বাংলাদেশের যে ৫ ম্যাচ হতে পারতো অন্যরকম, হয়েছে শুধুই আক্ষেপের
অনেকদূর গিয়েও আটকে যাওয়া- নিশ্চয়ই ক্রিকেটে নতুন কিছু নয়। তবে বাংলাদেশের জন্য এ ৫টি ম্যাচ যেন অন্যরকমের এক আক্ষেপ। এর মাঝে তিনটিই আবার মার্চ মাসে, একটি এপ্রিলে। অথচ ম্যাচগুলি হতে পারতো অন্যরকম (সেটা তো অনেক ম্যাচই হতে পারত, আপনি বলতে পারেন।)
মুলতান টেস্ট, ২০০৩, বিপক্ষ পাকিস্তান
১ উইকেটে হার
মাশরাফি বিন মুর্তজা খেলছেন। আগে থেকেই ডেভ হোয়াটমোর ঠিক করে রেখেছিলেন, ওয়ার্কলোড ম্যানেজ করতে মাশরাফিকে সে সফরে দুই টেস্ট খেলানো হবে। হোয়াটমোর একটু জুয়া খেললেন, মুলতানের উইকেটে ঘাস থাকতে পারে, ‘পাগলা’কে সে টেস্টের জন্য রেখে দিলেন তিনি। রশিদ লতিফ আরেকটু ‘সাহস’ করে বলে ফেললেন, অলক কাপালির ক্যাচটা মাটি থেকে তুলেছেন তিনি। হান্নান সরকার ক্যাচটা ধরলেন। মোহাম্মদ রফিক ‘স্পিরিট অফ ক্রিকেট’ ভুলে গিয়ে উমর গুলকে ম্যানক্যাড করলেন, অথবা আরেকবার রান-আউট করার সময় পা দিয়ে আগেই স্টাম্প ভাঙলেন না। আম্পায়াররা আরেকটু ‘সদয়’ হলেন, তাদের রুঢ় সিদ্ধান্তগুলি আসলো বাংলাদেশের পক্ষে। অথবা, ইনজামাম-উল-হক অতিমানব হয়ে ওঠার জন্য এ ম্যাচ বেছে নিলেন না। তিনি তো অবসরই নিতে চেয়েছিলেন এর আগেই!
ওপরের যে কোনও একটি ঘটলে মুলতানে ২০০৩ সালেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম সেরা দিনটা আসতে পারতো, হান্নান সরকারের ভাষায়, মোমেন্টামটা তখনই শিফট করে যেতে পারত। হয়নি।
২৪তম টেস্টটাও হেরেছিল বাংলাদেশ, ১ উইকেটে। আগের ২১ টেস্টে বৃষ্টির কল্যাণে পাওয়া একটি ড্র নিয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ শুরু করেছিল বাংলাদেশ, করাচি ও পেশোয়ারে যথাক্রমে ৭ ও ৯ উইকেটে হারলেও বাংলাদেশ লড়াইয়ের আভাস দিয়েছিল ঠিকই।
মুলতানে প্রথম ইনিংসে ২৭৫ রানে অল-আউট হলেও বাংলাদেশ পাকিস্তানকে আটকে দিয়েছিল ১৭৫ রানে, প্রথমবারের মতো প্রতিপক্ষকে ২০০-এর নিচে অল-আউট করেছিল তারা। মোহাম্মদ রফিক নিয়েছিলেন ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বার ৫ উইকেট। রাজিন সালেহর ৪২ রানে দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ তুললো ১৫৪ রান। ছয়ে নামা অলক কাপালি ২য় দিনের শেষভাগে হাতে আঘাত পেয়ে উঠে গিয়েছিলেন, পরদিন নেমেছিলেন আবার। আক্রমণ শুরু করেছিলেন, এ সময়ই পাকিস্তান অধিনায়ক লতিফ সেই ‘কাজটা’ করে বসলেন। ইয়াসির আলির বলে ক্যাচটা ঠিকঠাক নিতে পারেননি, মাটি থেকে তুলেছিলেন। তবে পেছন ফিরে ছিলেন বলে আম্পায়ার বা কাপালি- দেখতে পাননি কেউই। লতিফ এরপর নিষিদ্ধ হন, আর কোনোদিন টেস্ট খেলা হয়নি তার। তবে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে আক্ষেপ করেন না তিনি!
