ভালভার্দের বার্সার জন্য যখন লা লিগাও 'যথেষ্ট' নয়
তিন ম্যাচ। সবকিছু জয় আর সবকিছু হারিয়ে ফেলার মধ্যে বার্সেলনার পার্থক্য ছিল তিন ম্যাচ। লা লিগা বহু আগেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। লিভারপুলের সঙ্গে সেমিফাইনালের প্রথম লেগে ৩-০ গোলে জিতে এক পা দেওয়া হয়ে গিয়েছিল ফাইনালেও। দ্বিতীয় লেগটা কোনোরকম পার করে দেওয়া, ফাইনাল আর কোপা ডেল রের ফাইনাল। এই তিনটি ম্যাচ জিতে গেলে সব জেতা হত বার্সেলোনার। সেরকম জায়গায় থেকেও পরে খেলা হয়নি চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে। লা লিগা জিতলেও কোপার ফাইনালে ভ্যালেন্সিয়ার কাছে হার পুরনো ক্ষতে জ্বালা বাড়িয়েছে আরও।
শেষ এগারো মৌসুমে অষ্টমবারের মতো লা লিগা জয়ের পরও বার্সেলোনার আগের মৌসুম তাই হয়ে গিয়েছিল ব্যর্থ। আর দায়টা স্বভাবতই সবচেয়ে বেশি গেছে এর্নেস্তো ভালভার্দের ওপর। ভালভার্দেকে ছাঁটাইয়ের গুঞ্জন উঠেছিল। অইরে অবশ্য বার্সেলোনা ভরসা রেখেছে ভালভার্দের ওপরই। প্রথমবার লিগ ও কোপা জিতেছিলেন, স্প্যানিশ কোচ দ্বিতীয় দফায় জিতেছেন শুধু লিগ। তৃতীয় দফায় শুধুমাত্র লিগ বা কোপা ডেলরের শিরোপাও হয়ত তাই যথেষ্ট হবে না তার জন্য। ভালভার্দের এতোদিনে জেনে যাওয়ার কথা এবারও বার্সার সাফল্য ব্যর্থতার পরিমাপক হবে চ্যাম্পিয়নস লিগ।
নতুন মৌসুম শুরুর আগে ক্লাব অধিনায়ক লিওনেল মেসি তাই পুরনো কথাগুলোই বলেছিলেন ক্যাম্প ন্যুতে। একই মাইক, একই কথা, একই দর্শক, একই সমর্থন, একই কোচ- সবকিছু জানা মেসির, এরপরও ঘোষণা দিয়েছেন সবকিছুর জন্য লড়াই করতে চায় তার দল। আর কোনো উপায়ও নেই, ঘোষণা দেওয়া না দেওয়া একই কথা। বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদরা তো প্রতি মৌসুমে সবকিছুর জন্যই লড়াই করে।
স্কোয়াড বিশ্লেষণ
গোলরক্ষক ও রক্ষণ
গোলরক্ষক মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগানকে নিয়ে সংশয়ের কিছু নেই। বদলি হিসেবে নেতো যোগ হয়েছেন এবার। দ্বিতীয় পছন্দের গোলরক্ষকও এই ব্রাজিলিয়ান।
রক্ষণে খুব বেশি মনোযোগ দেয়নি বার্সা এবারের দলবদলের মোউসুমেও। গতবার ক্লেমেন্ত ল্যাংলেট চমক দেখিয়েছিলেন। স্যামুয়েল উমতিতি ইনজুরিতে পড়ার পর তার জায়গায় নিয়মিত হয়ে গেছেন এখন ফ্রেঞ্চ সেন্টারব্যাক। গতিশীল ফরোয়ার্ডদের বিপক্ষে অবশ্য ল্যাংলেটের দুর্বলতা রয়েছে কিছুটা। সেক্ষেত্রে বড় ম্যাচগুলোতে উমতিতির খেলার সুযোগও থাকছে। জেরার্ড পিকের জায়গা মোটামুটি নিশ্চিত।
