যেসব রেকর্ড এখনও ছোঁয়া হয়নি মেসি-রোনালদোর
ফুটবলের রেকর্ড বইয়ের বেশিরভাগ পৃষ্ঠাতেই মনে হয় তাঁদের দু’জনের নাম রয়েছে। তাঁরা মাঠে নামলে প্রতি ম্যাচের পরেই রেকর্ড বইটা নতুন করে লিখতে বসতে হয়। রেকর্ড ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় মেতে থাকা লিওনেল মেসি এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো নিজেদের নিয়ে গেছেন অন্য এক উচ্চতায়। রেকর্ডের এই দুই বরপুত্র অগণিত কীর্তির পাশে নিজেদের নাম বসালেও ইউরোপিয়ান ফুটবলে এখনো কিছু রেকর্ড ছোঁয়া হয় নি তাঁদের। হয়ত অদূর ভবিষ্যতে সেই কীর্তিগুলোর পাশে নাম লেখানোর জন্যেই প্রতিদিন আরো একটু বেশি পরিশ্রম করে যাচ্ছেন রন এবং লিও!
ফাইনাল ম্যাচের গোলঃ
-
ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালের সর্বোচ্চ গোলদাতাঃ ৭টি - আলফ্রেডো ডি স্টেফানো, ফেরেঙ্ক পুস্কাস (দু’জনই রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে)।
-
সবচেয়ে বেশি ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনাল ম্যাচে গোলঃ ৫ বার - আলফ্রেডো ডি স্টেফানো (রিয়াল মাদ্রিদ, ১৯৫৬, ‘৫৭, ‘৫৮, ‘৫৯, ‘৬০)।
-
ইউরোপিয়ান কাপের এক ফাইনালে সর্বোচ্চ গোলদাতাঃ ৪টি - ফেরেঙ্ক পুস্কাস (রিয়াল মাদ্রিদ, ১৯৬০)।
-
উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের এক ফাইনালে সর্বোচ্চ গোলদাতাঃ ২টি - ড্যানিয়েল মাস্যারো (এসি মিলান, ১৯৬০), কার্ল হেইঞ্জ রিডল (বরুশিয়া ডর্টমুন্ড, ‘৯৭), হার্নান ক্রেসপো (মিলান, ২০০৫), ফিলিপ্পো ইনজাঘি (মিলান, ‘০৭), দিয়েগো মিলিতো (ইন্টারনাজিওন্যাল মিলানো, ২০১০)।
মেসি ও রোনালদো দুইজনই দুইটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে গোল করেছেন (মেসি, ‘০৯, ‘১১ ও রোনালদো, ‘০৮, ‘১৪)। তাই তাঁদের দু’জনের সামনেই সুযোগ রয়েছে ফাইনালে ইতিহাস গড়া অনেক বিখ্যাত ফুটবলারকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। মেসি-রোনালদো ছাড়াও দুইটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে গোল করার কীর্তিতে নাম রয়েছে স্যামুয়েল ইতো ও (বার্সেলোনা, ২০০৬, ‘০৯) রাউল গঞ্জালেজের (রিয়াল মাদ্রিদ, ২০০০, ‘০২)।
ইউরোপিয়ান কাপ/ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গোল:
-
উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বের সর্বোচ্চ গোলদাতাঃ ৫৩টি - রাউল গঞ্জালেজ।
-
ইউরোপিয়ান কাপ / উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার-ফাইনালের সর্বোচ্চ গোলদাতাঃ ১৪টি - আলফ্রেডো ডি স্টেফানো।
-
ইউরোপিয়ান কাপ/ উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমি-ফাইনালের সর্বোচ্চ গোলদাতাঃ ১১ টি - আলফ্রেডো ডি স্টেফানো।