তৃতীয় দিনশেষে ১৪৮ রান তুলতে ৬ উইকেট নেই পাকিস্তানের, শেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান হিসেবে থাকলেন শুধু ইনজামাম, এ সিরিজের আগেই যিনি বোর্ডের ওপর রাগে-অভিমানে অবসর নিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। সাকলাইন মুশতাক দ্রুতই ফিরলেন পরদিন, তবে সাব্বির আহমেদ ও উমর গুলকে নিয়ে ৮ম ও ৯ম উইকেটে ইনজামাম তুলে ফেললেন ৪১ ও ৫২ রান। গুল রান-আউট হওয়ার পর ইনজামামের সঙ্গী ছিলেন শুধু ইয়াসির, তখন পাকিস্তানের প্রয়োজন ছিল ৫ রান। বাংলাদেশ তখনও আশায়, আর ১টি উইকেটের।
ইয়াসির ৩ বল ঠেকিয়ে এরপর নিলেন সিঙ্গেল। খালেদ মাহমুদের শেষ বলটা পুলের মতো করলেন ইনজামাম, ফাইন-লেগ দিয়ে হলো চার। স্বভাববিরুদ্ধ বুনো উল্লাসে মাতলেন ইনজামাম, আর মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মাহমুদের হাতে উঠে এলো সাদা রুমাল, যা গিয়ে ঠেকলো চোখে।
অথচ মুলতানে ইতিহাস হতে পারত।
আপনি জানেন কি?
নিজেদের ইতিহাসে পাকিস্তান ১ উইকেটে টেস্ট জিতেছে দুইবার- মুলতানের আগে ১৯৯৪ সালে করাচিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। সেবারও অপরাজিত ছিলেন ইনজামাম-উল-হক, ৩১৪ রানতাড়ায় ৮ নম্বরে নেমে তিনি করেছিলেন অপরাজিত ৫৮ রান।
ফতুল্লা টেস্ট, ২০০৬, বিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া
৩ উইকেটে হার
তখনও ২৩ রান প্রয়োজন অস্ট্রেলিয়ার, বাকি ৩ উইকেট।
দ্বিতীয় নতুন বলের দারুণ এক লেংথ ডেলিভারিতে ব্রেট লির এজ ড্র করেছেন এর আগেই মাশরাফি বিন মুর্তজা, ঠিক পরের ওভারে শাহাদাত হোসেনের শর্ট বলে তার প্রিয় পুল শট করতে গিয়ে মিসকিউ করে ফেলেছেন রিকি পন্টিং। ডিপ ফাইন লেগ থেকে বলের দিকে দৌড় শুরু করতে মাশরাফি দেরি করলেন না, পজিশনিংটা হলো ঠিকঠাক। কিংবা সেসব না হলেও, শেষ মুহুর্তে সামনে ডাইভ দিয়ে বলটা ধরে ফেললেন। রিকি পন্টিং আউট হলেন।
ফতুল্লায় অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেওয়ার পথে আরেকটু এগিয়ে যেতে পারতো তাহলে বাংলাদেশ। ফতুল্লা ঢুকে যেতে পারতো বাংলাদেশের ইতিহাসে।
