রুদ্ধশ্বাস সাউদাম্পটনে ম্যাচ জিতল ভারত, আফগানিস্তান জিতল হৃদয়
ভারত ৫০ ওভারে ২২৪/৮ (কোহলি ৬৭, কেদার ৫২; নবী ২/৩৩, নাইব ২/৫১)
আফগানিস্তান ৪৯.৫ ওভারে ২১৩ (নবী ৫২, রহমত ৩৬; শামি ৪/৪০, চাহাল ২/৩৬, বুমরা ২/৩৯)
ফলঃ ভারত ১১ রানে জয়ী
প্রথম পাঁচ ম্যাচে দাঁড়াতেই পারেনি একটা দল। দলের ভেতরে বাইরে অঘটনেরও শেষ নেই, আফগানিস্তান ছিল একদম কোণঠাসা। আর প্রতিপক্ষ ভারত প্রথম চার ম্যাচ জিতে উড়ছিল, অনেকে হয়তো একপেশে একটা ম্যাচ দেখতে পাচ্ছিলেন। সাউদাম্পটনে দুর্দান্ত একটা থ্রিলারই হলো, কিন্তু ম্যাচটা আর জেতা হলো না আফগানিস্তানের। সন্তুষ্ট থাকতে হলো হৃদয় জিতেই।
কে বলেছে, ওয়ানডেতে দারুণ একটা ম্যাচের জন্য ৩০০ রান হতে হবে? লো স্কোরিং ম্যাচেই একটা নখও আস্ত নেই রোজ বলের দর্শকদের। কাল যেমন ইংল্যান্ডের ভরসা ছিলেন বেন স্টোকস, আজ আফগানদের ছিলেন মোহাম্মদ নবী। কিন্তু স্টোকসের পাশেও কেউ ছিলেন না, নবীও শেষ পর্যন্ত আর পারলেন না। শেষ পর্যন্ত আফগানদের গল্পটা হয়ে গেল এত কাছে তবু এত দূরের।
শেষ তিন ওভারে যখন ২৪ রানও দরকার, আফগানদের আশা বেঁচে ছিল ভালোমতোই। নবী ছিলেন ক্রিজে, কিন্তু অন্য পাশে উইকেটকিপার ইকরাম আলী খিল করতে পারছিলেন না কিছু। দায়িত্বটা একাই নিতে হতো নবীকে। আগের ওভারেই বুমরাকে ছয় মেরেছিলেন, নবীর পক্ষে বাজি ধরাটা বাড়াবাড়ি হতো না।
কিন্তু শামি ৪৮তম ওভারে দিলেন মাত্র ৩ রান, চাপটা আরও বেড়ে গেল। বুমরা পরের ওভারে একের পর ইয়র্কার মারলেন, ৫ রানের বেশি হলো না। শেষ ওভারে দরকার ১৬ রান, প্রথম বলে চার মেরে ফিফটি পেলেন নবী। পরের বলে সিঙ্গেল নিলেন না, কিন্তু এর পরেই ছয় মারতে গিয়ে আউট। পরের দুই বলে দুই উইকেট নিয়ে শামি শেষ করে দিলেন ম্যাচ, মাত্র দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে বিশ্বকাপে পেলেন হ্যাটট্রিক।
২২৫ রান তাড়া করে হজরতউল্লাহ জাজাই প্রথম বল থেকেই আভাস দিচ্ছিলেন, যে কোনো সময়ই আউট হতে পারেন। ভারত অবশ্য একবার চেষ্টাও করল তৃতীয় ওভারে, কিন্তু একটুর জন্য হারাল রিভিউ। প্রথম ৫ ওভারও কোনোমতে কাটিয়ে দিলেন দুই ওপেনার। কিন্তু সপ্তম ওপভারে গিয়ে আর শেষ রক্ষা হলো না। শামির বলে বোল্ড হয়ে জাজাই, ২০ বলে করলেন ১৪।
