• ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯
  • " />

     

    সাকিব না হয় অচেনাই থাকুন!

    সাকিব না হয় অচেনাই থাকুন!    

    সাকিব আল হাসান হচ্ছেন আপনার পাশের ছটফটে ছেলেটার মতো। খুব দস্যিপনা করে বেড়ায় সে, আপনি ভাবেন একে দিয়ে কিছু হবে না। তারপর একদিন সবাইকে অবাক করে সে পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে যায়। আপনি ভাবেন আপনি তাকে চেনেন, কিন্তু আসলে আবিষ্কার করলেন এতোদিনেও চিনতে পারেননি।

    এই সাকিবকেও আপনার চোখে অচেনা লাগতে পারে। কম তো নয়, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দেখছেন। ওর মধ্যে কী বারুদ লুকিয়ে আছে আপনি জানেন। মুলতানে পাকিস্তানের সঙ্গে ওই সেঞ্চুরি বা শ্রীলংকার সঙ্গে এক দশক আগের সেই ৯২ দেখে আপনি বুঝতে পারেন, কী অমিত শক্তি লুকিয়ে আছে ওই  ব্যাটে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাটে-বলে একাই অতিমানব দেওয়ার ওই সিরিজের পর আপনি বোঝেন, এই ছেলে বাকিদের চেয়ে আলাদা। কিন্তু তখনও আপনি সাকিবকে চেনেননি।

    কিছুটা চিনেছেন সেন্ট জর্জেসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেই অবিস্মরণীয় টেস্ট জয়ে। বা তারও পরে এশিয়া কাপে, বাংলাদেশের ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর টেস্টে। অথবা শততম টেস্টে বাংলাদেশের সেই দুর্দান্ত জয়ে। কিংবা ওয়েলিংটনে নিউজিল্যান্ডকে চুরমার করে দেওয়া ডাবল সেঞ্চুরিতে। আর একটু বেশি হয়তো কার্ডিফের সেই সেঞ্চুরিতে। কিন্তু সাকিব তখনও নিজেকেই পুরোপুরি চিনতে পারেননি, আপনি চিনবেন কীভাবে?


    আরও পড়ুন 

    লিটন-তামিমের সঙ্গে কী কথা হয়েছিল সাকিবের?

    যেভাবে টন্টন-কাব্য লিখলেন সাকিব-লিটন


    সাকিব জানতেন, একটা জায়গায় অতৃপ্তি রয়ে গেছে। বিশ্বকাপ তাকে দুই হাত ভরে যেভাবে দেওয়ার কথা ছিল, সেভাবে দেয়নি। ভুল বলা হলো আসলে। সাকিব নিজেই তা নিতে পারেননি। একটা জেদ ছিল তার, একটা চাপা তেজ ছিল। বিশ্বকাপের আগে একটা কিক দরকার ছিল তার। নিজের স্বভাবসুলভ ভাবলেশহীন দিকটা যেন কিছুদিনের জন্য বাক্সবন্দি করে রাখলেন। বিশ্বকাপের আগে ওজন কমিয়ে ফেললেন, আইপিএলে বসে থাকার ক্লান্তিকর সময়ে আলাদা অনুশীলন করলেন। এমনকি দেশ থেকে ডেকে নিয়ে গেলেন নিজের গুরু সালাহউদ্দনকেও। সাকিব জানতেন, বিশ্বকাপে তার একটা ম্যাচসেরারও পুরস্কার নেই। এমনকি আগের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের যে কটি জয়, সেখানেও অনেকটা পার্শ্বচরিত্রে ছিলেন। সামর্থ্যের পুরোটা জানান দেওয়ার এটাই শেষ সুযোগ, সাকিব জানতেন।

    সাকিব ধৈর্য ধরে ছিলেন। নিজের সেই কষ্টের কথা ভোলেননি। ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে সেই কষ্টকেই বাসিলেন ভালো, ‘এর আগে আমি বেশ কিছু কষ্ট করে এসেছি, যখন কঠিন মুহুর্ত আসে তখন আমার সেই কষ্টের কথা মনে পড়ে। ওটা আমাকে আরও সাহস দেয়, শক্তি দেয়। এত যেহেতু কষ্ট করেছি, এর চেয়ে বেশি তো কষ্ট করা লাগবে না। এই ব্যাপারটা আমার মনের ভেতর অনেক বেশি শক্তি দিচ্ছে।’

