• ক্রিকেট, অন্যান্য
  • " />

     

    পানি পুরি বিক্রেতা থেকে লিস্ট 'এ' ক্রিকেটের সর্বকনিষ্ঠ ডাবল সেঞ্চুরিয়ান

    পানি পুরি বিক্রেতা থেকে লিস্ট 'এ' ক্রিকেটের সর্বকনিষ্ঠ ডাবল সেঞ্চুরিয়ান    

    মুম্বাইয়ে সন্ধ্যা নামতে বেশি দেরি নেই। আজাদ ময়দানে একদল ছেলে তখনো ক্রিকেট খেলে যাচ্ছে, দূরে বসে তাদের খেলা দেখছে বাবা-মায়েরা। ‘পানি পুরি নেবেন... পানি পুরি’, হঠাৎ পাশ থেকে আসা আওয়াজে মাথা ঘুরিয়ে সবাই তো অবাক। এই ছেলেটাই না দুপুরে খেলছিল তাদের সন্তানদের সাথে! একগাদা প্রশ্নের মুখে পড়ল ১১ বছরের পানি পুরি বিক্রি করা জাসাভি জাসওয়াল, জানা গেলো সেও নাকি এই মাঠেই ক্রিকেট খেলে। সকাল থেকে দুপর পর্যন্ত ক্রিকেট, বিকালে সেই মাঠেই পানি পুরি বিক্রি, জাসওয়ালের শৈশব-কৈশোরটা কেটেছে এভাবেই। সেই জাসওয়ালই বিজয় হাজরা ট্রফিতে মুম্বাইয়ের হয়ে ডাবল সেঞ্চুরি করে গড়েছেন নতুন রেকর্ড। লিস্ট এ ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি করা সর্বকনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান এখন ১৭ বছরের জয়সোয়াল। 

    জন্ম উত্তর প্রদেশের ভাদোহিতে, জাসওয়ালের বেড়ে ওঠাও সেখানে। ২০১৩ সালে ১২ বছর বয়সেই ভাগ্যের অন্বেষণে বাবার সাথে মুম্বাইয়ে চলে আসেন তিনি। বাবা মুম্বাইয়ে ছোট্ট একটি হার্ডওয়্যারের দোকান দেন, সেখানেই বাবাকে সাহায্য করতেন জাসওয়াল। বাবা-ছেলে থাকতেন জাসওয়ালের চাচার বাসায়। কিন্তু চাচার বাসাটাও ছিল ছোট, বাড়তি দুইজন মানুষের জায়গা হতো না সেখানে। চাচা হয়তো মুখ ফুটে কিছু বলতে পারতেন না, কিন্তু অসুবিধাটা ঠিকই বুঝতে পারছিলেন জাসওয়াল। 


    চাচার সাথে নিজের পানি পুরির দোকানে জাসওয়াল

     

    এতো কষ্টের মাঝেও জাসওয়ালের মাথায় ছিল ক্রিকেটের ভূত। মুম্বাইয়ের যে সরকারি স্কুলে পড়তেন, সেটার পাশেই ছিল আজাদ স্টেডিয়াম। স্কুলের বন্ধুরা মিলে প্রায় প্রতিদিন সকালেই নেমে যেতেন মাঠে। সেখানে গিয়ে জাসওয়ালের মাথায় এলো নতুন বুদ্ধি। বিকালে যদি স্টেডিয়ামে খেলতে আসা মানুষদের কাছে পানি পুরি বিক্রি করা যায়, তাহলে তো বাবার মাথা থেকে টাকার দুশ্চিন্তাটা একটু কমবে। যা ভাবা সেই কাজ, একাই পানি পুরির সবকিছু যোগাড় করে প্রতি বিকালে বিক্রি শুরু করলেন জাসওয়াল। এর মাঝেই বাবা ফিরে গেলেন গ্রামে। চাচার বাড়ি ছেড়ে আজাদ স্টেডিয়ামকে নিজের ‘বাড়ি’ বানিয়ে ফেললেন জাসওয়াল। 

    কিন্তু স্টেডিয়ামে থাকার জায়গা কোথায়? জাসওয়াল শোনালেন সেই গল্পটাই, ‘আমি চাচার বাড়ি ছেড়ে স্টেডিয়ামেই থাকা শুরু করলাম একটা সময় পর। সেখানে গ্রাউন্ডসম্যানদের একটা তাঁবু ছিল, অনেকেই রাতে সেখানে থাকতেন। তাদের বলে আমিও থাকা শুরু করলাম। নিজের খাবার নিজেই রাঁধতাম, একটা চুলা ছিল, সেখানেই সবকিছু করতে হতো।’ 

    যাদের সাথে স্কুলে পড়তেন, মাঠে খেলতেন, তাদের কাছেই পানি পুরি বিক্রি করতে কেমন লাগতো? জাসওয়াল বলছেন, কাজটা বাধ্য হয়েই করতে হতো তাকে, ‘পেটের দায়ে যদি বন্ধুদের কাছে পানি পুরি বিক্রি করতে হয়, তাহলে সেটা কারোরই ভালো লাগবে না। বন্ধুরা অবশ্য এটা নিয়ে মজা করতো, সেটা কখনো 'খোঁচার' পর্যায়ে যায়নি। এখন আমি মুম্বাইয়ের হয়ে খেলি, তারা আরও বেশি মজা করে আগের ঘটনাগুলো নিয়ে।’  

    যে কোচ বদলে দিয়েছেন জাসওয়ালের জীবন 

     

