• ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ
  • " />

     

    টটেনহামে মরিনহোর যত চ্যালেঞ্জ

    টটেনহামে মরিনহোর যত চ্যালেঞ্জ    

    ২০ নভেম্বর বাংলাদেশ সময় মধ্যরাতে টটেনহাম হটস্পার ম্যানেজার মাউরিসিও পচেত্তিনোর বরখাস্ত হওয়ার খবরে আপনি যতটা না অবাক হয়েছিলেন, তার চেয়েও হয়তো বেশি হয়েছেন পরদিন দুপুরেই যখন হোসে মরিনহোকে নতুন ম্যানেজার হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে স্পার্স। প্রায় বছরখানেক বিরতির পর ফুটবলে ফিরলেন ‘দ্য স্পেশাল ওয়ান’। নতুন ক্লাবে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার কথা বলেছেন প্রথম সাক্ষাৎকারেই, কিন্তু স্পার্সের হয়ে কোন কোন বাধা-প্রতিকূলতা টপকাতে হবে সাবেক চেলসি এবং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ম্যানেজারকে?


    ১. ক্যারিয়ার বাঁচানোর শেষ সুযোগ?

    এই পয়েন্ট দেখে হয়তো অনেকেই চোখ রাঙ্গাচ্ছেন। ভাবছেন, মরিনহোর আবার ক্যারিয়ার বাঁচানোর প্রশ্ন আসে কীভাবে? সে ইউনাইটেড থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর অবসর নিলেও কয়েক যুগ পরও লোকে তাকে মনে রাখবে। এ ব্যাপারে আসলে দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই। ম্যানেজার হিসেবে তার অর্জন তো বটেই, তার বেফাঁস মন্তব্য বা চমকপ্রদ সংবাদ সম্মেলনও ভোলার মত নয়।

    তবে চাঁদেরও কলঙ্ক আছে। ইউনাইটেডে দুটি শিরোপা জিতলেও ওল্ড ট্রাফোর্ডে সফল ছিলেন মরিনহো, সেটা বলা যাবে কখনোই। মরিনহো স্পার্সে সফল না হলে হয়তো বড় ক্লাবগুলোও মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে তার থেকে। টটেনহামের হয়ে মরিনহোর নিজের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়তো এটাই। সিটি, লিভারপুল এখন প্রিমিয়ার লিগের অন্য ক্লাবগুলোর ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু যিনি গার্দিওলার বার্সার মত দলকে হারানোর টোটকা দেখিয়ে দিয়েছিলেন ইন্টার এবং রিয়ালকে, সেই মরিনহোই হয়তো একমাত্র যিনি পারবেন প্রিমিয়ার লিগে স্পার্সকে পথ দেখাতে।

     

     

    ২. দেখা মিলবে নতুন মরিনহোর?

    খেলার ধরন যেমনই হোক, জয় আসতেই হবে- এই মূলনীতিতেই ক্যারিয়ারের শুরু থেকে বিশ্বাসী মরিনহো নিজেকে কখনোই বদলাননি সময়ের সাথে। চেলসিতে ফিরে এসে দ্বিতীয় মৌসুমে যেবার লিগ জিতলেন, সেবার তাদের খেলা যে ঠিক চ্যাম্পিয়নসুলভ ছিল না- সে ব্যাপারে হয়তো একমত হবেন চেলসির কট্টর সমর্থকেরাও। প্রতি-আক্রমণে খেলা মরিনহো জয়ের জন্য ‘বাস পার্ক রক্ষণ’-এ যেতেও পিছপা হননি। কিন্তু একটা সময় আসলে এসব ‘সেকেলে’ ঘরানার চিন্তাভাবনার জন্য ভুগতে হয়েছে তাকে। মার্কাস রাশফোর্ড, অ্যান্থনি মার্শিয়ালদের নিয়েও তার ইউনাইটেড আক্রমণের দিক দিয়ে পিছিয়ে ছিল বেশ অন্যদের চেয়ে। 

    সময়ের সাথে আপনাকে ট্যাকটিক্স বদলাতে হবেই, শুরুতে তা যত রহস্যময়ই হোক না কেন। ২০০৯-এ পেপ গার্দিওলার অপরাজেয় টিকিটাকার বার্সেলোনাকেও বদলাতে হয়েছে খেলার ধরণ।প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ট্যাকটিক্স বদলেছেন ডিয়েগো সিমিওনেও। শুরুর দিকের রক্ষণাত্মক ফুটবলের খোলস ছেড়ে তার অ্যাটলেটিকো এখন ইউরোপের অন্যতম আক্রমণাত্মক দল।

    বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের হয়ে আক্রমণ এবং নিজের ট্রেডমার্ক ‘গেগেনপ্রেসিং’-এই বেশি মনযোগী ছিলেন ইয়ুর্গেন ক্লপ। লিভারপুলে শুরুর দিকে একই ট্যাকটিক্স খাটালেও অল্প সময়েই বুঝে গেলেন, রক্ষণ ঠিক না করলে কাজ হবে না। রক্ষণে তার উদাসীনতাকে ক্লপের দূর্বলতা ভাবতেন অনেকেই। সেই ক্লপের লিভারপুল এখন প্রিমিয়ার লিগে রক্ষণের দিক দিয়ে সেরা দল। কিন্তু এসব জায়গায় এসে কিছুটা পিছিয়ে গেছেন মরিনহো।

    স্পার্সের হয়ে নিজের পছন্দের ৪-২-৩-১ ফর্মেশন খুব ভালভাবেই খেলাতে পারবেন তিনি। তার ‘ট্রেডমার্ক’ ফর্মেশনের জন্য উপযুক্ত স্কোয়াডও আছে টটেনহামের। কিন্তু প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ঠিক কতটা নতুন ধরণের চিন্তাভাবনা আনবেন মরিনহো, সে ব্যাপারে থাকছে সংশয়। মরিনহোর আরেক বড় চ্যালেঞ্জ হল, মাউরিসিও পচেত্তিনো উত্তর মেরু হলে তিনি দক্ষিণ। এই মৌসুম দিয়ে হয়তো মরিনহোকে বিচার করা উচিত হবে না, কিন্তু তিনি নিজেও জানেন; অন্ততপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগে স্পার্সকে নিতে না পারলে নর্থ লন্ডনে প্রথম মৌসুমের মার্কশিটে ‘এফ’ গ্রেডটাই হয়তো পাবেন তিনি।

    ৩. শিরোপা হবে সোনার হরিণ?

    “মরিনহোকে ম্যানেজার হিসেবে আনলে আপনার দল কেমন খেলবে সেটা না জানলেও একটা ব্যাপার নিশ্চিত; শিরোপা আসবেই।” মরিনহোকে নিয়ে তার সাবেক সহকারী রুই ফারিয়ার উক্তিটিতে সম্মতি প্রকাশ করবেন অনেকেই। মরিনহো আসলে শিরোপা আসবেই, প্রথম মৌসুম না হলেও দ্বিতীয় মৌসুমে তো অবশ্যই। কিন্তু স্পার্সকে কি আসলেই রিয়াল, ইন্টার, চেলসিদের মত স্বপ্ন দেখাতে পারবেন মরিনহো?

    ২০০৭-০৮ মৌসুমে কারাবাও কাপের পর আর শিরোপার মুখ দেখেনি টটেনহাম। গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে তীরে এসে তরী ডোবায় শিরোপার জন্য এক যুগের অপেক্ষাটা দীর্ঘায়িতই হয়েছে কেবল। অবশ্যই মরিনহোর লক্ষ্য থাকবে শিরোপা জেতা। কিন্তু স্পার্সের স্কোয়াড নিয়ে সিটি, লিভারপুলকে কি আসলেও প্রতিদ্বন্দ্বীতা দিতে পারবেন মরিনহো?

    অবশ্য কেউ পারলে সেটা যে মরিনহোই হবেন, সে ব্যাপারে বাজি ধরার লোকের সংখ্যাই থাকবে বেশি। স্পার্স সমর্থক বা বোর্ড জানে; অর্থকড়ি বা স্কোয়াডের শক্তির বিচারে হয়তো লিভারপুল-সিটি বা ইউরোপের রাঘব-বোয়ালদের টেক্কা দেওয়াটা স্পার্সের জন্য কিছুটা ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখার মতই। সেজন্য ক্ষুরধার মস্তিষ্কের মরিনহোও ওপরই বিশ্বাস রাখতে হবে তাদের। আগের ক্লাবগুলোয় জয়ের জন্য রক্ষণাত্মক খেলানোয় সমালোচনা সইতে হয়েছিল মরিনহোকে। কিন্তু স্পার্সে সেরকম হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলাটা হয়তো শ্রেয়। রিয়াল, ইন্টার, চেলসি- নিজের সাবেক ক্লাবগুলোয় লিগশিরোপা, চ্যাম্পিয়নস লিগই লক্ষ্য ছিল তার।

    কিন্তু স্পার্সের হয়ে সে স্বপ্ন শুরুতেই হয়তো দেখতে পারবেন না মরিনহো, এই মৌসুমে তো অবশ্যই না। প্রথমত, দলটা তার নিজের না। আর যেকোনো ক্লাবের হয়ে মরিনহো সাধারণত নিজের সেরাটা দেন দ্বিতীয় মৌসুমেই। ক্লপ-গার্দিওলা যেখানে ম্যাচ শেষে স্কোরলাইন দেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার চেয়ে ভাল খেলার দিকে জোর দেন বেশি, সেদিকে মরিনহোর মূল অনুপ্রেরণা তার শিরোপাক্ষুধা। কিন্তু স্পার্সের হয়ে মরিনহোকে হয়তো আগের ক্লাবগুলোর চেয়ে কিছুটা বাস্তববাদী লক্ষ্যই সাজাতে হবে।

     

     

    ৪. যোগ্য 'আন্ডারস্টাডি'-এর সন্ধানে...