হয়তো মুলতানের চেয়েও আক্ষেপটা আরও বেশি ফতুল্লা নিয়ে। কিংবা এসব আক্ষেপের তুলনা চলে না।
এবার অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর সুযোগটা হারালো বাংলাদেশ। এবার পন্টিং হয়ে দাঁড়ালেন বাধা। অবশ্য পন্টিং সেঞ্চুরি করেছিলেন দ্বিতীয় ইনিংসে, প্রথম ইনিংসে ৯৩ রানে ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ার পরও অস্ট্রেলিয়া ২৬৯ রান করেছিল অ্যাডাম গিলক্রিস্টের ১৪৪ রানে।
টসে জিতে ব্যাটিং নেওয়া বাংলাদেশ দারুণ ব্যাটিং কন্ডিশন উপভোগ করেছিল শাহরিয়ার নাফীসের প্রথম শ্রেণির প্রথম সেঞ্চুরিতে। এধার-ওধার করে জীবন পেয়েছিলেন নাফীস, তবে বাকি সময়টা ছিলেন দারুণ। সঙ্গে হাবিবুল বাশার ও রাজিন সালেহর ফিফটিতে বাংলাদেশ তুলল ৪২৭। স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল নিলেন ৮ উইকেট। শেন ওয়ার্ন উইকেটশূন্য।
ফতুল্লার অসম বাউন্সের সঙ্গে মোহাম্মদ রফিক ও এনামুল হক জুনিয়রের দারুণ বোলিংয়ে ভড়কে গেল অস্ট্রেলিয়া। তবে এ উইকেটে ব্যাটিংয়ের চিট-কোডটা বের করে ফেললেন গিলক্রিস্ট, করলেন সহজাত আক্রমণ। আলগা ডেলিভারি পেলেন ঠিকই। ব্রেট লি ও জেসন গিলেস্পির সঙ্গে ৭ম ও ৮ম উইকেটে যোগ করলেন ৬৩ করে রান, নিজে ১৫ চারের সঙ্গে মারলেন ৬টি ছয়। একসময় ফলো-অনের শঙ্কায় পড়া অস্ট্রেলিয়া অবশ্য ১৫৮ রানের লিড গুণলো ঠিকই।
তবে সে লিডটা ঠিক কাজে লাগাতে পারলো না বাংলাদেশ। তখনও বাংলাদেশের ব্যাটিং মানেই আক্রমণ করে যাওয়া, যেন এতেই কমবে চাপ। দ্বিতীয় ইনিংসে ফিরে এলো সেই রূপটা। ৫৮ রানে ১ উইকেট থেকে ১৪৮ রানে অল-আউট- অস্ট্রেলিয়ার জন্য বাংলাদেশ লক্ষ্য দিতে পারলো ৩০৭ রানের। হাসি-হেইডেনের ভাল ওপেনিং শুরুর পর পন্টিং-হেইডেনের জুটি এগিয়ে নিচ্ছিল অস্ট্রেলিয়াকে, মাঝে ৪৮ রানে ৪ উইকেট নিয়ে বাঁধটা ভেঙে ফেলেছিল বাংলাদেশ।
কিন্তু, মুলতানের ইনজামাম ফতুল্লায় ফিরে এলেন পন্টিং হয়ে।
আপনি জানেন কি?
