সবাই মিলে এভারেস্টে চড়লো ভারত, অস্ট্রেলিয়া গড়তে পারলো না বেসক্যাম্পই
১৪তম ম্যাচ, ওভাল
ভারত ৩৫২/৫, ৫০ ওভার (ধাওয়ান ১১৭, কোহলি ৮২, রোহিত ৫৭, পান্ডিয়া ৪৮, স্টোইনিস ২/৬২)
অস্ট্রেলিয়া ৩১৬ অল-আউট, ৫০ ওভার (স্মিথ ৬৯, ক্যারি ৫৫*, ওয়ার্নার ৫৬, ভুবনেশ্বর ৩/৫০, বুমরাহ ৩/৬১)
ভারত ৩৬ রানে জয়ী
একটা মাইক্রোস্কোপ হাতে নিতে পারেন। এরপর বসতে পারেন ওভালে ভারতের এমন পারফরম্যান্সের পর তাদের ‘দুর্বলতা’ খুঁজতে। আপনার জন্য সেটা হবে বিশাল এক চ্যালেঞ্জ।
সন্দেহ নেই, দুই দলের গায়েই বিশ্বকাপের ‘ফেভারিট’ তকমা আছে। সন্দেহ নেই, ভারতকে অস্ট্রেলিয়া দারুণ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়বে বলেই ধারণা ছিল অনেকের। এই ভারতের সঙ্গে ২-০তে পিছিয়ে থেকেও সিরিজ জিতেই তো অস্ট্রেলিয়া দিয়েছিল বিশ্বকাপের আগমনী বার্তা। তবে ওভালে প্রায় প্রতিটি বিভাগে অস্ট্রেলিয়াকে ছাড়িয়ে গেল ভারত। সমন্বিত পারফরম্যান্সে ভারত গড়লো রানের এভারেস্ট, অস্ট্রেলিয়া গড়তে পারলো না বেসক্যাম্পটাই। ভারতের হয়ে রান পেয়েছেন ব্যাটিংয়ে যারা সুযোগ পেয়েছেন তাদের সবাই, ভূমিকা রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে আলাদা করা যাচ্ছে ধাওয়ানকে, আরেকটি সেঞ্চুরি পেয়েছেন বলেই হয়তো। বোলিংয়ে বুমরাহ ও ভুবনেশ্বর নিয়েছেন ৩টি করে উইকেট, দুই রিস্টস্পিনার মাঝের ওভারগুলিতে হাত খুলে খেলতে দেননি অস্ট্রেলিয়ানদের। সঙ্গে ছিল দুর্দান্ত ফিল্ডিং। এই ভারতের দুর্বলতা আদতে কোথায়?
টসে জিতলে দুই অধিনায়কই নিতে চেয়েছিলেন ব্যাটিং, সেটার সুযোগ পেলেন কোহলি। অস্ট্রেলিয়ান পেসাররা টলাতে পারলেন না ভারতের ব্যাটিংয়ের বেসক্যাম্প, স্পিন নামের বিষয়টাতে জাম্পা বা ম্যাক্সওয়েল তুলতে পারলেন না পাশ মার্কও। শিখর ধাওয়ানের সেঞ্চুরি, বিরাট কোহলির ‘সাপোর্টিং রোল’-এর ইনিংসের পর পান্ডিয়া-ধোনির ক্যামিওতে ভারত গড়েছে বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে যে কোনও দলের সর্বোচ্চ স্কোর। এরপর রানতাড়ায় অ্যারন ফিঞ্চ, স্টিভ স্মিথ, উসমান খাওয়াজারা থিতু হলেও শেষ করতে পারেননি, ভুগতে থাকা ডেভিড ওয়ার্নার বেশ অনেক্ষণ ক্রিজে থাকলেও করতে পারেননি তার দায়মোচন।
উইকেট ব্যাটিং-সহায়ক ছিল, তবে সেখানে থাকতে হয়েছে কৌশলী হয়েই। শিখর ধাওয়ান-রোহিত শর্মা শুরুতে ছিলেন বেশ সতর্ক, তবে সে চাপটা উইকেটে রুপান্তর করতে পারেননি অস্ট্রেলিয়ান পেসাররা। প্রথম ১০ ওভারে ৪১ রান উঠেছিল মাত্র, ১২তম ওভারে অ্যাডাম জাম্পাকে দুই চারে আক্রমণটা শুরু করেছিলেন দুই ভারত ওপেনার।