    তারপরও তো ভালো করা আর দুর্দান্ত করার মধ্যে একটা ব্যবধান থেকে যায়। সাকিব তাই নিজেকে বদলে ফেললেন, বিশ্বকাপে নিজেকে সঁপে দিলেন পুরোপুরি। মোস্তাফিজ আজ যখন শেষের ওভারে বল হাতে নিচ্ছেন, সাকিব গিয়ে তাকে বোঝালেন অনেকক্ষণ। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে যখন মিরাজ বল করছেন, সাকিব তার সঙ্গে কথা বললেন আলাদা করে। নিজের সবটুকু দিয়ে সাহায্য করতে চাইছেন সতীর্থদের। যেন ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টে সেই অলিখিত অধিনায়ক সাকিব হয়েই ফিরলেন। সাকিব প্রতি মুহূর্তেই জানান দিচ্ছিলেন, এবার তাকে বাড়তি কিছু করতে হবে। নিজের সামর্থ্য যে অন্তরীক্ষের বাইরে তা জানান দিতে হবে। নিজের সময়ের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে সবাই জানে তাকে। কিন্তু তিনি ওয়ানডেতে যে অন্তত সর্বকালের সেরা, সেটা আরেকবার মনে করিয়ে দিতে হবে।

    আর সেটার জন্য লাগে মানসিক শক্তি। সাকিব নিজেই যে কথা বলেছেন, সেটা প্রেরণা হতে পারে অনেকেরই, ‘এরকম পর্যায়ে এসে মানসিক শক্তি সবচেয়ে কাজে দেয়। ফিটনেস ভালো থাকলে হেল্প করে। কিন্তু মানসিক দিক দিয়ে যত বেশি শক্ত থাকা যায়, সাহস রাখা যায় ওই জিনিসগুলা ব্যাটিং বা বোলিং বলেন, ওই সময়ে সাহায্য করে। আসলে যুদ্ধটা হয় নিজের সাথে নিজের। নিজে যদি কেউ হেরে যায় ভেতরে তাহলে তার জেতার সম্ভাবনা থাকে না। নিজে যদি মন থেকে বলে সবসময় ‘আমি জিতছি, আমি জিতছি’ তাহলে সবসময় হয়তো হবে না, বেশির ভাগ সময় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’

    সাকিব এখানেও যেন আলাদা। এমনিতে মুড থাকলে তার মতো কথা বাংলাদেশের কেউ বলতে পারেন না। কিন্তু ‘নিজের সঙ্গে যুদ্ধে জেতাটাই আসল’- এমন কথা তো বড় বড় দার্শনিকদের বাণী চিরন্তনীতে পাওয়া যায়। এমন প্রজ্ঞা কি তাহলে অন্য সাকিবকেই চেনায়?

    এর মধ্যে উঠে এসেছেন তিনে। কদিন আগেই যেমন সাকিব মুচকি হেসে বলেছেন, তিনে উঠে আসার জন্য টিম ম্যানেজমেন্টকে অনেক বোঝাতে হয়েছে তাকে। একরকম জোর করেই উঠে এসেছেন তিনে। সাকিব জানতেন, বড় কিছু করার জন্য তার প্রতিজ্ঞায়, নিজের ভাবনায় অটল থাকা দরকার। সেজন্য টপ অর্ডারের জায়গা ছাড়লেন না। সেই গল্পটা শুনুন তার মুখে কিছুটা, ‘গত দুই বছরের মধ্যে এক বছর বা দেড় বছর ব্যাটিং করেছি পাঁচে। ওপরের ব্যাটসম্যানরা এত ভালো ব্যাট করেছে আমার তেমন সুযোগ হয়নি। ৩০-৩৫ ওভারের পর ব্যাটিং পেয়েছি। আর যাও এক দুইবার সুযোগ পেয়েছি কাজে লাগাতে পারিনি। তিনে আসার পর দেখলাম ব্যাটিংটা ভালো হচ্ছে। দেখলাম সুযোগ আছে ইনিংস বড় করার। এর ভেতর বেশ কয়েকটা ৫০ এর ওপর স্কোরও ছিল। তখন ভেবেছি কীভাবে আরও বড় করতে পারি ইনিংসটা। এই কারণেই হয়তো ইনিংসগুলো বড় হচ্ছে।’

    কথাগুলো কি ছাইচাপা প্রতিজ্ঞার আভাস দেয় না? সাকিবকে তো আপনি অনেক দেখেছেন, ঠিক চেনা চেনা লাগছে? না লাগুক, সমস্যা নেই। সাকিব আরও কিছুদিন এমন অচেনাই থাকুন না, ক্ষতি কী!