গুলবদিন নাইব ও রহমত শাহ মন্দ করছিলেন না। রান সেভাবে না উঠলেও ভারতকে কোনো উইকেট দেননি দুজন। ১৬ ওভারও পার করে ফেলেছিলেন দুজন। এর মধ্যে পান্ডিয়া প্রথম দুই ওভারে লাইন লেংথ হারিয়ে এলোমেলো। তারপরও কোহলি ভরসা রাখছিলেন তার ওপর, যেটির প্রতিদান দিলেন ১৭তম ওভারে এসে। শর্ট বলে মারতে গিয়ে আউট অধিনায়ক নাইব, ৪২ বলে ২৭ রান করে।
আফগানদের ভরসা হয়ে ছিলেন রহমত শাহ। উইকেটটা তখন খুব বেশি কঠিন মনে হচ্ছিল না। রানও আসছিল একেবারে মন্দ না। ২৬.৩ ওভারে ১০০ও পেরিয়ে গেল আফগানিস্তান। লক্ষ্যটা কাছে আসছিল একটু একটু করে। চাহাল, কুলদীপ, পান্ডিয়া কেউই ব্রেকথ্রু দিতে পারছিলেন না। তুরুপের তাসের কাছে গেলেন কোহলি, বল হাতে নিয়েই কামাল করলেন বুমরা।
শুরুতেই আউট করতে পারতেন রহমত শাহকে, কিন্তু আলিম দার জোর আবেদনেও সাড়া দেননি। চতুর্থ বলটা বাউন্সার, মারতে গিয়ে চাহালের দুর্দান্ত এক ক্যাচে আউট রহমত। ৬৩ বলে ফিরলেন ৪৩ রান করে। অন্য পাশে হাশমতউল্লাহ শহিদিও জাঁকিয়ে বসেছেন ক্রিজে, কিন্তু শেষ বলে তিনিও ফিরতি ক্যাচ দিলেন বুমরাকে। ২১ রান করে ফিরলেন, আরও উজ্জ্বল ভারতের আশা।
আসগর আফগান চাপটা বেশিক্ষণ নিতে পারলেন না। চাহালের বলে বোল্ড হয়ে গেলেন ৮ রানে। ১৩০ রানে ৫ উইকেট হারাল আফগানিস্তান, জয় তখনও ৯৫ রান দূরে। তবে নবী আর নজিবুল্লাহ জাদরান মিলে হাল ছাড়েননি। এবার দুজন টিকে থাকার সঙ্গে রানের দিকটাও খেয়াল রাখছিলেন। ৩৬ রানের জুটিটা ছিল প্রায় বলে বলেই। কিন্তু আফগানদের জয়ের আশা যখন উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, উইকেটটা দিয়ে এলেন জাদরান। পান্ডিয়ার বলে ক্যাচ প্র্যাকটিস করালেন শর্ট মিড উইকেটে, ফিরলেন ২১ রানে। রশিদ দারুণ কিছু শট খেলে ফিরে গেলেন। তারপরও বল ও রানের ব্যবধান বাড়ছিল না, নবী তো ছিলই। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না।
ম্যাচের প্রথম ইনিংসের গল্পটা আসলে তিন লাইনেই বলে ফেলা যায়।
এই ম্যাচের আগে বিশ্বকাপে একটি স্পিনের বিপক্ষে একটি উইকেটও হারায়নি ভারত। আজ সেই স্পিনের বিপক্ষে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল ভারত। সাউদাম্পটনে আফগানিস্তান যে ২৩২ রানে ভাটকে ফেলেছে ভারতকে, সেটার মূল কৃতিত্ব তো স্পিনারদেরই!
