ওয়ানডেতে 'বাংলাদেশ-ব্র্যান্ড': সীমিত সামর্থ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার
বিশ্বকাপ শুরুর আগে যদি বলা হতো, বাংলাদেশের সেমিফাইনালে যাওয়ার সম্ভাবনা গ্রুপ পর্যায়ের প্রায় শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে, অনেকেই বোধ হয় ভুরু কুঁচকে তাকাতেন । দেশ ছাড়ার আগে মাশরাফি বিন মুর্তজা নিজেই বলে গিয়েছিলেন, সেমিতে ওঠা হবে খুব খুব কঠিন। সেই কাজটা এখনও অসম্ভব নয় মোটেও। তবে এর মধ্যে একটা ব্যাপার পরিষ্কার, বাংলাদেশ নিজেদের ইতিহাসের সেরা বিশ্বকাপটা এবার বোধ হয় কাটিয়ে ফেলছে। গত চার বছরের পথচলায় সেটা খুব একটা বিস্ময় হয়েও আসেনি। বাংলাদেশের ওয়ানডের এই ব্র্যান্ডটা আসলে কী? ওয়ানডেতে বাকি দলগুলোর সঙ্গে পার্থক্য হচ্ছেই বা কোন জায়গায়?
হেভিমেটাল নয়, ক্লাসিক-রক ব্যাটিং
বিশ্বকাপের আগেই মাশরাফি একটু আক্ষেপ নিয়েই বলেছিলেন, একজন ম্যাক্সওয়েল বা রাসেলের মতো মারতে পারে এমন কেউ নেই বাংলাদেশে। অবশ্য এবারের বিশ্বকাপে পাওয়ারহিটাররা যেভাবে ধুঁকছেন তাতে মাশরাফির সেই আফসোস খুব বেশি থাকার কথা নয়। এই বিশ্বকাপে অন্তত ২০০ রান করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে মাত্র পাঁচ জনের স্ট্রাইক রেট ১০০র বেশি। সবচেয়ে বেশি রানের তালিকায় সাকিব আল হাসান যেমন এই মুহুর্তে আছেন তিনে, তবে শীর্ষ দশ ব্যাটসম্যানের মধ্যে তার চেয়ে বেশি স্ট্রাইক আছে শুধু অ্যারন ফিঞ্চের। সাকিবের স্ট্রাইক রেট প্রায় ১০০ ছুঁই ছুঁই, কোহলি-ওয়ার্নার সবাইকেই পেছনে ফেলে দিচ্ছেন এখানে।
অথচ ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপে হওয়ার কথা ছিল উলটোটা। ছোট মাঠ, ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে চার-ছয়ের ফুলঝুরি ছোটার কথা ছিল। তবে গেইল, মরগান আর ফিঞ্চ ছাড়া আর কেউ ছয়ের দুই অংক ছুঁতে পারেননি। সেরকম কোনো পাওয়ার হিটার না থাকার পরেও বাংলাদেশের সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ, লিটন মিলে মেরেছেন ১৩টি ছয়। সেটাও দৃশ্যত প্রভাব ফেলেনি রানে। আজকের ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচের আগ পর্যন্ত বিশ্বকাপে ৩০০ রানের বেশি ইনিংস হয়েছে ১৭টি, এর মধ্যে তিনবার কীর্তিটা আছে বাংলাদেশের। এর চেয়ে বেশি চার বার ৩০০ করেছে শুধু ইংল্যান্ডই।
সিঙ্গেলস-ডাবলসেই আশ্রয়
একটা সময় বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল স্ট্রাইক রোটেট করা। পাওয়ারপ্লেতে বেশ কিছু রান ওঠার পর খোলসে ঢুকে যেতেন ব্যাটসম্যানরা, সিঙ্গেলস-ডাবলস আসত না সেভাবে। অন্তত এই বিশ্বকাপে এক আর দুই রান নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশই পথ দেখিয়ে দিয়েছে বাকিদের। সেখানে মুশফিকের কথাটা আলাদা করেই বলতে হবে। এবারের বিশ্বকাপে অন্তত ২০০ রান করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে মুশফিকের চেয়ে শতকরা হিসেবে কম ডট বল খেলেছেন শুধু বাটলার ও কোহলি (২৯ জুন পর্যন্ত)। এবং মুশফিক বল খেলেছেন দুজনের চেয়েই বেশি। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের কথাই ধরুন। ম্যাচের পরিস্থিতির বিচারে মহামূল্যবান মুশফিকের ৮৩ রানের ইনিংসটা এসেছে ৮৭ বলে, কিন্তু সেখানে চার-ছয় থেকে এসেছে মাত্র ২২ রান। বাকি ৬১ রানই মুশফিক নিয়েছেন দৌড়ে।
এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে এক, দুই ও তিন রানের জন্য ২২ গজের মধ্যে ২১৫ বার দৌড়েছেন মুশফিক, সাকিব দৌড়েছেন ২৭২ বার। সাকিবের চেয়ে বেশি দৌড়েছেন শুধু ওয়ার্নার, আর সমান রুট। আর সাকিব ও মুশফিকের মাঝে আছেন কেন উইলিয়ামসন।
সাকিবের 'তিন-নম্বরে বিপ্লব'
বাংলাদেশের ওয়ানডে-ব্র্যান্ডের বড় একটা ধাপ ছিল সাকিব আল হাসানের তিন নম্বরে উঠে আসা। এমনিতে এই বিশ্বকাপে সাকিব ব্যাটে-বলে যা করেছেন, সেটা লিখতে গেলে ছোটখাটো একটা বই-ই হয়ে যাবে। তবে তিন নম্বরে উঠে না এলে হয়তো এতোকিছু হতোই না, যেটা করতে টিম ম্যানেজমেন্টকে বুঝিয়ে সুঝিয়েই রাজি করাতে হয়েছে সাকিবকে। গত বছর জানুয়ারিতে দেশের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজ থেকেই সাকিব খেলেছেন তিনে। এর আগে দুইবার খেললেও সেটা ছিল পরিস্থিতির দাবিতে। তবে সত্যিকার অর্থে সাকিব তিনে নিজের সামর্থ্য জানান দিতে শুরু করেন গত বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। ৯৭, ৫৬ ও ৩৭ রান করেছিলেন তিন ইনিংসে, এরপর চোটের জন্য বাইরে চলে গিয়ে আবার তিন নম্বরের জায়গা হারিয়ে ফেলেছিলেন। একটা বিরতি শেষে আয়ারল্যান্ডের ত্রিদেশীয় সিরিজে আবার তিনে ফিরলেন। এরপর বাকিটা ইতিহাস। তিন নম্বরে নেমে ওয়ানডেতে অন্তত ২০ ইনিংস খেলেছেন, এমন ব্যাটসম্যানের মধ্যে সাকিবের চেয়ে বেশি গড় আছে শুধু বাবর আজম ও বিরাট কোহলির। অথচ গত বিশ্বকাপের পর থেকে সাকিব তিনে উঠে আসার আগ পর্যন্ত সাব্বির, ইমরুল, লিটন, সৌম্য, মাহমুদউল্লাহ- কাউকে খেলিয়েই থিতু করতে পারেনি বাংলাদেশ। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে ২০১৭ সালের শেষ পর্যন্ত তিনে সেঞ্চুরি দূরে থাক, বাংলাদেশের কারও ফিফটিই ছিল একটি। এরপর সাকিব নেমে বদলে দিয়েছেন দৃশ্যপট।
চারের ভরসা মুশফিক
সাকিবের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছেন, তবে মুশফিকুর রহিম ব্যাট হাতে এখনও সবচেয়ে বড় ভরসা। চার নম্বর তার সেরা পজিশন অনেক দিন ধরেই, বিশ্বকাপেও সেখানে নিজেকে প্রমাণ করে যাচ্ছেন। গত চার বছরে চারে ব্যাট করে মুশফিকের চেয়ে বেশি রান আছে শুধু অইন মরগান ও রস টেলরের। তবে এই দুজনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে মুশফিকের ভূমিকা, কারণ একই সঙ্গে উইকেটের পেছনেও দাঁড়াতে হয় তাকে। উইকেটকিপারদের মধ্যে শুধু হোপ আর ডি ককই এই বছর চারের ওপরে ব্যাট করে বেশি রান করেছেন মুশফিকের চেয়ে।