রাইটব্যাক পজিশনে ঘাটতি মেটাতে না পারলেও লেফটব্যাক পজিশনে জুনিয়র ফিরপোকে কিনে দারুণ এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বার্সা। মূলত বার্সার লেফটব্যাকদের আক্রমণে বেশ বড় ভূমিকা রাখতে হয়। আর জর্দি আলবা গত দুই মৌসুমে যথাক্রমে ৪৮ ও ৫৪ টি করে ম্যাচ খেলেছেন। তার ওপর দিয়ে যাওয়া বাড়তি ধকল মৌসুমের শেষদিকে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতে ভুগিয়েছে বার্সাকে। আর রাইটব্যাকে সেমেদো বা রবার্তো দুইজনের কেউই ধারাবাহিক না হওয়ায় আলবার ভুলগুলো আরও বেশি চোখে লেগেছে বার্সার ব্যর্থতায়। এবার অন্তত সেদিক থেকে কিছুটা স্বস্তি পেতে পারে বার্সার রক্ষণ।
মিডফিল্ড
ফ্রাঙ্কি ডি ইয়ং এরই মধ্যে নিজেকে প্রমাণ করে এসেছেন আয়াক্সে। এই তরুণ মিডফিল্ডারের ওয়ার্করেট, পাসিং, দূরদর্শীতা বার্সার খেলায় নতুন মাত্রা যোগ করবে নিঃসন্দেহে। সার্জিও বুস্কেটস কিছুটা রঙ হারিয়েছেন। তবে এবারও তার একাদশে থাকার কথা বেশিরভাগ ম্যাচেই। গত কয়েক মৌসুমে বার্সার মিডফিল্ড সৃজনশীলতার অভাবে ভুগেছে কাজের সময়। আর্থার প্রথম মৌসুমে আশার আলো দেখিয়েছেন, এবার পরের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পালা নিজেকে। মাঝমাঠে অপশনও কম নেই ভালভার্দের হাতে। আর্থার, ইভান রাকিটিচ, আর্তুরো ভিদালরাও আছেন।
ঐতিহ্যগতভাবেই বার্সা তিনজন মিডফিল্ডার খেলায় বেশিরভাগ সময়। বুস্কেটস নিজের ভূমিকায়, আর ডি ইয়ংয়ের সঙ্গে ডাবল পিভোট রোলে থাকতে পারেন আর্থার বা রাকিটিচ। ফিলিপ কৌতিনিয়োর কথা অবশ্য আলাদা করে বলতে হচ্ছে। বার্সার যোগ দেওয়ার পর দেড় বছর সময়ে নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি কৌতিনিয়ো। অল্প সময়েই তাই কৌতিনিয়োর ওপর থেকে মন উঠে গেছে বার্সা সমর্থকদেরও। তিনি ক্লাবে থাকবেন কী না সেটা নিশ্চিত নয় এখনও। শেষ পর্যন্ত থেকে গেলে দলের মূল কৌশলে তার ভূমিকাও হয়ত খুব বেশি থাকবে না এবার। অল্প যা সুযোগ পাবেন সেটা দিয়েই নিজেকে প্রমাণ করে জায়গা পেতে হবে একাদশে। কৌতিনিয়োর জন্য সময়টা কঠিনই।
আক্রমণ
লিওনেল মেসি, লুইস সুয়ারেজ, উসমান ডেম্বেলেদের নিয়ে এমনিতেই ইউরোপের অন্যতম বিধ্বংসী আক্রমণভাগের দাবিদার ছিল বার্সা। এবার সেটার মালিকানা কাগজে কলমে অন্তত নিজেদের করে নিয়েছে তারা। অ্যান্টোয়ান গ্রিযমানের সংযোজন বার্সার খেলায় নতুনত্ব যোগ করবে, বহুমুখীতাও বাড়াবে।
এর সঙ্গে আবার যোগ হতে পারেন নেইমারও। সে গুঞ্জণ তো বহু পুরনোই। সেক্ষেত্রে এই চারজনকে একসঙ্গে খেলাতে ভালো হ্যাপাই পোহাতে হবে ভালভার্দেকে।
আক্রমণ কখনই বার্সার সমস্যা ছিল না। এবারও সেরকমটা মনে না হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়াও দুস্কর। আর মেসি তো আছেনই, বাকিদের চেয়ে তো সেদিক থেকেও এগিয়ে বার্সা।
নতুন মৌসুমের আগে যা নিয়ে সংশয়...