রাউল গঞ্জালেজের উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ও ইউরোপিয়ান কাপের সর্বোচ্চ গোলদাতার দু’টি রেকর্ডই ভেঙ্গে দিয়েছেন রোনালদো (বর্তমান রেকর্ডধারী) ও লিওনেল মেসি। তবে সাবেক রিয়াল তারকা এখনো উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বের সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ডটি নিজের করে রেখেছেন। কিন্তু, রোনালদো (৪৯) এবং মেসি (৪৭) যেকোন সময় এই রেকর্ডটিও ভেঙ্গে দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। ডি স্টেফানো এখনো কোয়ার্টার ও সেমি ফাইনালে সবচেয়ে বেশি গোল দেয়ার রেকর্ডটি আগলে রেখেছেন। যদিও রোনালদো কোয়ার্টারে ১২ আর সেমিতে ৮ গোল করে এবং মেসি কোয়ার্টারে ১০ ও সেমিতে চার গোল নিয়ে রেকর্ডটির দিকেই এগিয়ে চলেছেন।
বিভিন্ন দলের হয়ে সাফল্য:
-
সবচেয়ে বেশি দলের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা জয়ঃ ৩টি - ক্ল্যারেন্স সিডর্ফ (অ্যাজাক্স, ১৯৯৫; রিয়াল মাদ্রিদ, ‘৯৮; মিলান, ‘২০০৩, ‘০৭)
-
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সবচেয়ে বেশি দলের হয়ে গোলদাতাঃ ৬টি - ইব্রাহিমোভিচ (অ্যাজাক্স, জুভেন্টাস, ইন্টারনাজিওন্যাল, বার্সেলোনা, মিলান, পিএসজি)
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোই একমাত্র ফুটবলার যিনি দু’টি দলের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে শিরোপা জয়ী দলের পক্ষে গোল করেছেন। অন্যদিকে ভেলিবর ভাসোভিচকে দুর্ভাগাই বলতে হবে। কারণ এই ফুটবলার ইউরোপিয়ান ক্লাবের ফাইনালে দু’টি দলের (পার্টিজান, ১৯৬৬ ও অ্যাজাক্স, ‘৬৯) হয়ে গোল করলেও একবারও শিরোপা জিততে পারেন নি। এদিকে ক্ল্যারেন্স সিডর্ফের রেকর্ডে ভাগ বসাতে চাইলে রোনালদোকে নতুন আরেকটি দলকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা জিতাতে হবে। যাই হোক, আপাতত ইব্রাহিমোভিচের রেকর্ডটির ধারেকাছেও যাওয়ার সম্ভাবনা নেই মেসি-রোনালদোর মধ্যে কারোরই। হয়ত নিজের রেকর্ডটি আরো বড় করতে পারেন একের পর এক ক্লাব পরিবর্তন করতে থাকা ইব্রা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে মেসির সব গোলই বার্সেলোনার হয়ে আর রোনালদো করেছেন ইউনাইটেড ও রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলে।
বয়স্ক গোলদাতা:
-
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালঃ পাওলো মালদিনি (৩৬ বছর ৩৩৩ দিন) মিলান বনাম লিভারপুল (২৫/০৫/২০০৫)
-
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, গ্রুপ পর্ব থেকে ফাইনালঃ ফ্রান্সেস্কো টট্টি (৩৮ বছর ৫৯ দিন) সিএসকে মস্কো বনাম রোমা (২৫/১১/২০১৪)
-
ইউরোপিয়ান কাপঃ ম্যানফ্রেড বার্গসমুলার (৩৮ বছর ২৪৩ দিন) ওয়ার্ডার ব্রিমেন বনাম ডায়নামো বার্লিন (১১/১০/১৯৮৮)