    দুপর পর্যন্ত ক্রিকেট, বিকালে সেই মাঠেই পানি পুরি বিক্রি; জাসওয়ালের জীবনটা চলছিল একই রুটিনে। সেটা পাল্টে গেলো আজাদ স্টেডিয়ামে জলওয়া সিংয়ের আগমনের পর। মুম্বাইয়ের এই কোচের সুনজর পড়ল জাসওয়ালের ওপর। একটা সময় নিজেও এসবের মুখোমুখি হয়েছিলেন জলওয়া সিং, তাই জাসওয়ালের জীবনটা পাল্টে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। জাসওয়াল বলছেন, তাঁর অর্জনের সব কৃতিত্ব এই কোচেরই, ‘কেউ একজন স্যারকে আমার আর্থিক অবস্থার কথা জানায়। তিনি নিজেও নাকি শৈশবে আমার মতো গরিব ছিলেন। তিনিও টাকা ছাড়াই মুম্বাইয়ে এসেছিলেন, কেউ তাকে সাহায্য করেনি। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, তোমার সাথে এরকম হতে দেবো না। তিনি আমাকে নিজের বাড়িতে রাখেন, ক্রিকেটের সবকিছু শেখান। আমার সবকিছুতেই তাঁর সাহায্য ছিল। আমি আজ যা, সবটা তাঁর কল্যাণেই।’ 

    এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি জাসওয়ালেকে। ছোটবেলা থেকেই অন্য দশটা ভারতীয় শিশুর মতো ছিলেন শচীন টেন্ডুলকারের ভক্ত। শচীন মুম্বাইয়ের হয়ে খেলতেন, খেলেছেন আজাদ স্টেডিয়ামেও। তাঁর খেলা দেখেই মুম্বাইয়ের হয়ে খেলার প্রতি ঝোঁক ওঠে জাসওয়ালের। সেই স্বপ্নটা সত্যি হয়েছে, মুম্বাইয়ের যুব দলের হয়ে স্কোয়াডে নিয়মিত হয়েছেন ব্যাটিং নৈপুণ্য দেখিয়ে। সেই সুবাদে সুযোগ পেয়ে যান ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলেও।

    জাসওয়ালে স্পটলাইটে প্রথমবার আসেন গত বছরের অক্টোবরে। ঢাকাতে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপের ফাইনালে শ্রীলংকার বিপক্ষে ৮৫ বলে ১১৩ রান করে ভারতকে শিরোপা এনে দেন। ঐ টুর্নামেন্টে ৩১৮ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও হন তিনি। এই বছরের জুলাইয়ে ইংল্যান্ড হওয়া ত্রিদেশীয় অনূর্ধ্ব-১৯ টুর্নামেন্টে সাত ইনিংসে ২৯৪ রান করেন জাসওয়াল। ফাইনালে বাংলাদেশের বিপক্ষে হাফ সেঞ্চুরি করে দলকে শিরোপা জিততে সাহায্য করেন। কদিন আগে খেলেছেন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ২৩ দলের বিপক্ষেও।

    এবারের বিজয় হাজরা ট্রফিতে অবিশ্বাস্য ফর্মে আছেন জাসওয়াল। পাঁচ ইনিংসে করেছেন তিনটি সেঞ্চুরি, এখন পর্যন্ত রান ৫০৪। গতকাল বেঙ্গালুরুতে ঝাড়খন্ডের বিপক্ষে ১৫৪ বলে ২০৩ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেছেন জাসওয়াল। লিস্ট এ ক্রিকেটে সবচেয়ে কম বয়সে ডাবল সেঞ্চুরি করা ক্রিকেটার হলেন জাসওয়াল। তিনি ভেঙেছেন ৪৪ বছরের পুরনো রেকর্ড। ১৯৭৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যালান ব্যারো ২০ বছর ২৭৫ দিনে লিস্ট এ ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন। জাসওয়াল সেটা করেছেন ১৭ বছর ২৯২ দিনে। জাসওয়াল ছাড়া ২০০০ সালের পর জন্ম নেওয়া আর কেউই এখন পর্যন্ত লিস্ট এ ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি করতে পারেননি। ঘরোয়া ওয়ানডে ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি করা তৃতীয় ভারতীয় ব্যাটসম্যান হলেন তিনি।

    লিস্ট এ ক্রিকেটে বিশ্বরেকর্ডের পর

     

    আগামী আইপিএলের জন্য হতে যাওয়া নিলামের ড্রাফটে নাম আছে জাসওয়ালেরও। কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি যদি তাকে বড় অঙ্কে কিনে নেয়? জাসওয়ালের অবশ্য টাকা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই, ‘আমার নিজের কিংবা পরিবারের কারো অতিরিক্ত চাওয়া-পাওয়া নেই। আমি ভালো ক্রিকেট খেলি, এটাই সবাই চায়। আমি ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে পারলে সেটাই হবে সবচেয়ে বড় পাওয়া। থাকার জায়গা ও খাবারের নিশ্চয়তা, এটা ছাড়া আর বেশি কিছুই আমার পরিবারের কেউ চাননি কখনো।’ 

    এখনো আগের মতো নিয়মিত আজাদ স্টেডিয়ামে যান জাসওয়াল, সকাল থেকে সন্ধ্যা সেখানেই কেটে যায়। মাঝে সাঁঝে ঢু মারেন সেই গ্রাউন্ডসম্যানের তাঁবুতে। মাঠের আশেপাশে অনেক শিশুকেই হয়তো পানি পুরি বিক্রি করতে দেখেন। মনের অজান্তেই হয়তো চোখটা ভিজে আসে তাঁর। জাসওয়ালে সেই ভেজা চোখে হয়তো দেখতে পান, একদিন জাতীয় দলের জার্সি পরেই আসবেন এই স্টেডিয়ামে।