১. মেসি নির্ভরতা কমবে এবার?
গত মৌসুমে বেশিরভাগ সময়ে মেসি একাই টেনেছেন বার্সেলোনাকে। দরকারের সময় নিজে যেমন নিষ্প্রভ ছিলেন, বাকি সতীর্থদের কাছ থেকেও সাহায্য পাননি। গত মৌসুমের দুর্দান্ত মেসির জন্য শুধুমাত্র লা লিগা জয়টা বড্ড বেমানানই ছিল। অন্তত লা লিগায় গত মৌসুমে নিজেকে ছাড়িয়ে আরও উঁচুতে মানদন্ড ঠিক করে দিয়েছেন মেসি। তবে চ্যাম্পিয়নস লিগের ব্যর্থতায় ঢাকা পড়ে গেছে সেসব কিছুই।
মেসি এবার আর এক বছর বেশি অভিজ্ঞ। আর এক বছর কম তরুণ। প্রতিনিয়ত ম্যাচ খেলে যাওয়ার ধকল ধীরে ধীরে পড়তে শুরু করবে মেসির খেলায়। বার্সেলোনাকেও তাই এবার মেসির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতার অন্ধবিশ্বাস থেকে বেরুতে হবে। মিডফিল্ডে দুই-একজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে একেবারে অ্যাটাকিং থার্ডে ফরোয়ার্ডদের বল সরাবারহ করার কাজটা গত দুই মৌসুমে নিয়মিত ভাবে করতে পারেনি বার্সা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেসিই করেছেন এ কাজটিও। এবার ডি ইয়ং থাকায় তার ওপর সে দায়িত্বটা তুলে দিতে পারেন মেসি। গ্রিযমান এসেছেন, সুয়ারেজ, ডেম্বেলেরা তো ছিলেনই। ভরসা করার মতো আরও খেলোয়াড় আছে বার্সার, তবে কাজের সময় কাজ হবে তো তাদের দিয়ে?
২. দানি আলভেজের জায়গায় শুধু হাহাকার...
গতবার বার্সেলোনার মৌসুম প্রিভিউয়ে একই কথা লিখা হয়েছিল প্যাভিলিয়নে। বছরঘুরেও সেই কথাই লিখতে হচ্ছে আরেকবার। রাইটব্যাক পজিশনে করিৎকর্মা একজনের অভাব লা লিগায় বার্সাকে ভোগাতে না পারলেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বরাবরই ভোগাচ্ছে তাদের। দুই বছরেও সেমেদো জায়গাটা নিজের করে নিতে পারেননি। অগত্যা মিডফিল্ডার রবার্তো নিয়মিত খেলছেন এই পজিশনে।
বার্সার নড়বড়ে রক্ষণের দায়ও অবশ্য কম নয়। গত মৌসুমে ম্যাচ প্রতি প্রতিপক্ষকে ১০.৬৪ বার গোলে শট করার সুযোগ দিয়েছে বার্সা। আর ম্যাচ প্রতি ০.৯৮ গোল হজম করেছে বার্সার রক্ষণ। এর আগের মৌসুমে এই সংখ্যাগুলোর অবস্থা ছিল আরও ভালো। অর্থাৎ পরিসংখ্যান বলছে গত মৌসুমে বার্সার অবনতিই হয়েছে রক্ষণে। এবারও রাইটব্যাক পজিশনে সেই পুরনো চেহারা নিয়েই নামছে বার্সা।
৩. কী শিখবেন ডি ইয়ং, গ্রিযমানরা?
