তামিম আর তার 'ব্যান্ড অফ ব্রাদার্স'-এর মিনি সিরিজ, সময় ১০.৩০
মোহাম্মদ সালাউদ্দিন এক টিভি সাক্ষাতকার দিচ্ছেন। তামিম ইকবাল উচ্চস্বরে বলে যাচ্ছেন, “হেরে গিয়ে আবার কীসের ইন্টারভিউ?” সালাউদ্দিন পাশ কাটানোর চেষ্টা করে আবারও মনযোগ দিলেন সাক্ষাতকারে। তামিম এরপর শের-ই-বাংলার মাঠে পানি ছিটানোর অতিকায় পাইপটা নিলেন গ্রাউন্ডসম্যানের কাছ থেকে, নিজে কিছুক্ষণ চেষ্টা করলেন। ক্যামেরা তাক হলো সেদিকে, মোবাইল ফোনের ক্যামেরাই তো যথেষ্ট আজকাল এসব ক্ষেত্রে।
গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্স ও প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবের ম্যাচটা শেষ হয়েছে, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের প্রথম রাউন্ডে মাহমুদউল্লাহ-সালাউদ্দিনের গাজীকে হারিয়ে দিয়েছে তামিমদের প্রাইম ব্যাংক। ততক্ষণে খবর ভাসছে, করোনাভাইরাস কভিড-১৯ মহামারির কবলে পড়ে স্থগিত হচ্ছে প্রিমিয়ার লিগ। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে, এক রাউন্ডের পর খেলা হয়নি আর।
সবকিছু ‘স্বাভাবিক’ থাকলে এ সময় তামিমদের থাকার কথা ছিল ইংল্যান্ডে, ২৪ মে চেমসফোর্ডে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ২য় টি-টোয়েন্টি হওয়ার কথা ছিল তাদের। অথচ এ সময় তামিম তার বাসায়, মাশরাফি বিন মুর্তজা, মাহমুদউল্লাহ বা মুশফিকুর রহিমও তাই। তাদের ১০.৩০-এর ভার্চুয়াল আড্ডা ১২.০০টা পেরিয়ে গেছে, ২৩ মে হয়ে গেছে ২৪ তারিখে।
সেই শো-তে এলেন সালাউদ্দিন। তামিম বললেন, “আমি তো আপনার সৎ ছেলে!” অথবা “অনেক ক্রিকেটার বানিয়েছেন, কিন্তু কখনও ভেবেছিলেন আমার শো-তে আসতে পারবেন?”
সেই ‘হারা’ ম্যাচের পর থেকে এই শো-তে সালাউদ্দিনকে দেওয়া তামিমের দুই ‘খোঁচা’র মাঝে পেরিয়ে গেছে দুই মাস এক সপ্তাহ। এবং সেটি কার্যত মাঠের ক্রিকেট ছাড়াই।
তবে এর মাঝে কিছুটা হুট করেই এসে তামিম গল্প বলেছেন, শুনেছেন, শুনিয়েছেন। তার ১০.৩০-এর মিনি সিরিজে।
****
দিনশেষে সবই নাকি গল্প বলা।
সিনেমা, বই, গান, সিরিজ, একটা ফিচার, এমনকি কমেডি স্পেশাল- এসব মাধ্যমের সেটাই সফল, যাতে গল্পটা বলা হয় সুচারুভাবে। যাতে দর্শক, পাঠক বা শ্রোতা মিশে যান। ভার্চুয়াল আড্ডা কি এর আওতায় পড়ে? সে বিচারের দায় আপাতত আপনি আমি না নিই। তবে শেষ ৩ সপ্তাহে তামিমের মাধ্যমে কতো কতো গল্প শুনেছি আমরা? মিশে গেছি, হেসেছি, কেমন আবেগ এসে ভর করেছে।
২৯ এপ্রিল তামিম সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোষণা দিলেন, মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে ইনস্টাগ্রাম লাইভ করবেন তিনি দিন তিনেক পর। সেই শো-এর শুরুতেই তিনি বলে নিলেন তার উদ্দেশ্যটা- যেহেতু তারা বিনোদনের ফেরিওয়ালা, এই কঠিন সময়েও কিছু সময়ের জন্য যাতে দর্শকদের বিনোদিত করা যায়। প্রেস কনফারেন্স বা এমন জায়গায় প্রশ্নের মুখোমুখি তামিম এবার নিজেই প্রশ্নকর্তা।
বাংলাদেশের ক্রিকেট দর্শকরা তখন পর্যন্ত এসব কিছুতে তেমন অভ্যস্ত নয়।
সিরিজের পাইলট এপিসোডটা এক কথায় যাকে বলে- ‘হিট’। মুশফিক কেন চুল উঁচু করে রাখেন, ওভালের ড্রেসিংরুমের ভেতর কেন ওয়াশরুমে গিয়ে বসে ছিলেন মুশফিক, অথবা কোথায় গেলেন স্টিভ হার্মিসনের অ্যাকশনওয়ালা সেই পেসার মুশফিক?
