• সাকিবের নিষেধাজ্ঞা
  • " />

     

    সাকিব আল হাসান : নিন্দিত কিংবা নন্দিত নরকে

    সাকিব আল হাসান : নিন্দিত কিংবা নন্দিত নরকে    

    সাকিব আল হাসানের হাঁটার গতিটা ধীর হয়ে গেল, একঝাঁক ক্যামেরা আর ফ্ল্যাশলাইট ঘিরে ধরেছে তাকে। ক্যামেরাম্যানদের বেষ্টনিতে আটকে গেলেন তিনি। 

    গুলশানের এক হোটেলে সংবাদ সম্মেলন ও মিটিং শেষ করে মিরপুরের বিসিবি হেডকোয়ার্টারে একে একে আসতে শুরু করেছেন তখন ক্রিকেটাররা, একটা করে গাড়ি আসতেই জ্বলে উঠছে ফ্ল্যাশ, ক্যামেরা তাক হচ্ছে সেদিকে। সাকিবের প্রতি সবার ঝোঁকটা আলাদা করে চোখে পড়ার মতো। ক্রিকেটারদের ধর্মঘট নিয়ে উদ্ভুত সঙ্কট কাটেনি তখনও। অবশেষে আলোচনায় রাজি হয়ে ক্রিকেটাররা এসেছেন, বোর্ড প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান ও অন্যান্য বিসিবি পরিচালকরা আগে থেকেই অপেক্ষা করছেন। 

    ২৩ অক্টোবর, বুধবার। 

    সাকিব বিসিবিতে এলেন রাত ৯টার দিকে। বিসিবির সঙ্গে তাদের মিটিং চললো প্রায় ঘন্টা দুয়েক। ধর্মঘট শেষের ঘোষণা দিলেন সাকিব, তবে ক্রিকেটারদের চোখেমুখে ঠিক সন্তুষ্টি নেই তখন। বিসিবি পরিচালকদের কনফারেন্স রুম তখন জনাকীর্ণ, হট্টগোলে ভরপুর। সাংবাদিকদের ব্রিফ শেষ করে এক কোণে সাকিবের সঙ্গে দাঁড়িয়ে তামিম ইকবাল, কিছু একটা নিয়ে আলোচনা চলছে তাদের। যোগ দিলেন মাহমুদউল্লাহ। বিসিবি প্রেসিডেন্টের কক্ষ পেরিয়ে এরপর তারা ছুটলেন শের-ই-বাংলার ড্রেসিংরুমের দিকে, সেখানে আরেক দফা মিটিং চললো ক্রিকেটারদের। বিসিবির কর্তাব্যক্তিরা বিদায় নিলেন একে একে, সঙ্কট কেটে গেছে আপাতত। 

    ২৩ তারিখ গড়িয়ে ২৪ তারিখ হয়ে গেছে ততক্ষণে, সাকিবসহ অন্যান্য ক্রিকেটাররা মাঠ ছাড়লেন আরও ঘন্টাখানেক আলোচনার পর। মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহদের মতো বেরিয়ে গেল সাকিবের গাড়িটাও। এক ঐতিহাসিক আন্দোলনের নেতা ছাড়লেন শের-ই-বাংলার চত্বর। সামনে ভারত সফর, পিছিয়ে যাওয়া জাতীয় ক্রিকেট লিগ। বিসিবির আশ্বাস, বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসের স্মরণীয় দিনের শেষ। 

    সাকিব কি তখন জানতেন, শুধু ভারত সফর কেন, তিনি মিস করতে চলেছেন আরও অনেক কিছুই? 
     

    ****


    ঢাকায় অক্টোবর মাসটা ছলনাময়ী কিছুটা। শীতের আভাস পাওয়া যায় শুধু, শীত আর নামে না।

    ২০১৬ সালে অক্টোবরের ৩০ তারিখের সেই বিকেলটাও ছিল প্রায় এমনই। মিরপুরে ড্রেসিংরুম থেকে নিজের মোবাইল ফোনটা হাতে করে বেরিয়ে এলেন সাকিব, পরনে ঝকঝকে টেস্ট-কিট। বিকেল গড়িয়ে গেছে, সন্ধ্যা নামছে। একটু আগে বাংলাদেশ পেয়ে গেছে নিজেদের ঐতিহাসিক জয়, ইংল্যান্ডকে তিন দিনের ব্যবধানেই টেস্টে হারিয়ে দিয়েছে তারা। সে মুহুর্তটা ফ্রেমবন্দী করে রাখতে অফিশিয়াল ফটোসেশন হবে। সাংবাদিকদের অভিনন্দনের জবাব দিয়ে সাকিব জানতে চাইলেন, তাদের ছবি কোনদিকে তোলা হচ্ছে। যেন হুট করে দলছুট হয়ে পড়েছেন তিনি। 