অস্ট্রেলিয়ার বোলিংয়ে বেশ একটা দুর্বল দিক ছিল অ্যাডাম জাম্পার বোলিং। তার আগেই ম্যাক্সওয়েলকে এনেছিলেন ফিঞ্চ, তবে দুজন মিলে ১৩ ওভারে ৯৫ রান দিয়ে থেকেছেন উইকেটশূন্য। প্রথম ড্রিংকস ব্রেকের পর রোহিতের ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট, কোল্টার-নাইলকে একটা ছয় মেরেছিলেন তিনি সে ওভারে। এরপর ৬১ বলে গিয়ে পূর্ণ করেছেন ফিফটি। ২৩তম ওভারে গিয়ে পরপর দুটি ডট বলের চাপ ফিরিয়েছে রোহিতকে, কোল্টার-নাইলের অফস্টাম্পের বাইরের বলটা থার্ডম্যানে খেলতে গিয়ে এজড হয়েছিলেন তিনি। ডানদিকে ঝাঁপিয়ে ভাল ক্যাচ নিয়েছিলেন ক্যারি, তবে তার একটা মিস পরে অস্ট্রেলিয়াকে ভুগিয়েছে বেশ।
রোহিত-ধাওয়ানের জুটি ভারতকে দিয়েছিল ভাল একটা ভিত। বিরাট কোহলি অবশ্য ধাওয়ানের সঙ্গে জুটি থাকলেন সাপোর্টিং রোলেই। দুজনের ৯৩ রানের জুটিতে কোহলি চার মেরেছেন মাত্র তিনটি। ধাওয়ান ফিফটি করেছিলেন ৫৩ বলে, শুরুতে আঙুলে আঘাত পেলেও সে ব্যথা ভুলে উলটো অস্ট্রেলিয়াকে ভুগিয়েছেন বেশ, পরে যে চোটের কারণেই নামেননি ফিল্ডিংয়ে। শুরুতে বেশ আগবাড়িয়ে খেলছিলেন, আঘাত পাওয়ার পর থেকে চলে গেছেন পেছনে। খেলা শুরু করেছেন বেশ লেট করে, ওভালের খুব দ্রুত নয় এমন উইকেটে অস্ট্রেলিয়ান পেসাররাও হিমশিম খেয়েছেন ধাওয়ানের সেই টেকনিককে চ্যালেঞ্জ জানাতে।
৯৫ বলে গিয়ে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেছেন ধাওয়ান, সিঙ্গেল নিতে গিয়ে কোহলির সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝি হয়ে গিয়েছিল অবশ্য। উদযাপনটাও একটু বিলম্বিত হয়েছিল। তবে আইসিসি টুর্নামেন্টের সঙ্গে তার প্রেমকাহিনীর গল্পটা লম্বা হলো আরেকটু। বিশ্বকাপ, আইসিসি টুর্নামেন্ট, ইংল্যান্ডে ও ওভালে ধাওয়ানের গড় এখন যথাক্রমে ৬৬.৫০, ৭২.৫২, ৮২.১০ ও ১৪৬। ১০৯ বলে ১১৭ রান করে স্টার্কের বলে ডিপ মিডউইকেটে ক্যাচ দিয়ে থেমেছেন অবশেষে।