ডি ইয়ং বিশ্বসেরা মিডফিল্ডারে পরিণত হওয়ার সবরকম গুণ নিয়ে এসেছেন বার্সায়। আক্রমণে ধারালো বার্সার খেলোয়াড়রা রক্ষণ ও ফর্মেশনের ব্যাপারে যথেষ্ট মনোযোগী না হলে কাজ বেড়ে যাবে ডি ইয়ংয়ের। গড়বড় পাকিয়ে গেলে ঝামেলাই আছে বার্সার। গত চার মৌসুমে বার্সার কেনা মোট ২৮ জন খেলোয়ারের ১৬ জন ইতিমধ্যে ক্লাব ছেড়ে গেছেন। শুধুমাত্র নিজের সেরাটা দেওয়াই না, বাকিদের কাছ থেকে ওই সমর্থনটুকুও দরকার হবে ডি ইয়ংদের।
গ্রিযমানের ব্যাপারটা অবশ্য আলাদা কিছুটা। বহু নাটকের পর অবশেষে ব্লগ্রানাদের জার্সি গায়ে চড়িয়েছেন তিনি। সুয়ারেজ নিজের সেরা সময়টা পার করে এসেছেন সেটা এখন দাবি করা যায়। গ্রিযমান নিজেকে প্রমাণের খুব বেশি সুযোগ পাবেন না। প্রাক মৌসুমে নতুন দলে নিজেকে ঝালিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। শুরু থেকেই নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে হবে তাকে। নইলে যেভাবে এসেছেন, সেভাবে দল থেকে জায়গা হারাতেও সময় লাগবে না।
৪. মুখস্থ্যবিদ্যার হাত থেকে রেহাই মিলবে?
আলবা দৌড়ে যাবেন, ওভারল্যাপ করবেন, মেসি তাকে পাস দিয়ে কাট করে ভেতরে ঢুকে যাবেন, ফিরতি পাসে গোল করবেন মেসি। বার্সেলোনার নিয়মিত দৃশ্য হয়ে গেছে এটা। সেটা অবশ্য সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে সে কথা অজানাই নেই প্রতিপক্ষেরও। আলবার সঙ্গে দুইজন ডিফেন্ডার জুটিয়ে দিয়েই অনেক ম্যাচে আটকে রাখা গেছে এই আক্রমণের নকশা। সেক্ষেত্রে একজন উইঙ্গার আলবার সঙ্গে থাকলে আরেকটু ধার বাড়ে বার্সার আক্রমণে। উইঙ্গার বলতে এই দলে আছেন ডেম্বেলে। অথচ একাদশে তার জায়গা পাওয়া নিয়েই আছে সংশয়।
৫. ভালভার্দের ওপর ভালো মন্দ?
এই দলে তারুন্য আছে, অভিজ্ঞতা আছে। আছেন খুব সম্ভবত বিশ্বের সেরা ফুটবলারটাও। তার সঙ্গে আছেন একগাদা তারকা। এই দলকে একাধিক উপায়ে খেলানো যায়। সেরা ফুটবলাররা নিজেদের ভেতর একটা সমন্বয় খুঁজে নেন। মৌসুমও লম্বা। সবকিছু বিবেচনার পর এই দলটাকে সামলানোর সামর্থ্য ভালভার্দের আছে কী না সেটা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক জুড়ে দেওয়া যায়। বার্সা সমর্থকেরা পছন্দ করুক যাই না করুক, তিনিই থাকবেন ডাগ আউটে। এখন প্রমাণটা করতে হবে আসলে ভালভার্দেকে। তার ক্যারিয়ারও বলছে না নাটকীয় কোনো সমাধান তিনি রাতারাতি আবিষ্কার করে ফেলবেন।
স্নায়ুক্ষয়ী মুহুর্ত আবারও আসবে। হয়ত সেটার ওপর নির্ভর করবে ভালভার্দের ভাগ্যও। আপনি জানেন আপনাকে জিততে হবে সব, সেটা জেনে মৌসুম শুরু করা পাহাড় সমান চাপ। সেই চাপ নিতে এই দলের খেলোয়াড়েরা। কিন্তু ভালভার্দে কী পারবেন এবার? নাকি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বেন আরেকবার?
প্যাভিলিয়ন প্রেডিকশনঃ চ্যাম্পিয়ন (লা লিগার বাকি দলগুলোর চেয়ে বার্সেলোনার বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে আছে বলে মনে করে প্যাভিলিয়ন। বার্সাকে নিয়ে যত সংশয় সেগুলো লা লিগা শিরোপা ধরে রাখার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে না বলেই আমাদের মত। তবে অ্যাটলেটিক মাদ্রিদ ও রিয়াল মাদ্রিদের ওপরও নির্ভর করছে অনেককিছু। তারা বার্সাকে চাপে রাখতে না পারলে বড় ব্যবধানেই আরও একবার লিগ জেতার কথা বার্সার।)