছেন বাটলার-মরগানদের হাতে। এই দুজন মিলে ৯৫ রান যোগ করেছেন ৬৪ বলে। বাটলারকে ৬৪ রানে ফিরিয়ে একটু ধাক্কা দিয়েছিলেন সাইফ উদ্দিন। এরপর দ্রুত ফিরে গেছেন মরগান ও স্টোকসও। কিন্তু প্লাংকেট ও ওকস মিলে ইংল্যান্ডের লোয়ার অর্ডারের শক্তিটা জানান দিয়েছেন আরও একবার। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সপ্তম সর্বোচ্চ রানও হয়ে গেছে তাই। শেষ পর্যন্ত ইকোনমি আর উইকেট সংখ্যা মিলে মিরাজই ছিলেন বাংলাদেশের সফলতম বোলার। ও, সঙ্গে একটি দারুণ ক্যাচও নিয়েছেন।
বিশ্বকাপের ইতিহাসে ৩২৯ রানের বেশি তাড়া করেই কেউ কখনো জেতেনি। আর বাংলাদেশের তো তিনশর বেশি তাড়া করেই জয়ের কীর্তি আছে হাতেগোণা কয়েকবার। কদিন আগেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে করা নিজেদের ৩৩০ রানের রেকর্ড ছাড়িয়েও অনেকদূর চলে যেতে হতো। সেজন্য যেরকম শুরু দরকার ছিল, হয়নি সেটাও। সৌম্য সরকার ছন্দেই ছিলেন, তবে জফরা আর্চারের এক্সপ্রেস ডেলিভারিটা তাঁর অফ স্টাম্পের বেল নিয়ে সোজা সীমানার ওই পারে চলে গেলো।
তামিম ইকবালের কাছ থেকে আশা ছিল অনেক। ম্যাচ জেতানোর মতো কিছু না হোক, অন্তত রানের ফেরার জন্যও। কিন্তু সেটাও হলো না, ২৯ বলে ১৯ রানের ইনিংসটা শেষ হলো বাজে এক শটে আউট হয়েও। আবার ক্রিজে সাকিব-মুশফিক, বাংলাদেশকে অন্তত ভালো একটা স্কোর এনে দেওয়ার ভরসাও ছিল তাদের ওপর। সাকিব-মুশফিক ঠিক করলেন, স্বপ্নটা আরেকটু বড় করবেন।
সাকিব অবশ্য এর মধ্যেই শুরুটা করে ফেলেছেন। শুরুতে আর্চার বেশ ভোগালেও তাঁকে পুল করে মেরেছেন ছয়। মুশফিকের সঙ্গে জুটিতে রানও উঠছিল তরতর করে। এমনকি ওভারপ্রতি ছয়ের কাছাকাছিও চলে যাচ্ছিলেন। দুজনের জুটিতে ১০০ হলো, এর পরেই মুশফিক প্লাংকেটের বলে আউট হয়ে গেলেন। মিঠুনও কুৎসিত এক শটে কোনো রান না করেই ফিরলেন, পরের ম্যাচের জন্য নিজের দাবিটা আরও নড়বড়ে করে গেলেন।
তবে মাহমুদউল্লাহকে একপাশে রেখে সাকিব শুরু করলেন লড়াই। ফিফটি তাঁর অনেক আগেই পেয়ে গেছেন, ছিল সেঞ্চুরির অপেক্ষা। ৯৫ বলে এলো সেটিও। বিশ্বকাপে সাকিবের যা প্রথম, আর মাহমুদউল্লাহর পর প্রথম করলেন কেউ। সাকিবের উদযাপনে অবশ্য কোনো ভাবাবেগ নেই, হেলমেট পর্যন্ত খুললেন না। ওকসকে এক ওভারে তিন চার মারলেন। বাংলাদেশের নিভে যাওয়া প্রদীপটা যেভাবে হোক যেন জ্বালিয়ে রাখবেনই। কিন্তু একা কি আর পাহাড় টপকানো হয়? ১১৯ বলে ১২১ রান করে আউট হয়ে গেলেন শেষ পর্যন্ত। এরপর বাংলাদেশের ইনিংসে শুধু মোসাদ্দেকের ১৪ বলে ২৬ রানটা যা একটু বলার মতো। বাকিরা শুধু হারের প্রহরটা দীর্ঘায়িতই করেছেন।
আর সব ফিরিয়ে নেওয়ার দিন কার্ডিফ বাংলাদেশের সামনে রেখে গেছে অনেক প্রশ্ন।