প্রথম ইনিংসে ১০৮ রানে নেওয়া ৮ উইকেট ম্যাকগিলের ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং ফিগার। ক্যারিয়ারে শেন ওয়ার্নের সঙ্গে ১৬ ম্যাচ একসঙ্গে খেলেছিলেন ম্যাকগিল, ফতুল্লা টেস্টের পর সে সফরেই চট্টগ্রামে দুজনের একত্রে শেষ টেস্ট ছিল।
এশিয়া কাপ ফাইনাল, ২০১২, বিপক্ষ পাকিস্তান
২ রানে হার
আইজাজ চিমার শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ৯ রান, প্রথম বলেচিমার সঙ্গে ‘সংঘর্ষ’ এড়িয়ে গিয়ে ডাবলস নিতে পারলেন মাহমুদউল্লাহ। অথবা চিমা ইচ্ছাকৃত ‘বাধা’ দিয়েছেন অভিযোগ এনে বাংলাদেশকে ৫টি রান পেনাল্টি দিলেন আম্পায়াররা। কিংবা প্রথম ইনিংসের শেষ ওভারে শাহাদাত হোসেন পরপর দুই নো-বল করলেন না, ফলে রান উঠলো ১৯-এর কম। অথবা পরের ইনিংসে শেষ ওভারের ৫ম বলে বাউন্ডারির আশা না করে একটা সিঙ্গেল নিয়ে দিলেন আব্দুর রাজ্জাক।
মিরপুরে কান্নার বদলে থাকতে পারতো তাহলে উল্লাস।
এ তালিকায় আগের দুই হারের পরের কান্নাটা যদি অলক্ষ্যে হয়, এবার তাহলে সেটা প্রকাশ্য। হয়তো চাইলে যে কোনো দর্শকই একের পর এক মনে করতে পারবেন ছবিগুলো।
মুশফিকুর রহিম আধশোয়া। কোচিং স্টাফের কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন। মুশফিক নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছেন। খানিক বাদে উঠে দাঁড়ালেন। আশ্রয় নিলেন সাকিব আল হাসানের বুকে। এরপর হাউমাউ কান্না। সাকিব কাঁদবেন না বলে পণ করেছেন যেন, দাঁতে দাঁত চেপে রাখতে হচ্ছে। সেই পণ হয়তো ভেঙে গেছে কিছুক্ষণ বাদেই।
নাসির হোসেন জার্সিটা তুলে নিয়ে চোখমুখ মোছেন। একপাশে ঠাঁই বসে মাশরাফি বিন মুর্তজা। সে ম্যাচে খেলেননি এনামুল হক বিজয়। কাঁদছেন তিনি। তামিম ইকবাল কোথাও যেন হারিয়ে গেছেন।
সেদিন কাঁদেননি কে!
২০১২ সালের এশিয়া কাপ ফাইনাল এদেশের ক্রিকেটের আক্ষেপের সঙ্গে লেপ্টে আছে নিশ্চিতভাবেই, এবং সেটা থাকবে শুরুর দিকেই। ত্রিদেশীয় সিরিজের বাইরে এটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম টুর্নামেন্ট ফাইনাল।
গ্রপপর্বে পাকিস্তানের কাছে হারলেও শ্রীলঙ্কা-ভারতকে হারিয়ে ফাইনালে এসেছিল বাংলাদেশ। পাকিস্তান ভারতের কাছে হারলেও বাংলাদেশের সঙ্গে রান-রেটের ব্যবধানে তারা এগিয়ে ছিল ভারতের চেয়ে।
আঁটসাঁট বোলিংয়ে পাকিস্তানকে ২৩৬ রানে আটকে দিয়েছিল বাংলাদেশ, অবশ্য শেষ ওভারে দুই নো বলের সহায়তায় ১৯ রান গুণেছিলেন শাহাদাত হোসেন, পাকিস্তানকে এগিয়ে নিয়েছিল সেটি।
রানতাড়ায় তামিম ইকবাল করেছিলেন আরেকটি ফিফটি। শুরুতে এ টুর্নামেন্টের স্কোয়াডে না থাকা তামিম এ ফিফটির পর আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়েছিলেন- এক, দুই, তিন, চার। মিডল অর্ডারে নাসির হোসেন ও সাকিব আল হাসানের ৮৯ রানের জুটি অনেকখানি এগিয়ে নিয়েছিল বাংলাদেশকে, তবে দ্রুতই তাদের ফেরা আবার ফিরিয়ে এনেছিল চাপ। ৯ বলে ১৮ রানের ক্যামিওর পরও আক্ষেপে পুড়েছিলেন মাশরাফি এরপর।
শেষ ২ বলে প্রয়োজন ছিল ৪ রান, রাজ্জাক স্কুপ করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে বিপদ ডেকে এনেছিলেন আরেক দফা। শেষ বলে সিঙ্গেলের বেশি নিতে পারেননি মাহমুদউল্লাহ। ফাইনাল-গেড়োটা তখনও কাটানো হয়নি তাই।
আপনি জানেন কি?
