• ক্রিকেটারদের আলাপ
  • " />

     

    মুশফিকের ১৪৪, মাহমুদউল্লাহর ৪৩, মাশরাফির ৪ উইকেটঃ একের চোখে অন্যের যা প্রিয়

    মুশফিকের ১৪৪, মাহমুদউল্লাহর ৪৩, মাশরাফির ৪ উইকেটঃ একের চোখে অন্যের যা প্রিয়    

    ক্যারিয়ারের হিসেবে তো বটেই, নিজেরাও একসঙ্গে পথ চলার এক যুগেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। মাশরাফি বিন মুর্তজা, মাহমুদউল্লাহ, মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবাল- বাংলাদেশ জাতীয় দলের এই চার স্তম্ভ ড্রেসিংরুম ভাগাভাগি করছেন অনেক অনেক দিন থেকে। অন্যের পছন্দের ইনিংস বা স্পেল কোনটা, সেটি নিয়ে কথা বলতে বললে চারজনই তাই একটু থমকে গেছেন, ডুব দিতে হয়েছে স্মৃতির অতলান্তে। তারপরও প্রথমবারের মতো চারজন একসঙ্গে সতীর্থদের প্রিয় পারফরম্যান্সের কথা বলেছেন তামিম ইকবালের লাইভ-শোর সিজন ফিনালেতে।

    শুরুতে অবশ্য তামিম আলাদা আলাদা করে জানতে চেয়েছিলেন নিজেদের কাছে যার যার পছন্দের পারফরম্যান্সের কথা। ঠিক পছন্দের বলা অবশ্য ভুল হলো, তামিম আসলে জানতে চেয়েছিলেন সবচেয়ে ‘তৃপ্তিদায়ক’ পারফরম্যান্সের কথা। শুরুতে মাহমুদউল্লাহকেই প্রশ্ন করেছিলেন তামিম, তবে তিনি চিন্তা করতে একটু সময় নিলেন। তামিম সেই ফাঁকে ঘুরে এলেন মাশরাফির কাছে। তার কাছে প্রশ্নটা একটু বদলে হয়ে গেল, সবচেয়ে জোরে বল করেছিলেন কবে?

    মাশরাফি তখন চড়লেন টাইম মেশিনে। ২০০১ সালের সেই পুরনো মাশরাফি বিন মুর্তজার কথা উঠে এলো, যখন নড়াইল এক্সপ্রেস সত্যি সত্যিই ছিলেন স্পিডস্টার। সেই বছর নিউজিল্যান্ডে টেস্ট খেলতে গিয়েছিল বাংলাদেশ, হ্যামিল্টনে মাশরাফি আগুন ঝরিয়েছিলেন। মাশরাফির মনে আছে, সেই টেস্টে ১৪০ এর ওপর তো নিয়মিত বল করেছিলেনই, কখনো কখনো ১৪৫-৪৬ কিলো পর্যন্ত উঠেছে তার গতি। নিউজিল্যান্ড একবারই ব্যাট করেছিল, তাতে তিন উইকেট নিয়েছিলেন মাশরাফি। স্মৃতি অবশ্য মাশরাফির সঙ্গে একটু প্রতারণা করেছে, সেই টেস্টে ক্রেইগ ম্যাকমিলান, অ্যাডাম প্যারোরে ও ক্রিস কেয়ার্নসের উইকেট নিয়েছিলেন বলে তার মনে আছে। আসলে নিয়েছিলেন ম্যাকমিলানের সঙ্গে ফ্লেমিং আর ভিনসেন্টের উইকেট। তবে মাশরাফির চোখে ওটাই তার সবচেয়ে গতিময় বোলিং। এখানে মুশফিক যোগ করলেন মাশরাফিকে দেখা তার প্রথম স্মৃতির কথা। অনূর্ধ্ব ১৭ এশিয়া কাপের আগে একবার বিকেএসপিতে এসেছিলেন মাশরাফি। অনুশীলন ম্যাচে আগুন ঝরিয়েছিলেন, তখন মুশফিক কেবল ভর্তি হয়ে বলবয় ছিলেন। মাশরাফিকে প্রথম দেখার সেই মুহূর্তটা এখনো মনে আছে তার।

    এর ফাঁকে মাহমুদউল্লাহর মনে পড়ল তার ‘স্যাটিসফায়িং’ ইনিংসের কথা। বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংসটা ছিল মাত্র ১৮ বলের, কিন্তু ৪৩ রান করে নিদাহাস ট্রফিতে মাহমুদউল্লাহ এনে দিয়েছিলেন অবিশ্বাস্য একটা জয়। বাকি তিনজনও ধারণা করছিলেন, ‘রিয়াদ’ এই ইনিংসের কথাই বলবেন। আর মুশফিকের কাছে তার এশিয়া কাপে শ্রীলংকার বিপক্ষে ১৪৪ রানের ইনিংসটাই সবার আগে। বিরুদ্ধ কন্ডিশন, প্রচণ্ড গরম, তার ওপর শুরুতেই দলের বিপর্যয়- মুশফিক সেদিন একাই লড়েছিলেন। পাঁজরের চোট নিয়ে সেই ম্যাচ খেলছিলেন মুশফিক। পরে মাহমুদউল্লাহ বলছিলেন, আগের দিন ‘মুশি’ ব্যাটই ওঠাতে পারছিলেন না অনুশীলনে। সেই অবস্থা থেকেই খেললেন অমন ম্যাচ জেতানো একটা ইনিংস।