গতি যখন দুর্গতি
এবারের বিশ্বকাপে ব্যাটিংয়ে যেমন বাংলাদেশের চেয়ে বেশি রান করেছে ইংল্যান্ড, তেমনি বোলিংয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষেই একমাত্র ৩৮০ রানের চেয়ে বেশি হয়েছে দুইবার। ১৪০ কিলোর চেয়ে বেশি গতি তুলতে পারেন এমন একজনও নেই বাংলাদেশে। অথচ বিশ্বকাপে উইকেট পাওয়ায় শীর্ষ তিন বোলারই নিয়মিত ১৪৫ কিলোর বেশি বেগে বল করেন। শীর্ষ দশে বাকি পেসারদের ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো গতি বাংলাদেশের কারও নেই। মোস্তাফিজ-সাইফউদ্দিন ১০ উইকেট পেলেও গতির অভাবটা বাংলাদেশ টের পাচ্ছে ভালোমতোই। গত চার বছরে দেশের মাটিতে বাংলাদেশের পেসারদের গড় যখন ২৫ এর একটু বেশি, দেশের বাইরে গেলে সেটা হয়ে যাছে ৪৯ এর কাছাকাছি। ঘরের মাটিতে বাংলাদেশের পেসারদের গড় বিশ্বকাপের দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো, আর দেশের বাইরে বিশ্বকাপের দলগুলোর মধ্যে তা সবচেয়ে খারাপ। দেশের বাইরে পেস বোলিং বাংলাদেশের জন্য অনেক দিন ধরেই মাথাব্যথা। আর সেটার বড় একটা কারণ গতির অভাব।
তারপরও কৌশল রান আটকানো
একজন স্টার্ক, বুমরা বা বোল্ট যখন নেই, বাংলাদেশের জন্য তখন উইকেট দেওয়ার চেয়ে রান কম দেওয়াটাই ওয়ানডেতে নিরাপদ অস্ত্র। গত চার বছরের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের বোলাররা গড়ের দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকলেও ওভারপ্রতি রান দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে এগিয়ে আছে শুধু আফগানিস্তান। অবশ্য দেশের মন্থর উইকেটে বেশি খেলাও যে এর একটি কারণ, সেটা ভুলে যাওয়াও উচিত হবে না। সেজন্য উইকেট নেওয়ার চেয়ে রান কম দিতেই বেশি মনযোগী থাকেন বোলাররা। আপাতত এই রেসিপিতে ভরসা করেই এগুতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
এবং বিশ্বাস হৃদয়ে
সম্ভাবনা আছে, আছে সীমাবদ্ধতা। তবে সবকিছুর পর ওয়ানডেতে রঙিন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড সীমিত সামর্থ্যের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার আর পঞ্চপাণ্ডবের অভিজ্ঞতা তো আছেই। সাকিব, মুশফিক, তামিম যেমন বিশ্বকাপে খেলে ফেলেছেন টানা ২৭টি ম্যাচ। পরের ম্যাচেই যা হয়ে যাবে ২৮, ত্রয়ী হিসেবে বিশ্বকাপে টানা ম্যাচ খেলার যা রেকর্ড। মাশরাফি তার অভিজ্ঞতায় ও নেতৃত্বে অনেক দিন ধরেই যূথবদ্ধ রাখছেন দলকে, মহাভারতের পঞ্চপান্ডবের যুধিষ্ঠিরের মতো। আর মাহমুদউল্লাহ কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটাও প্রমাণ করছেন এই বিশ্বকাপে। দীর্ঘদিন ধরে একসঙ্গে থাকা এই দলে প্রতীক এই পাঁচজন ছায়া হয়ে আছেন বাকিদের ওপর; আর লিটন, মোসাদ্দেক, মোস্তাফিজ, মিরাজরা আভাস দিচ্ছেন একদিন তাদের জায়গা নেওয়ার। ওয়ানডেতে বাংলাদেশ-ব্র্যান্ড তাই আরও বেশ কিছুদিন ‘সুনামটা’ ধরে রাখতে পারবে, সেই আশা করতেও দোষ নেই খুব একটা।