এশিয়া কাপে (ওয়ানডে-টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে) ৩ ফাইনাল খেলেও একবারও জেতেনি বাংলাদেশ। সবচেয়ে বেশি ৫টি ফাইনাল হেরেছে শ্রীলঙ্কা, তারা অবশ্য জিতেছেও ৫টি।
আইসিসি ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি, বেঙ্গালুরু, ২০১৬, বিপক্ষ ভারত
১ রানে হার
২ মার্চ, ২০১৬। মিরপুর। মোহাম্মদ সামির আরেকটি নো-বলে থার্ডম্যানে গ্যাপটা বের করে উল্লাসে মাতলেন মাহমুদউল্লাহ, তখনও পাকিস্তানকে বিদায় করে এশিয়া কাপের ফাইনাল নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ৪ রান। পরের বলে সিঙ্গেল নিয়ে শেষ ওভারের প্রথম বলের স্ট্রাইক নিজের কাছে রাখলেন, আনোয়ার আলিকে চার মেরে আরেকদফা উচ্ছ্বাসে ভাসলেন তিনি।
ঠিক ২১ দিন পর বেঙ্গালুরুতে মাহমুদউল্লাহ উদযাপন করছিলেন মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে। হারদিক পান্ডিয়াকে স্কুপ করে চার মেরেছেন মুশফিকুর রহিম, শেষ ওভারে ১১ রানের প্রয়োজনীয়তাটা পরপর দুই বলে চারে নেমে এসেছে ৩ বলে ২ রানে। ৪ উইকেট বাকি বলে আপাতত ভাবনার বিষয় নয় সেটি। সেই ম্যাচটা হারতে হলে বিশেষ কিছু করতে হতো বাংলাদেশকে।
মুশফিকরা সেই আত্মহননের অসম্ভব পথটা নাও বেছে নিতে পারতেন।
পান্ডিয়াকে স্লগ করতে গিয়ে প্রথমে ফিরলেন তিনি, পরের বলে লো-ফুলটসে মাহমুদউল্লাহও ধরা পড়লেন ডিপে। শেষ বলে শুভাগত হোম বলটা ব্যাটে লাগাতে পারলেন না। দৌড় অবশ্য ঠিকই দিলেন।
তবে উইকেটের পেছনে প্রস্তুত হয়ে ছিলেন এমএস ধোনি। একহাতের গ্লাভস খুলে রেখেছিলেন, পান্ডিয়ার বলটা ধরে থ্রো-ও করলেন, দৌড় দিলেন স্টাম্প বরাবর। নন-স্ট্রাইক প্রান্তে থাকা মোস্তাফিজ সে ‘রেস’-এ ধোনির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারলেন না। অসম্ভবকে সম্ভব করে হারল বাংলাদেশ।
এ ম্যাচ জিতলে সেমিফাইনালের আশা টিকে থাকতো বাংলাদেশের, আর ভারত চলে যেত খাদের আরও কিনারে। সেসব আর হলো কই!
আপনি জানেন কি?
টি-টোয়েন্টিতে ১ রানের ব্যবধানে ভারত ম্যাচ জিতেছে আর একটি ম্যাচ, সেটিও ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টিতে, ২০১২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ১৪ রান। লাক্সমিপতি বালাজিকে প্রথম বলে ছয়ের পর আউট হয়েছিলেন অ্যালবি মরকেল। এক বল পর আরেকটি ছয় মেরেছিলেন অ্যালবির ভাই মরনি, শেষ ২ বলে প্রয়োজন ছিল ২, ৫ম বলে বোল্ড হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
নিদাহাস ট্রফি, ফাইনাল, ২০১৮, বিপক্ষ ভারত
৪ উইকেটে হার
প্যারালাল ইউনিভার্সে শুধু একটি ক্যাচ মিস লাগতো বাংলাদেশের। তাও আবার নিজেদের ফিল্ডারের হাত থেকেই। শেষ ওভারের পঞ্চম বলে সৌম্যর ফুললেংথের বলটা তুলে মেরেছিলেন বিজয় শঙ্কর, লং-অফে সাব্বির রহমানের হাত গলে বেড়িয়ে গিয়েছিল ক্যাচ, মেহেদি হাসান মিরাজ সেটি ধরে ফেললেন। অবশ্য ক্যাচ মিস হলে শঙ্কর আরেকটি রান নিতেন কিনা, সে প্রশ্নটা থেকে যায়। আরেকটি রান নিলে দীনেশ কার্তিক থাকেন নন-স্ট্রাইকে। হয়তো সুপার ওভারে যাওয়ার সম্ভাবনাটা বেশি থাকতো তখন বাংলাদেশের!