    এরপর তিন জনের কাছে যখন জানতে চাওয়া হলো কার কাছে কার ইনিংস প্রিয়, শুরুটা হলো মুশফিককে দিয়ে। মাশরাফির প্রিয় বোলিংয়ের কথা বলতে ২০০৬ সালে নাইরোবিতে মাশরাফির ২৬ রানে ৬ উইকেট নেওয়ার কথাই এলো। সেই ম্যাচে মুশফিক একাদশে ছিলেন না, তবে দেখেছিলেন ওই বোলিং। সেটি এখনও ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সেরা বোলিং হয়ে আছে। ২০০৭ সালে ভারতের বিপক্ষে সেই ম্যাচে মাশরাফির স্পেলটা তো আছেই, মুশফিক মনে করিয়ে দিলেন ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে মাশরাফির ৪ উইকেটের কথাও। অল্প পুঁজি নিয়েও সেই ম্যাচে দারুণ একটা জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ।

    মাহমুদউল্লাহর জন্যও মাশরাফির হাইলাটস বলতে এই ইনিংসগুলোই উঠে এলো। তবে ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই মহাকাব্যিক ম্যাচটাও মনে করিয়ে দিলেন মাহমুদউল্লাহ। সবাই সেই ম্যাচে রুবেলের সেই বোল্ড বা মাহমুদউল্লাহর সেঞ্চুরির কথাই মনে রাখে। তবে মাশরাফি দুই স্পেলে অ্যালেক্স হেলস আর জো রুটকে ফিরিয়ে দারুণ দুইটি ব্রেকথ্রু দিয়েছিলেন। আর মুশফিকের প্রিয় ইনিংস বলতে তিনিও বেছে নিলেন এশিয়া কাপের সেই ১৪৪। কন্ডিশন থেকে প্রেক্ষাপট সবকিছু মিলয়ে যেটি বাংলাদেশের ওয়ানডের সেরা ইনিংসের তালিকায় থাকবে।

     তামিম ইকবাল ২০০৭ বিশ্বকাপে মাশরাফির সেই ভারত-বধের বোলিংটা মূল্যায়ন করেন আলাদা কারণে। সেই ম্যাচের সময় সাকিব-তামিম-মুশফিক একদমই নতুন। তামিম নিজে যেমন মাত্র আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের হাওয়া লাগিয়েছেন। শচীন, সৌরভ, দ্রাবিড়দের বিপক্ষে খেলার ঘোর লেগে ছিল চোখে। কিন্তু দেখেছিলেন, কীভাবে এর মধ্যে একজন নিজেকে বড় মঞ্চে আলাদা করে দেখিয়ে যাচ্ছেন। ৩৮ রানে মাশরাফির সেই ৪ উইকেটের মূল্য তামিমের কাছে তাই অনেক। মুশফিকের ক্ষেত্রে বাকিদের মতো ১৪৪ রানের ইনিংসটাই বললেন। আর মাহমুদউল্লাহর ক্ষেত্রে নিদাহাস ট্রফির সেই ১৮ বলে ৪৩ রানের ইনিংস। তামিমের মতে, যেটি ছিল সত্যিকার অর্থে ‘অবিশ্বাস্য’।

    মাশরাফি অবশ্য বাকি তিন সতীর্থের একটু অন্য ইনিংসগুলো বেছে নিলেন। মাহমুদউল্লাহর ক্যারিয়ারে তার টার্নিং পয়েন্ট মনে হয় ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরিটা। তখনও বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে বাংলাদেশের কারও সেঞ্চুরি ছিল না, মাহমুদউল্লাহ সেটি করলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে। বাংলাদেশের কেউ যে বড় মঞ্চে পারে, মাহমুদউল্লাহর সেই বার্তার জন্য ইনিংসটা অন্যভাবে দেখেছেন মাশরাফি। মুশফিকের ক্ষেত্রে সবাই ১৪৪ রানের কথা বললেও মাশরাফির মনে আছে সেই ২০১৮ এশিয়া কাপেই পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯৯ রানের কথা। বাঁচামরার ওই ম্যাচে ১৬ রানেই ৩ উইকেট পড়ে যায় বাংলাদেশের। সেখান থেকে মিঠুনের সঙ্গে মুশফিকের ১৪৪ রানের জুটি পথ দেখিয়েছিল বাংলাদেশকে। ওই ৯৯ রানের ইনিংসটা তাই মাশরাফির কাছে স্পেশাল। আর তামিমের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো ইনিংস নয়, একটা সিরিজের কথা বললেন মাশরাফি। ২০১৫ বিশ্বকাপে সেভাবে জ্বলে উঠতে না পারার পর যখন তামিমকে শূলে চড়ানো হচ্ছিল, তখন দেশের মাটিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজটা তামিম দেখেছিলেন নিজেকে প্রমাণ করার মঞ্চ হিসেবে। ওয়ানডেতে দুইটি সেঞ্চুরি করেছিলেন, আরেকটি ছিল ফিফটি। টেস্টে করেছিলেন ডাবল সেঞ্চুরি। মাশরাফি সেই সিরজটা দেখেন তামিমের সব সন্দেহ উপড়ে ফেলার মিশন হিসেবে। সঙ্গে মাহমুদউল্লাহ মনে করিয়ে দিলেন, টেস্টের ডাবল সেঞ্চুরির সময় তামিম জুনাইদ খানকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে এভাবে ছয় মেরেছিলেন তা এখনো চোখে লেগে আছে।

    যেরকম অনেক দিন চোখে লেগে থাকবে তামিমের শোয়ের এই মুহূর্তগুলোও।