পাওলো মালদিনির রেকর্ডটি ভাঙতে হলে মেসি-রোনালদোকে যে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রোনালদোর প্রথম সুযোগটি হবে ২০২১/২২ এর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে আর মেসির অপেক্ষা করতে হবে ২০২৩/২৪ মৌসুম পর্যন্ত! চ্যাম্পিওন্স লিগের গ্রুপ পর্ব থেকে ফাইনালে সবচেয়ে বয়স্ক গোলদাতা হতে রোনালদোর সুযোগ হবে ১ এপ্রিল, ২০২৩ এবং মেসির ২২ আগস্ট, ২০২৫ এর পর! অন্যদিকে ইউরোপিয়ান কাপের সবচেয়ে বয়স্ক গোলদাতা হতে হলে রোনালদোকে ২২ নভেম্বর, ২০২৩ ও মেসিকে ১৩ এপ্রিল,২০২৬ পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে হবে।
দ্রুততম গোলঃ
-
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দ্রুততম গোলঃ রয় ম্যাক্যায় (১০.১২ সেকেন্ড) বায়ার্ন মিউনিখ বনাম রিয়াল মাদ্রিদ (০৭/০৩/২০০৭)
-
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের দ্রুততম গোলঃ পাওলো মালদিনি (৫৩ সেকেন্ড) মিলান বনাম লিভারপুল (২৫/০৫/২০০৫)
রিয়াল মাদ্রিদের কিক-অফের পরপরেই ডিফেন্ডারের ভুল থেকে পাওয়া বলে গোল করেছিলেন বায়ার্নের রয় ম্যাক্যায়। রোনালদো-মেসি দু’জনেরই দ্রুততম গোল চার মিনিটে করা। জুভেন্টাসের বিপক্ষে নভেম্বর '১৩ তে গোলটি করেছিলেন রন। অন্যদিকে মেসি করেছিলেন এফসি বাসেলের বিপক্ষে ২০০৮ সালের অক্টোবরে। ফাইনালে করা পাওলো মালদিনির দ্রুততম গোলের ধারে কাছেও নেই মেসি-রোনালদো। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে মেসির গোল দু’টি দ্বিতীয়ার্ধে করা। অন্যদিকে রোনালদোর দ্রুততম গোলটি এসেছে ২৬ মিনিটে, চেলসির বিপক্ষে।
হ্যাট্রিকঃ
-
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দ্রুততম হ্যাট্রিকঃ বেফেতিম্বি গোমিস (৮ মিনিট) অলিম্পিক লিওনাইস বনাম ডায়নামো জার্গেব (০৭/১২/২০১১)
-
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে টানা হ্যাট্রিকঃ ২টি - লুইজ আদ্রিয়ানো শাখতার দোনেস্ক বনাম এফসি বেট বরিসভ (২১/১০/২০১৪) ও শাখতার দোনেস্ক বনাম এফসি বেট বরিসভ (০৫/১১/২০১৪)
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সর্বাধিক হ্যাট্রিকের রেকর্ডটি এখন যৌথভাবে রোনালদো ও মেসির দখলে রয়েছে। দুইজনই পাঁচবার হ্যাট্রিক করলেও কোনটিই বেফেতিম্বি গোমিসের রেকর্ডকে স্পর্শ করতে পারে নি। মেসির দ্রুততম হ্যাট্রিক ছিল আর্সেনালের বিপক্ষে ৬ এপ্রিল, ২০১০ এ। যদিও লেভারকুসেনের বিপক্ষে তাঁর পাঁচ গোলের কীর্তির দিনে দ্বিতীয় ও চতুর্থ গোলের মধ্যে ব্যবধান ছিল ১৬ মিনিট। অন্যদিকে রোনালদোর দ্রুততম হ্যাট্রিক হয়েছে ১২ মিনিটে, মালমো সিটির বিপক্ষে।
লম্বা রেসের ঘোড়াঃ
-
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের যেকোন পর্যায়ে সর্বাধিক মৌসুমে গোলদাতাঃ ১৪ টি - রাউল গঞ্জালেজ।
-
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সর্বাধিক মৌসুমে গোলদাতাঃ ১৬ টি - রায়ান গিগস।