মুজিব উর রেহমান এই বিশ্বকাপে খুব ভালো কিছু করতে পারছিলেন না। আজ করলেন অসাধারণ কিছু, শুরু থেকেই চেপে ধরেছিলেন ভারতের দুই ওপেনারকে। ফল পেলেন পঞ্চম ওভারে, একটু গ্রিপ করা বলটা বুঝতে না পেরে বোল্ড রোহিত শর্মা। ১ রানে ফিরলেন বিশ্বকাপে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ব্যাটসম্যান, ভারত হারাল প্রথম উইকেট।
পিচে কিছু আছে, কোহলি অবশ্য সেটা বুঝতেই দিচ্ছিলেন না। দুই চারে দ্রুত পৌঁছে গেলেন ডাবল ফিগারে, এই টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মতো যেন আত্মবিশ্বাস ঠিকরে বের হচ্ছিল ব্যাট থেকে। লোকেশ রাহুল একটু সাবধানী ছিলেন, কোহলির সঙ্গে ঠিক তাল মেলাতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত ধৈর্যটা হারিয়ে ফেললেন, নবীকে রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দিলেন জাজাইকে। ৫৩ বলে ৩০ রান করে ফিরলেন রাহুল, ৬৪ রানে দ্বিতীয় উইকেট হারাল ভারত।,
কোহলি আর বিজয় শংকর অবশ্য এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ভারতকে। চারে নেমে শংকরের শুরুটা মন্দ হয়নি, ইনসাইড আউটে একটি চার মেরে খোলস ছেড়ে বেরুনোর আভাসও দিচ্ছিলেন। রশিদ খানকেও ভালো পড়ছিলেন দুজন, কিন্তু সর্বনাশ হলো পার্টটাইমার রহমত শাহের লেগ স্পিনে। সুইপ করতে গিয়ে এলবিডব্লু হয়ে গেলেন শংকর, তার আগে করলেন ৪১ বলে ২৯।
কোহলি অবশ্য তার মতোই দুর্দান্ত খেলছিলেন। ৪৮ বলে পেয়ে গিয়েছিলেন ফিফটি, টুর্নামেন্টে যা তার টানা তৃতীয়। তবে সেঞ্চুরির আগে থামবেন না বলেই মনে হচ্ছিল। নবী এলেন বোলিংয়ে, কাট করতে গিয়ে কোহলি ক্যাচ দিলেন। ৬৩ বলে ৬৭ রানে আউট হলেন কোহলি, ভারতের পথ হারানোর শুরু সেখান থেকেই।
তখনও রান রেট পাঁচের কাছাকাছি ছিল, কিন্তু এরপর সেটা শুধুই নিচে নামতে শুরু করে। কেদার যাদব ও এমএস ধোনি উইকেট পড়তে দিলেন না, কিন্তু রান তোলাও বন্ধ করে দিলেন প্রায়। দুজন ৫৭ রান যোগ করলেন বটে, কিন্তু সেটা ১৪.১ ওভারে। রান রেট যখন বাড়াতে যাবেন, রশিদের বলে স্টাম্পড হয়ে গেলেন ধোনি। ৫২ বলে ২৮ রানেই থেমে যেতে হলো।
হার্দিক পান্ডিয়াও কিছু করতে পারলেন না, ভারতের ইনিংসে একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে পেসের বিপক্ষে উইকেট দিলেন। আফতাব আলমের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেওয়ার আগে করেছেন ৭ রান। শামিও শেষ ওভারে আউট হয়ে গেলেন নাইবের বলে, কেদার অবশ্য ফিফটি পেলেন। কিন্তু রান আর উঠল না। উল্টো ৫২ রান করে কেদারই দিয়ে এলেন ক্যাচ। শেষ ১০ ওভারে মাত্র ৪৯ রান তুলে ৪ উইকেট তুলতে পারল ভারত। ২২৪ রানে থামল শেষ পর্যন্ত, ২০১০ সালের পর এটাই ভারতের সর্বনিম্ন স্কোর। সেটাই শেষ পর্যন্ত হলো যথেষ্ট।