তবে সেসব হয়নি।
নাগিন ড্যান্স হয়েছিল এর আগে। হয়েছিল মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর বেঙ্গালুরুর শাপমোচন। ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কাকে বিদায় করে দেওয়া। কিংবা তারও আগে টুর্নামেন্টের আগে চোটে পড়ে ছিটকে যাওয়ার পরও দলের সঙ্গে গিয়ে খেলতে নেমে যাওয়া সাকিব আল হাসান- নিদাহাস ট্রফি বাংলাদেশের জন্য কম আলোচিত নয়।
সাব্বির রহমানের ৭৭ রানের পর শেষদিকে মাহমুদউল্লাহর ১৬ বলে ২১ ও মেহেদি হাসান মিরাজের ৭ বলে ১৯ রানের ক্যামিওতে ফাইনালে ১৬৬ রান তুলেছিল বাংলাদেশ, রোহিত শর্মার ফিফটির সঙ্গে লোকেশ রাহুলের ১৪ বলে ২৪ রানে মোটামুটি ভিত পেয়েছিল ভারত।
১৮তম ওভারে ১ রানের সঙ্গে মনিষ পান্ডের উইকেটে বাংলাদেশকে এগিয়ে দিলেন মোস্তাফিজ, তবে সাকিবের সামনে থাকলো শেষ ওভার কাকে দিয়ে করাবেন- সেই কঠিন সিদ্ধান্ত। ১ ওভারে ১৭ রান দিয়ে নিজেকে এ সমীকরণ থেকে যেন সরিয়ে নিয়েছিলেন মিরাজ, রুবেল হোসেন ১৯তম ওভারে দিলেন ২২ রান। ৬টি বল খেললেন দীনেশ কার্তিক, রান তুললেন এভাবে- ৬, ৪, ৬, ০, ২, ৪।
সৌম্য সরকারের জন্য বাকি থাকলো ১২ রান, প্রথম ৩ বলে ৩ রান দিয়ে প্রত্যাশার চেয়েও ভাল করলেন যেন তিনি। চতুর্থ বলে বিজয় শঙ্কর চার মারলেন, পঞ্চম বলে ঐ ক্যাচটা নিলেন সাব্বির+মিরাজ।
শেষ বলটা শুধু ছয় হওয়ার জন্যই ছয় হলো, নাহলে ওই উড়ানে কার্তিকের ওই শটে চারের চেয়ে বেশি কিছু তো হওয়ার কথা নয়। কতোখানি দৈর্ঘ্য হবে- এক ফুট, দুই ফুট। কার্তিকের শটটা এক্সট্রা কাভার বাউন্ডারির এতখানি ভেতরে পড়লে স্বপ্নটা আরও ১২ বলের জন্য টিকে থাকতে পারতো বাংলাদেশের।
তবে হৃদয়ভঙ্গের গল্পে ১ বলে ৫ রানের সম্বলে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানের শটটা সবসময়ই পড়ে বাউন্ডারির এক ফুট বা দুই ফুট বাইরেই।
আপনি জানেন কি?
উইকেটের হিসেবে এই ৪ উইকেটের জয়ের সমান বা কম ব্যবধানে ভারতের জয় আছে আরও ২টি। তবে এর একটিতেও শেষ বল পর্যন্ত যেতে হয়নি তাদের।