পেশাদারী ফুটবল জীবনের প্রথম ক্লাব স্পোর্টিং সিপি বাছাই পর্বেই বাদ পড়লে এবং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে প্রথম দুই বছর গোল করতে না পারায় ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের তিনটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে গোলশূন্য ছিলেন রোনালদো। তবে পরবর্তী দশ মৌসুমে টানা গোল করে আসছেন এই পর্তুগিজ। রাউল গঞ্জালেজের রেকর্ডে ভাগ বসাতে হলে তাঁকে গোল করতে হবে আরো পাঁচ মৌসুমে। আর রায়ান গিগসের রেকর্ড ভাঙতে রোনালদোকেও গিগসের মত খেলতে হবে চল্লিশ বছর পর্যন্ত। এদিকে এখন পর্যন্ত কোন মৌসুমেই গোলশুন্য ছিলেন না মেসি। টানা ১১ চ্যাম্পিয়ন্স লিগে গোল করা এই আর্জেন্টাইন রাউল অথবা গিগসের রেকর্ডে ভাগ বসানোর আগেই অবশ্য বয়স ত্রিশ পার করে ফেলবেন।
এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি গোলঃ
-
এক ইউরোপিয়ান মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলদাতাঃ ১৮ টি - রাদামেল ফ্যালকাও, পোর্তো (২০১০/১১)
২০১০/১১ মৌসুমের ইউরোপা লিগে রাদামেল ফ্যালকাওয়ের গড়া রেকর্ডটিতেও ভাগ বসাতে পারেন নি মেসি-রোনালদোর কেউই। কলম্বিয়ান ফ্যালকাও বাছাই পর্বে একটি ও মূল পর্বে ১৭ টি গোল করেছিলেন। এদিক থেকে রোনালদো চ্যাম্পিয়নস লিগে ২০১৩/১৪ মৌসুমে ১৭ গোলের রেকর্ড গড়েছিলেন। আর বার্সা স্ট্রাইকার মেসি সর্বোচ্চ ১৪ গোল করেছিলেন ২০১১/১২ মৌসুমে ।
ধারাবাহিক গোলঃ
-
একটানা সর্বাধিক ম্যাচে গোলদাতাঃ ৯টি - রুড ভ্যান নিস্তলরয়, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড (২০০২/০৩)
-
ইউরোপিয়ান কাপ/ চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ম্যাচ প্রতি গোলের সেরা গড়ঃ ০.৯৭ - গার্ড মুলার (বায়ার্ন)
-
উয়েফা ক্লাব প্রতিযোগিতায় ম্যাচ প্রতি গোলের সেরা গড়ঃ ০.৯০ - রাদামেল ফ্যালকাও (পোর্তো, ক্লাব অ্যাতলেটিকো ডি মাদ্রিদ)
২০০২/০৩ মৌসুমে রুড ভ্যান নিস্তলরয় টানা ৯ ম্যাচে গোল করার কীর্তি গড়লেও সব ম্যাচে খেলেননি তিনি। এই ডাচ ফুটবলার তাঁর খেলা টানা নয় ম্যাচেই অবশ্য গোল করে ইতিহাস গড়েন। যদি বাছাই পর্বের গোল ধরা হয় তবে তিনি টানা দশ ম্যাচে গোল করেছিলেন। ২০১৩/১৪ মৌসুমে নিস্তলরয়ের রেকর্ডটির বেশ কাছে এসেছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। টানা আট ম্যাচে গোল করেছিলেন এই পর্তুগিজ স্ট্রাইকার।
যাই হোক, যখন ম্যাচ প্রতি গোলের গড়ের কথা আসে তখন রোনালদো, মেসি এই রেকর্ডটির মালিক গার্ড মুলারের ধারে কাছেও নেই। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ১২৫ ম্যাচে ৮৯ গোল নিয়ে রোনালদোর ম্যাচ প্রতি গোলের গড় ০.৭১। এমনকি উয়েফার সব ক্লাব প্রতিযোগিতাতেও ১২৮ ম্যাচে ৯১ গোল করেও তাঁর গড় সংখ্যা একই। আর ১০২ ম্যাচে ৮০ গোল করে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে মেসির ম্যাচ প্রতি গোলের গড় ০.৭৮। উয়েফা ক্লাব প্রতিযোগিতাতে ১০৬ ম্যাচে ৮৩ গোল করেও একই গড়ের মালিক এই আর্জেন্টাইন। অন্যদিকে ফ্যালকাও যদি ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতাগুলোতে নিয়মিত খেলেন, তবে তাঁর গড় নিচের দিকে নামার সম্ভাবনাই বেশি। আর তাই গার্ড মুলারের রেকর্ড আরো অনেকদিন অধরা থেকে যাবে বলেই মনে হচ্ছে!