    চট্টগ্রামেও বাংলাদেশ প্রায় হারিয়ে দিয়েছিল ইংল্যান্ডকে, শেষ পর্যন্ত হয়নি। সে আক্ষেপ এসে ঘুচেছে ঢাকায়। প্রেসবক্সে বসে প্রথমবারের মতো টেস্ট ‘কাভার’ করা কারও ঘোরলাগা কাটেনি তখনও, সাকিবের সে প্রশ্ন সেই বিস্ময়েরই আরেক ধাপ। সেই টেস্টটা হয়ে আছে মেহেদি হাসান মিরাজ নামের এক অফস্পিনারের আগমনী বার্তা হয়ে। দ্বিতীয় ইনিংসে মিরাজ নিয়েছিলেন ৬ উইকেট, সাকিব নিয়েছিলেন ৪টি। তবে সাকিবকে উপেক্ষা করার সাধ্য কার! বেন স্টোকসকে বোল্ড করার পর তার দেওয়া সেই স্যালুট ঠিকই ঘুরে বেড়িয়েছিল এখানে-সেখানে। 
     


    বিস্ময়! থাকবে এখনও?


    তিন বছর পর অক্টোবরের আরেকটি বিকেল গড়িয়ে যাওয়া সন্ধ্যায় মিরপুরে অনেক ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করা সাংবাদিকরা হুট করেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন আইসিসি থেকে পাওয়া এক মিডিয়া রিলিজে। সেখানে সাকিবের দন্ড উল্লেখ করেছে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা, অনৈতিক প্রস্তাবের তথ্য গোপন করে ফেঁসে গেছেন সাকিব। বিসিবির অভ্যর্থনা, লাউঞ্জ আর এখানে-সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাংবাদিকদের শোরগোল বেড়ে গেছে। দিনভর যে অনিশ্চিত অথচ প্রায় অনিবার্য এক ঘটনার অপেক্ষা, সেটি অফিশিয়ালি ঘটে গেছে। 

    শীতের আভাসও তখন ছুট দিয়েছে যেন, শুধুই উত্তাপ ছড়াচ্ছে সেই মিডিয়া রিলিজ আর সাত পৃষ্ঠার এক সিদ্ধান্তের নথি। হয়তো সাকিবের মোবাইল ফোনেই ইন্সটলড থাকা হোয়াটসঅ্যাপে দীপক আগারওয়ালের সঙ্গে এক কনভারসেশনের মূল পয়েন্টগুলি নীল রঙে রাঙানো, সাকিবের শাস্তিকে ‘যথাযথ’ করে তুলতে যেগুলো যথেষ্ট হয়েছে আইসিসির দুর্নীতি বিরোধী কমিশনের। 
     

    ****


    ২০১৭ বিপিএলে সাকিব ছিলেন সর্বোচ্চ উইকেট-সংগ্রাহক।  

    সে বিপিএলে চলার সময়ই নভেম্বরের মাঝামাঝি আগারওয়ালের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ আদান-প্রদান শুরু সাকিবের। আগারওয়াল তার দেখা চাইলেন। কী কারণে, সেটি নিশ্চিত নয়। 

    পরের বছরের জানুয়ারিতে শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়েকে নিয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজ বাংলাদেশের। জিম্বাবুয়েকে উড়িয়ে দেওয়া ম্যাচে বেশ কিছুদিন পর ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতলেন সাকিব। ম্যাচশেষের প্রেস কনফারেন্সে এলেন তিনি। পরের ম্যাচেও তাই। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে তামিম ইকবাল সেদিন পূর্ণ করেছিলেন ১১ হাজার রান, সাকিবের হয়েছিল ১০ হাজার। 

