• ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯
  • " />

     

    ওল্ড ট্রাফোর্ডে যেভাবে তেরঙ্গা ম্লান হয়ে গেল ব্ল্যাক ক্যাপসে...

    ওল্ড ট্রাফোর্ডে যেভাবে তেরঙ্গা ম্লান হয়ে গেল ব্ল্যাক ক্যাপসে...    

    নিউজিল্যান্ড ৫০ ওভারে ২৩৯/৮ (টেইলর ৭৪, উইলিয়ামসন ৬৭; ভুবনেশ্বর ৩/৪৩, জাদেজা ১/৩৪, বুমরা ১/৩৯)

    ভারত ৪৯.৩ ওভারে ২২১ (জাদেজা ৭৭, ধোনি ৫০, পান্ডিয়া ৩২, পান্ট ৩২; হেনরি ৩/৩৭, স্যান্টনার ২/৩৪, বোল্ট ২/৪২ )

     

    ফলঃ নিউজিল্যান্ড ১৮ রানে জয়ী


    উফফফফ!!

     

    এমন একটা ম্যাচ দেখার পর আপনার নিশ্চয় চেপে থাকা নিঃশ্বাসটা এবার বের হয়ে এসেছে। নাটক, থ্রিলার এসব শব্দও ম্যাড়ম্যাড়ে মনে হবে এখন। ক্রিকেটের সব রোমাঞ্চ, সব রং-রূপ-রস-গন্ধ আজ যেন ছিল ম্যানচেস্টারে। আর ওল্ড ট্রাফোর্ডে স্নায়ুটা ধরে রেখেছে নিউজিল্যান্ড, ম্লান হয়ে গেছে ভারতের তেরঙ্গা পতাকা। টানা দুই বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে গেছে নিউজিল্যান্ড, আর দুবার শেষ চারের চৌকাঠ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে ভারতকে।

    বিরাট কোহলি বার বার পায়চারি করছিলেন উত্তেজনায়। কখনো রবি শাস্ত্রীকে এসে মেজাজ হারিয়ে কিছু একটা বলছিলেন। তবে রবীন্দ্র জাদেজা আর মহেন্দ্র সিং ধোনির জন্য একটা সময় যেন এক চিলতে হাসি ফুটল তার মুখে। কিন্তু ম্যাচটা হাতে নিতে নিতেও নেওয়া হলো না ভারতের। হলো না বোধ হয় মার্টিন গাপটিলের মুহূর্তের ওই অবিশ্বাস্য থ্রোয়ের জন্য।

    ধোনি যতক্ষণ ছিলেন, কোহলি নিশ্চয় ভরসা হারাননি। এমনকি জাদেজার ওই দুর্দান্ত ইনিংস খেলে আউট হয়ে যাওয়ার পরেও। ভারত হেরেছে, আর শেষ ধোনি শেষ পর্যন্ত ছিলেন- এমন ম্যাচ তো দুইটির বেশিই নেই রেকর্ডে। ফার্গুসনের বলে ছয় মেরে ওল্ড ট্রাফোর্ডকে জাগিয়ে তুলেছিলেন ধোনি। এরপর দুই রান নিতে গেলেন, হয়েও যাচ্ছিল। কিন্তু ফাইন লেগ থেকে দৌড়ে এসে গাপটিল করলেন একদম স্কেল দিয়ে মাপা একটা থ্রো। ধোনির মতো অ্যাথলেটও ঠিক সময়ে ক্রিজে ঢুকতে পারলেন না, আউট। তখনো ১২ বলে ২৫ রান লাগে ভারতের, হাতে দুই উইকেট। কিন্তু ধোনির আউটের সঙ্গে সঙ্গে রোহিত শর্মাও যখন মাথায় হাত দিয়ে দিলেন, ওল্ড ট্রাফোর্ড বুঝে গেল ম্যাচটা আসলে ওখানেই শেষ।

    জাদেজার কথা এখনও না বলাটা অপরাধ হয়ে যাচ্ছে। জিতে ফিরতে পারলে বিশ্বকাপের ইতিহাসের সেরা ইনিংসগুলোর একটা হয়ে যেত। হারার পরেও অবশ্য সেটার মহিমা খুব বেশি কমছে না। যখন ক্রিজে আসেন, ৯২ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল ভারত। লর্ডসের ফাইনাল তখন দূর অস্ত, ওল্ড ট্রাফোর্ডে বন্দে মাতরম ধ্বনিও তখন মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে।

    জাদেজা সেটা ফিরিয়ে আনলেন কী দারুণভাবে। ব্যাট করা মোটেই সহজ নয় এই উইকেটে, সেটা প্রথম দিন থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু জাদেজা যেটা চাচ্ছিলেন, সেটাই যেন হচ্ছিল। মিচেল স্যান্টনারকে খেলতেই পারছিলেন না কেউ, তাকে মারলেন ছয়। ফার্গুসনকে আছড়ে ফেললেন লং অনের ওপর দিয়ে। ফিফটি করে নিজের স্বভাবসুলভ তলোয়ারের মতো ঘুরিয়ে আনলেন ব্যাট। কে জানে, হয়তো প্রেসবক্সে সঞ্জয় মাঞ্জরেজারের ওই ‘একটু একটু করে সবকিছু পারা ক্রিকেটারের’ তকমারও জবাব দিচ্ছিলেন। দুজনের জুটিতে ১০০র বেশি রান হয়ে গেল, একটা সময় বিশ্বকাপে সপ্তম উইকেটে সবচেয়ে বেশি রানও হয়ে গেল। ১০ ওভারে ৯০ রান দরকার ছিল, সেটা ৭ ওভারে ৬৯ হলো, ৫ ওভারে হলো ৫২ আর ৩ ওভারে ৩৭। ধোনি শুধু জাদেজাকে স্ট্রাইক দিয়ে যাচ্ছিলেন, বাকি কাজ করছিলেন জাদেজা।

