সাকিব আল হাসানের নিষেধাজ্ঞা: কিছু ভুল, কিছু শিক্ষা ও কিছু প্রশ্ন
পুরো ব্যাপারটা আপনার কাছে এখনও অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। এখনও হয়তো মনে হতে পারে, আপনি ভুল শুনেছেন বা জেনেছেন। ঘুম থেকে উঠলেই ভেঙে যাবে দুঃস্বপ্নটা। সাকিব আল হাসান জুয়াড়ির কাছ থেকে পাওয়া প্রস্তাব আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগকে (এসিইউ) তিন তিন বার জানাননি, সেটা বিস্ময়ের বললেও কম হয়ে যায়। এবং সেই ‘গাফিলতির’ জন্য এক বছর ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হতে হচ্ছে (নিয়ম মেনে না চললে সেটা দুই বছর হতে পারে) সাকিবকে- বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক সম্ভবত আর কিছু হতে পারে না। এর মধ্যেও কিছু ‘যদি, কিন্তু’ আছে, তবে তার আগে কয়েকটা ব্যাপার নিয়ে কোনো ধোঁয়াশা থাকা উচিত নয়।
প্রথমত, সাকিবের এই পরিণতি বা শাস্তির দায় পুরোপুরি তার। এই ঘটনার শুরু দুই বছর থেকে, এরপর মাস চারেকের মধ্যে চার বার সাকিবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন দীপক আগরওয়াল নামের ভারতীয় ওই জুয়াড়ি। ক্রিকেটের অন্ধকার জগতে আগরওয়ালের নামটা অজানা থাকার কথা নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে ভারতের ঘরোয়া লিগে দুজন ক্রিকেটার আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছিলেন। এরকম কুখ্যাত একটা লোক যখন সাকিবের সঙ্গে যোগাযোগ করল, কেন প্রথমবারেই সেটা এসিইউকে জানালেন না সাকিব? এখানে সম্পূরক প্রশ্ন, সাকিব আর আগরওয়ালের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া সেই রহস্যময় লোকটা কে? এই একই লোক কি আর কোনো ক্রিকেটারকে দীপক বা এরকম কারও সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন? এই লোকটার পরিচয় বের করার দায়িত্ব কি বিসিবির নয়?
দ্বিতীয়ত, ভুল একবার করলে সেটা অসতর্কতা, দুইবার করলে সেটা গাফিলতি বা অবহেলা। আর তৃতীয়বার করলে সেটা সম্ভবত অবজ্ঞা। সাকিব যখন তৃতীয়বারেও এসে আগরওয়ালের প্রস্তাবের কথা আইসিসিকে বললেন না, তার মনে আসলে কী খেলা করেছিল? অ্যাকাউন্টের কথা বলায় তিনি দেখা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা কি নিছক বাজিয়ে দেওয়ার জন্য? কাউকে কি সন্দেহ হয়েছিল তার? নাকি অন্য কোনো চাপ ছিল? সেটা যে কারণেই হোক, এত দেরিতে এসে সাকিবের সন্দেহ হওয়াটা আরও বেশি প্রশ্ন জন্ম দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যে খেলোয়াড় এক যুগেরও বেশি সময় কাটিয়ে দিয়েছেন, দেশ-বিদেশে সবরকম ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট খেলেছেন- তার মতো অভিজ্ঞ একজনের এত পরে কেন সন্দেহ হলো? তার ওপর যেসব হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা মুছে দিয়েছেন সাকিব, সেখানে কী ছিল? প্রশ্ন থেকে উঠছে আরও অনেক প্রশ্ন।
তৃতীয়ত, এমন নয় যে সন্দেহ হলে সেটা কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে সেটা সাকিবের মাথায় ছিল না। প্রতিটি সিরিজের আগে এসিইউর সঙ্গে কীভাবে সহায়তা করতে হবে, সেটা নিয়ে আলাদা করে ব্রিফিং করা হয় ক্রিকেটারদের। প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে দলের সঙ্গে আইএসইউর একজন সার্বক্ষণিক যুক্ত থাকেন। কী করতে হবে, কী করতে হবে না- সেটা বার বার মনে করিয়ে দেওয়া হয়। আর আইসিসির বিভিন্ন শিক্ষামূলক কর্মসূচিতে এসব নিয়ে কথা তো বলতে হয়ই। এত কিছুর পরও সাকিব তিনবার এই ব্যাপারটা ভুলে গেলেন কীভাবে?