    চন্ডিকা হাথুরুসিংহে সে সিরিজে শ্রীলঙ্কার কোচ হয়ে এসেছিলেন, যে হাথুরুসিংহে বাংলাদেশকে বিদায় বলেছিলেন নাটকীয়ভাবে। সবার কাছেই প্রায় ছুটে যাচ্ছিল তাই হাথুরুসিংহে সম্পর্কিত প্রশ্ন। সাকিব জবাব দিলেন, “আমরা (হাথুরুর বিষয়টা) মাথায় নেই না, এটা আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। আমি চাই, আপনারাও যেন মাথায় না নেন। এটা আমাদের জন্য আরও ভালো।”


    আরও পড়ুন : ভারতীয় সেই জুয়াড়ির সাথে যে কথোপকথন হয়েছিল


    সাকিবের সেদিন আগারওয়ালের কাছ থেকে হোয়াটসঅ্যাপে আরেকবার মেসেজ পেয়েছিলেন সাকিব। সে মেসেজে অভ্যন্তরীন তথ্য সাকিব দেবেন কিনা, সে প্রশ্ন ছিল সেই জুয়াড়ির। সাকিব আইসিসির দুর্নীতি বিরোধী কমিশনকে সেটি জানানোর ব্যাপারটা মাথায় নেননি। এরপর ২৩ জানুয়ারি পেয়েছিলেন আরেকটি ‘প্রস্তাব’। সাকিব সেটিও জানাননি। 

    সে সিরিজের ফাইনালেই আঙুলে চোট পেয়ে ছিটকে গিয়েছিলেন বেশ কিছুদিন। এরপর নিদাহাস ট্রফিতে উড়ে গিয়ে খেলেছিলেন, সাকিবের সেই আঙুলের চোট নাকি পরে হয়ে দাঁড়িয়েছিল ক্যারিয়ারের জন্যই হুমকি। 

    সাকিব এরপর খেলতে গিয়েছিলেন আইপিএল। সেখানেও ‘প্রস্তাব’ পেয়েছিলেন ওই জুয়াড়ির কাছে। বিস্ময়করভাবে সাকিব এবারও সেটি জানাননি আইসিসি বা সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি-বিরোধী কাউকেই। বরং, এবার আগারওয়ালের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন তিনি। 

    এসিইউকে দেওয়া স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, এরপরই আগারওয়ালকে ‘গোলমেলে’ মনে হয়েছিল সাকিবের। তবে তারপরও কেন তিনি সেটি রিপোর্ট করেননি, বিস্ময়ের পরের ধাপ সেটিই। কেন করেননি, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আপনি তাই তলিয়ে যেতে পারেন বিষণ্ণতায়।
     

    ****


    ২০১৯ সালের ইংলিশ গ্রীষ্মও ছিল ঘোরলাগা বিস্ময়ের পরের ধাপ। মানব-কল্পনাকে হার মানানো এক বিশ্বকাপ ফাইনাল, বেন স্টোকসের হেডিংলি রূপকথা বা স্টিভ স্মিথের অতিমানব হয়ে ওঠা-- নিজের ছাই থেকে জেগে ওঠা তার অ্যাশেজে। বাংলাদেশ ক্রিকেট অনুসারীদের জন্য অবশ্য এ গ্রীষ্মে আলাদা একটা জায়গা বরাদ্দ সাকিবের জন্য। বিশ্বকাপে প্রায় শেষে থেকে শেষ করা বাংলাদেশের হয়েও যে সাকিব হয়ে উঠেছিলেন অন্য কিছু। 

    হয়তো অনেকেরই মুখস্থ আছে সাকিবনামা- এতো রান, অতো উইকেট। সাকিব সে টুর্নামেন্টে হয়ে উঠেছিলেন আপনার স্বপ্নের সমান বড়। ধারাভাষ্যে সাকিবকে বলা ইয়ান স্মিথের বলা ‘অফিশিয়ালি হিউম্যান’ কথাটা আপনার সে স্বপ্নের পরিধিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল হয়তো বেশ। 
     


    বিশ্বকাপের পর থেকেই সাকিব গণমাধ্যমে সরব হয়ে উঠলেন দেশের ক্রিকেট কাঠামো ও সংস্কৃতি নিয়ে। হুট করেই হাজির ২১ অক্টোবর। দুপুর ৩টায় সাকিবের নেতৃত্বে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে গেলেন ক্রিকেটাররা।  