    পচেত্তিনোর অধীনে স্পার্সের অন্যতম তিন সেরা ফুটবলার ছিলেন ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন, হ্যারি কেইন, এবং হিউঙ-মিন সন। এরিকসেন ফর্মে নেই, সন বহিষ্কারাদেশের কারণে মৌসুমের শুরুর দিকে বেশ কয়েক ম্যাচ মিস করেছেন। তাদের জায়গাটা নিতে পারেনি আর কেউই। নতুন সাইনিং রায়ান সেসেনিয়ন এখনও স্পার্সের একাদশে ম্যাচই খেলেছেন মোট দুটি। স্ট্রাইকার পজিশনে কেইনের কোনো যোগ্য বিকল্প নেই স্পার্সের। সব মিলিয়ে স্কোয়াড ডেপথ নিয়েও বেশ ভাবতে হবে মরিনহোকে।

    তবে মরিনহোর জন্য কিছুটা ইতিবাচক দিক হল তার প্রিয় ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে দল সাজালে স্পার্সের গোলরক্ষকসহ পুরো রক্ষণ এবং ডাবল পিভোটের দুই মিডফিল্ডার- সবারই বিকল্প আছে স্পার্স স্কোয়াডে। কিন্তু ওয়ানইয়ামা-ডেভিস-ফয়েথদের সমস্যা হল, তারা কেউই শীর্ষ ৬-এর কোনো দলে খেলার মত ধারাবাহিক নন।

    হ্যারি উইঙ্কস-মুসা সিসোকো-ইয়ান ভার্টনহেনদের টেক্কা দিতে পারেননি সে অর্থে। একাদশে জায়গা নিয়ে এই প্রতিযোগিতার অভাবটাই ভুগিয়েছে স্পার্সকে। আবার এই 'আন্ডারস্টাডি'দের কাউকেই হয়তো আপনি সে অর্থে বিশ্বমানের বলতে পারবেন না। সবসময় বড় এবং বিশ্বমানের স্কোয়াড কোচিং করানো মরিনহো স্পার্সের এই সীমাবদ্ধতা নিয়ে কতটুকু কাজ করতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়।

     

     

    ৫. 'ধনী' মরিনহো এবং 'কিপ্টে' টটেনহাম: জুটি জমবে? 

    মনের মত দল না পাওয়ায় ইউনাইটেড এবং চেলসি বোর্ডকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছিলেন মরিনহো। ফুটবল ইতিহাসে দলবদলে তার চেয়ে বেশি খরচ করেননি কেউ (মোট ১.৬ বিলিয়ন ইউরো)। ইচ্ছেমত টাকাকড়ি ঢেলে দল সাজানোর স্বাধীনতা পাওয়াটা তার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, আগে বেশ কয়েকবার নিজেই সেটা স্বীকার করেছিলেন মরিনহো। কিন্তু স্পার্সের হয়ে সে স্বাধীনতা পাওয়ার সম্ভাবনা হয়তো ক্ষীণই মরিনহোর।

    দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র একদিন না পেরুতেই মরিনহোকে সে ইঙ্গিতই দিয়েছেন স্পার্স চেয়ারম্যান ড্যানিয়েল লেভি, জানিয়েছে মেট্রো। নতুন স্টেডিয়াম বানানো এবং গত গ্রীষ্মে এন’দোম্বেলে, লো সেলসো, সেসেনিয়নদের দলে নেওয়ার পর শীতকালীন দলবদলে টাকা খরচ করার সুযোগ নেই স্পার্সের। নতুন ফুটবলার দলে নিতে হলে তাই পুরনোদের কাউকে বিক্রি করা ছাড়া উপায় নেই মরিনহোর সামনে। নতুন ক্লাবে এসে শুরুতেই একটা ধাক্কাই হয়তো খেলেন মরিনহো।

    নিজের পছন্দমত স্কোয়াড সাজাতে না পারার কারণেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বোর্ডের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিলেন তিনি। প্রকাশ্যে ফুটবলারদের সামর্থ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন, হারিয়েছিলেন ড্রেসিংরুমে তার খেলোয়াড়দের থেকে সম্মানও। ২০২২-২৩ পর্যন্ত চুক্তি আছে তার, কিন্তু দলবদলের বাজারে পছন্দমত দল সাজানোর স্বাধীনতা না পেলে মরিনহো হয়তো নিজে থেকেই বিদায় নিতে পারেন তারও আগে।