চতুর্থত, তারপরও ভুল হতে পারে ধরে নিয়েও সাকিবের কাছ থেকে এটা আরও বেশি অপ্রত্যাশিত। নয় বছর আগে একবার প্রচারমাধ্যমকেই বলেছিলেন, তাকে এমন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ২০১৩ সালে বিপিএলে স্পট ফিক্সিং কেলেংকারিতে বাংলাদেশ ক্রিকেট যখন টালমাটাল, সাকিব তখন নিয়েছিলেন শক্ত ভূমিকা। নিজে সাক্ষী দিয়েছিলেন ট্রাইবুন্যালে। মোহাম্মদ আশরাফুলকে বাংলাদেশ দলে যারা দেখতে চান না, তাদের মধ্যে সাকিবের অনড় ভূমিকার কথাও সতীর্থদের অনেকের জানা। সেখানে নিজেই এই ব্যাপারে এত বড় ভুল কীভাবে করলেন, সেটা আরও বড় প্রশ্ন।
পঞ্চমত, সাকিব যা-ই করে থাকুন, সেটার জন্য বিসিবি বা বিসিসিআইয়ের আঁতাত খোঁজা আপাতত নিরর্থক। আইসিসির দুর্নীতি দমন কমিশন কাজ করে নিরপেক্ষভাবে, এখানে বিসিবির অন্তত হস্তক্ষেপ করার সুযোগ খুব একটা নেই। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অপেশাদারির অনেক উদাহরণ আছে, কিন্তু এই জায়গায় তাদের করার ছিল সামান্যই। মাত্র কিছুদিন আগে আইসিসি সভায় গিয়ে ব্যাপারটি জানতে পেরেছেন বিসিবি প্রধান। ততদিনে এই তদন্ত প্রায় শেষের পথে। বিসিবির পক্ষ থেকে এই সাজা অন্তত ভারত সিরিজ পর্যন্ত পেছানোর চেষ্টা করা হয়েছে কি না, সেই উত্তর দেওয়া কঠিন। এখানে বিসিবির কোনো ঔদাসীন্য ছিল কি না, সেটাও বলা মুশকিল। তবে বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান গত কিছুদিনের ঘটনাপ্রবাহে সাকিবকে ফাঁসানোর জন্য এই ষড়যন্ত্র করেছেন, সেরকম কিছু ভাবাটা বোকামি। বিসিসিআইও জানিয়েছে, তারা এই ব্যাপারে তেমন কিছু জানত না। আইপিএলের ওই ঘটনার তদন্তও এসিইউই করেছে। সময়টা এমন কাকতাল হয়ে গেছে, সেটার পেছনে অন্য কিছু গন্ধ পাচ্ছেন অনেকে। তবে আপাতত সেটি কাকতাল বলেই ধরে নিতে হবে।
ষষ্ঠত, সাকিব যখন নিজ মুখে এবং আইসিসির কাছে বার্তায় স্বীকার করেছেন, তিনি ভুল করেছেন ও শাস্তি মেনে নিয়েছেন, তখন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব খোঁজা আরও অর্থহীন। সাকিব অন্যায়ের সঙ্গে আপোসহীন বরাবরই, সেজন্য তাকে আগে মূল্যও দিতে হয়েছে। সোজাসাপটা কথা বলেন বলে চক্ষুশূল হয়েছেন অনেকের। সেখানে সাকিবের সরাসরি স্বীকার করে নেওয়ার পর তার কোনো শাস্তি হওয়া উচিত না, এমন ভাবনা তাই হাস্যকর। প্রশ্ন করতে পারেন, শাস্তিটা কি বেশি হয়ে গেল না? তবে আইসিসির নিয়মে ছিল নিষেধাজ্ঞা হতে পারে ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর। সেখানে এক বছর ন্যুন্যতম শাস্তি থেকে খুব বেশি নয়। আর পুরো ব্যাপারটা চলেছে আইনের গতিতে, এখানে কারও বিবেচনায় সাকিবের শাস্তি কম বা বেশি হওয়ার সুযোগও নেই।
এসব প্রশ্ন আর ভুলের পরও থাকে কিছু কথা। সাকিব যা করেছেন, সেটা যদি কোনোভাবে পরিস্থিতির শিকারও হয়ে থাকেন, সেটা বেরিয়ে আসবে সময় হলেই। তিনি নিজেই হয়তো বলবেন। সাকিব যে ধাতুতে গড়া, অন্যায় মেনে নেওয়ার মতো লোক তিনি নন। আর ক্যারিয়ারে এমন কিছু যে আগে দেখেননি তাও নয়। ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন, চোট ছিটকে দিয়েছে লম্বা সময়ের জন্য। প্রতিবারই আগের চেয়ে আরও দারুণভাবে ফিরেছেন। আর এক বছর বিরতির পর কীভাবে ফিরতে হয়, স্মিথ-ওয়ার্নারের সেই উদাহরণ তো চোখের সামনেই। এই সময়ও দেখতে দেখতে কেটে যাওয়ার কথা। সাকিব যে ভুল করেছেন, সেটার আত্মশুদ্ধির জন্যও তো কিছু সময় দরকার তার। এই ভুল থেকে শিক্ষা তো নেবেন, সতীর্থদের কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও অমন কিছু না করেন সেটাও মাথায় থাকতে হবে তার। এক বছর পর যখন ফিরবেন, দায়িত্বটাও তাই অনেক দিক দিয়েই অনেক বেড়ে যাবে সাকিবের।