    কিন্তু রূপকথা তো আর সবদিন হয় না। ৪৮তম ওভারের পঞ্চম বলে বোল্টকে মারতে গিয়ে হলো না, উইলিয়ামসন মাথা ঠাণ্ডা রেখে নিলেন ক্যাচ। ৫৯ বলে ৭৭ রান করে আউট জাদেজা, ওল্ড ট্রাফোর্ড স্তব্ধ। এরপরও আশা বেঁচে ছিল ধোনিতে, তার পরেই শেষ সবকিছু।

      

                                                  ম্যাচটা ঘুরিয়ে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছিলেন জাদেজা

     

     

    কোহলি অবশ্য বলতে পারলেন, আসলে শুরুর পাঁচ ওভারের মধ্যেই তো শেষ হয়ে গেল সবকিছু। রোহিত শর্মা ছিলেন স্বপ্নের ফর্মে, দ্বিতীয় ওভারেই আউট হেনরির বলে। পরের ওভারে সবচেয়ে বড় ধাক্কা দিলেন বোল্ট, এবার কোহলিকে করলেন এলবিডব্লু। লোকেশ রাহুলকে পরের ওভারে আবার তুলে নিলেন হেনরি। নামতা পড়ার মতো পর পর তিন ওভারে তিন উইকেট নেই ভারতের, তিন জনই ফিরলেন এক রানে। ওয়ানডে ইতিহাসেই প্রথম তিন ব্যাটসম্যানের ১ রানে আউট হওয়ার যা প্রথম ঘটনা।

    ঋশভ পান্ট আর দীনেশ কার্তিক এরপর জুটি বাঁধলেন। প্রথম ১০ ওভার ভালোয় ভালোয় কাটিয়ে দিচ্ছিল ভারত, কিন্তু এর পরেই আবার দুর্দান্ত নিউজিল্যান্ড। দীনেশ কার্তিকের ক্যাচটা বাঁ হাতে চিলের মতো ছোঁ দিয়ে নিলেন নিশম, ২৪ রানে নেই ৪ উইকেট। পান্ট আর পান্ডিয়া বিস্ময়করভাবে উঠে এলেন ধোনির আগে, কিন্তু খারাপ করছিলেন না। দুজনের ৪৭ রানের জুটিতে একটু পথ দেখল ভারত। এর পরেই পান্ট আর পান্ডিয়া- দুজনেই ঠিক একই রকমভাবে ধৈর্য হারিয়ে উইকেট দিয়ে এলেন। দুজনেই স্যান্টনারের বলে, দুজনেই স্লগ করতে গিয়ে। ৯২ রানে ৬ উইকেট নেই ভারতের তখন, এরপর বাকিটা তো জেনে গেছেনই।

    তবে শুধু আজকের ম্যাচ দেখলে জানেননি অনেক কিছু। কাল নিউজিল্যান্ড যখন রানের জন্য সংগ্রাম করছিল, তখনও নিশ্চয় মনে হয়েছে ভারতের জয়টা সময়ের ব্যাপার। এমনিতেই আজকাল ২৩৯ এমন কোনো রানই নয়, তার ওপর বিপক্ষ ভারত। কালকের ম্যাচ শেষে কিউইদের পক্ষে বাজি ধরার জন্য দুবার ভাবতে হতো আপনাকে।

    কিন্তু উইলিয়ামসন আর টেলর দেখিয়ে দিয়েছেন, এই উইকেটে এই রান তোলাও কত বড় ব্যাপার। দুজন কাল ধৈর্য ধরে গেছেন দাঁত চেপে, রান না আসলেও উইকেট দিয়ে আসেননি। উইলিয়ামসন ৬৭ রানে আউট হলেও টেইলর কাল বৃষ্টি আসার আগ পর্যন্ত অপরাজিতই ছিলেন। ২১১ রানে যখন কাল দিন শেষ করেছে নিউজিল্যান্ড, বাকি ২৩ বলে ২৫০ পর্যন্ত যাওয়াটা ছিল কঠিন। ভারত আজ সকালে সেই কাজটা করে তুলেছে আরও কঠিন। ৫ উইকেট হাতে রেখেও আজ বাকি ২৩ বলে ২৮ রানের বেশি যোগ করতে পারেনি নিউজিল্যান্ড। তবে টেলরের ৭৪ রানের গুরুত্ব তাতে কমে যায় না। দিন শেষে সেটাই যে নিউজিল্যান্ডকে এনে দিয়েছে জয়ের ভিত। ও হ্যাঁ, সেখানেও ছিলেন জাদেজা। দারুণ বল করেছেন, আজ দুর্দান্ত এক থ্রোতে রান আউট করেছেন টেইলরকে। পরে নিয়েছেন দারুণ ক্যাচ। একটা দিনে যা দরকার, তার সবই করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দিনটা যে নিউজিল্যান্ডের!