৩৭ ওভার, ২২০ রান। ভারত পাঠালো হারদিক পান্ডিয়াকে। ২০১৭ সালের পর এই প্রথম চারে উঠে এলেন তিনি। সে সিদ্ধান্তটা বিফলেই যেত, ক্যারি যদি পান্ডিয়ার প্রথম মুখোমুখি হওয়া বলেই তার ক্যাচটা না ফেলতেন। পান্ডিয়া সেটার চড়া মূল্য গুণতে বাধ্য করলেন। চোখের পলকে করলেন ২৭ বলে ৪৮, ডেথ ওভারে নিস্প্রাণ থাকলেন স্টার্ক-কামিন্সরা। মার্কাস স্টোইনিসের শেষ ২ ওভারেই যা একটু ডেথ বোলিংয়ের ছোঁয়া পাওয়া গেল, শেষ ওভারে এমএস ধোনির বুলেটগতির ফিরতি ক্যাচের পর স্লো বাউন্সারে কোহলি ফিরেছেন যথাক্রমে ১৪ বলে ২৭ ও ৭৭ বলে ৮২ করে। চার ছেড়ে ছয়ে নামা রাহুলের ৩ বলে ১১ রানের মিনি ক্যামিও নিশ্চিত করেছে ভারতের ৩৫০ ছাড়িয়ে যাওয়া। শেষ ১০ ওভারে ভারত তুলেছে ১১৬ রান।
শুরুটা ভারতের চেয়েও একটু বেশিই সতর্ক থেকে করলেন ফিঞ্চ-ওয়ার্নার। বড় রানতাড়ায় আক্রমণের তেমন কোনও ইঙ্গিত প্রথম ৯ ওভারে দেননি দুজন। শুরুতে একবার বাঁচলেন ওয়ার্নার, বুমরাহর বলটা ইনসাইড-এজ হয়ে স্টাম্পে লাগলেও পড়লো না বেল। এ নিয়ে এ বিশ্বকাপে এমন ঘটলো পঞ্চমবার, অদ্ভুতুড়ে উপায়ে পাওয়া জীবনটা অবশ্য কাজে লাগাতে পারলেন না ওয়ার্নার, ভুগলেন পুরো ইনিংসজুড়েই।
পান্ডিয়ার করা ১০ম ওভারে এলো ১৯ রান, খোলস ছেড়ে একটু বেরুলেন দুজন। ফিঞ্চ বলপ্রতি রান তুলছিলেন, রান-আউট হয়েই ঘটলো বিপত্তি। ওয়ার্নার ডাবলস নিতে চাইলেও সেখানে আদতে সেটা ছিল না, শুরুতে দ্বিধায় পড়ে শেষ পর্যন্ত ফিরতে পারলেন না ফিঞ্চ। এলেন স্মিথ, তবে ঠিক ছন্দটা খুঁজে পেল না অস্ট্রেলিয়া।
ওয়ার্নারের ফিফটি এলো ৭৭ বলে। পেস বা স্পিন, সবকিছুতেই ভুগেছেন তিনি। চাহালের বলে ক্যাচ দিয়ে মুক্তি মিলেছিল তার। তার সঙ্গে জুটিতেও থেমে থেমে আক্রমণের চেষ্টা করেছিলেন স্মিথ। খাওয়াজাকে আসতে হয়েছে চারে, তবে ততক্ষণে অস্ট্রেলিয়াকে দেখাচ্ছিল পথ হারা পথিকের মতো। তাকে খেলতে হয়েছে স্বভাববিরুদ্ধ ইনিংস। ৩৯ বলে ৪২ রান করে বুমরাহকে স্কুপ করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে সেটার মাশুলই গুণেছিলেন তিনি।
ম্যাক্সওয়েলকে পেয়ে আরেকদফা গিয়ার বদলানোর চেষ্টা করেছিলেন স্মিথ। ২ ওভারে উঠেছিল ২৮ রান, তবে ভারতকে জোড়া ব্রেকথ্রু এনে দিয়েছেন এরপর ভুবনেশ্বর। তিন বলের ব্যবধানে ফিরেছেন স্মিথ ও স্টোইনিস, প্রথমজন হয়েছেন এলবিডব্লিউ, যেটা ভারত পেয়েছে রিভিউ নিয়ে। পরেরজন হয়েছেন বোল্ড। এরপর ক্যারি চেষ্টা করেছিলেন, তার ৩৫ বলে ৫৫ রানের ইনিংসটা শুধু ব্যবধানই কমিয়েছে। তবে দুর্দান্ত ভারতকে আটকাতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া।
এ ভারতের দুর্বল দিক কোনটা, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ম্যাচের পর প্রতিপক্ষের অনেক সময় কেটে যাবে হয়তো সেটা খুঁজে বের করতেই।