    বাংলাদেশের ক্রিকেটের ঘরোয়া কাঠামো থেকে শুরু করে বিসিবির কেন্দ্রীয় চুক্তি-- ১১ দফা থেকে বেড়ে হওয়া ১৩ দফা দাবিতে যেন ফুটে উঠলো দেশের ক্রিকেটের দীর্ঘদিনের না পাওয়ার আক্ষেপ। পরের প্রজন্মের ক্রিকেটারদের ভবিষ্যতের জন্য সাকিব হয়ে উঠলেন যেন অনবদ্য এক স্থপতি। 

    ধর্মঘটের সঙ্কট কাটলো ২৩ অক্টোবরের ওই মধ্যরাতে এসে। একদিন পর প্রস্তুতি ক্যাম্পের প্রথম দিন অনুপস্থিত থাকলেন সাকিব। পরদিন এলেন। এরপর দুটি প্রস্তুতি ম্যাচ। প্রথম ম্যাচের একাদশে সাকিবের নাম থাকলেও খেললেন না তিনি, খেললেন না পরদিনও। আরেকদফা ধোঁয়াশা। যে ধোঁয়াশা পরে রূপ নিল ধোঁয়াটে এক বোমায়, যাতে ছেয়ে গেল বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম এক উজ্জ্বল দিক! 
     

    ****


    সাকিবকে রীতিমতো ‘পাহারা’ দিয়ে পার করাতে হলো বিসিবির হেডকোয়ার্টারের অভ্যর্থনা কক্ষ। ক্যামেরার ফ্ল্যাশলাইটের প্রখরতার সঙ্গে এদিন বেড়েছে সংবাদকর্মীদের ভীড়, সঙ্গে মনযোগটাও। 

    ২৯ অক্টোবর, মঙ্গলবার। সপ্তাহ না পেরুতেই আবারও ক্যামেরার ঝলকানি আর মনযোগের পুরোটা সঙ্গী করে বিসিবিতে এলেন সাকিব, এবার রাত ৮টার দিকে। ততক্ষণে তার নিষেধাজ্ঞা নিশ্চিত হয়ে গেছে। এর আগেও নিষেধাজ্ঞার খড়গ নেমেছে তার ওপর, তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। এবারও তার অপেক্ষায় বোর্ড প্রেসিডেন্ট ও অন্যান্যরা।

    তাদের সঙ্গে ১৫ মিনিটের আলোচনা শেষে বেড়িয়ে এসে মুখোমুখি হলেন সংবাদমাধ্যমের। আইসিসিকে দেওয়া বিবৃতিটাই পড়ে শোনালেন বাংলায়, সঙ্গে যোগ করলেন ফিরে আসার প্রত্যয়। সাড়ে ৮টার দিকে বেরিয়ে গেলেন বিসিবি থেকে, বোর্ড প্রেসিডেন্ট, অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে। গিয়ে উঠলেন তার গাড়িতে, তখনও একঝাঁক ক্যামেরা তাক করা সেদিকে। সাকিব আরেকবার ছেড়ে গেলেন শের-ই-বাংলার চত্বর। হয়তো এক বছরের জন্য। তিনি বিসিবি ছাড়ার আগেই ভারত সফরের জন্য টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে নতুন অধিনায়ক ঘোষণা করেছে বিসিবি। 

    আগের বুধবার সাকিব এ চত্বর ছেড়েছিলেন অঘোষিত ‘নেতা’ হয়ে। এবার ছাড়লেন অফিশিয়াল নেতৃত্ব খুইয়ে। স্টেডিয়ামের দুই নম্বর গেটের বাইরে তার সমর্থকরা চিৎকার করছেন তখন তার নাম ধরে। যে চিৎকার মাঠে তিনি শুনেছেন অসংখ্যবার। আপাতত মাঠে নামা হচ্ছে না তার, অন্তত এক বছরের জন্য। 

    অক্টোবরে শীতের আভাস মেলে, শীত মেলে না। অক্টোবর সাকিবকে ‘নেতা’ বানায়, নেতৃত্ব কেড়ে নেয়। বাংলাদেশ ক্রিকেটে তার উচ্চাসনটা টলিয়ে দেয়। দিন ছয়েকের ব্যবধানে বদলে যায় কতো কিছু! অক্টোবরে শীতের বিষণ্ণতা জেঁকে ধরতে চায়।

    সাকিব হারিয়ে যান এক বছরের নিষেধাজ্ঞার ‘নরকে’। সেই নরক নিন্দিত, কিংবা নন্দিত।