আলোচনা শুরু হলো এখানে-সেখানে। আপনি হয়তো নড়ে-চড়ে বসলেন।
৩-৪ হাজার লাইভ ভিউয়ার ছিলেন মুশফিকের সঙ্গে শো-তে। মুশফিকের পরের এপিসোডে মাহমুদউল্লাহ। নিদাহাস ট্রফি, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, কেন মাহমুদউল্লাহ বোলার হিসেবে তামিমের ত্রাস- গল্প চললো। এরপর তামিম তার শো-এর প্লাটফর্ম বদলালেন।
স্বাভাবিকভাবেই সোশ্যাল মিডিয়া হিসেবে ফেসবুকের মতো অন্যগুলি বাংলাদেশে জনপ্রিয় কিংবা ‘সহজবোধ্য’ নয়। মাশরাফি এলেন ফেসবুকে। লাইভ ভিউয়ারের সংখ্যা একসময় গিয়ে ঠেকলো ১ লাখে! মাশরাফির সঙ্গে শো-টা যেন ব্লকবাস্টার। এলেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের অ্যানালিস্ট- শ্রীনিবাস চন্দ্রশেকারান। মাশরাফি কবে ব্যাটিংয়ে নামতে ভয় পেয়েছিলেন, বীরেন্দর শেওয়াগকে বোল্ড করার পরিকল্পনা করেছিলেন ১০ দিন আগে থেকেই। থাকলো চোট, থাকলো তামিমের ব্যাট ‘মেরে দেওয়া’। ভার্চুয়াল থিয়েটার গমগম করে উঠলো-- উল্লাসে, হাততালিতে।
বন্ধু, সিনিয়রদের পর তামিম ডাকলেন জুনিয়রদের। তাসকিন আহমেদ, রুবেল হোসেনের সঙ্গে এলেন নাসির হোসেন। রুবেল কীভাবে তার ‘দাঁত’ হারিয়ে ফেলেছিলেন, অথবা তামিম নিজের জীবন বাঁচানোর আনন্দে ছুটেছিলেন তার পেছনে- আপনি হেসেছেন নিশ্চয়ই এসব শুনে।
এ প্রজন্ম থেকে তামিম ফিরে গেলেন আগের প্রজন্মে। বারবারই বলছিলেন, সে সময়ের গল্পটা শোনা উচিৎ। যখন এমন সুযোগ-সুবিধা ছিল না, তখনকার ক্রিকেটাররা কেন খেলেছিলেন? কীভাবে তারা ব্যাটনটা বয়ে আনলেন!
এলেন ডিজে- নাইমুর রহমান দুর্জয়। এলেন ব্যাশ- হাবিবুল বাশার সুমন। এলেন চাচা- খালেদ মাহমুদ সুজন। তামিম মনে করিয়ে দিলেন, অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এলেও ভ্রমণটা ভোলা উচিৎ নয়। সে ভ্রমণের গল্পটা শুনলেন, শোনালেন তামিম।
দেশের সীমানা ছাড়িয়ে এবার বিদেশ। ফাফ ডু প্লেসি অভিষেক টেস্টে কীভাবে জুতা প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলেন, কিংবা ২০১৫ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে অতিমানব গ্রান্ট এলিয়টের কাছে স্বপ্নভঙ্গের গল্পটা বললেন ডু প্লেসি। বছর পাঁচেক আগের অকল্যান্ডের সেই রাতে ফিরে গেলেন আপনি?
তামিমের অন্যতম প্রিয় প্রতিপক্ষ ভারত। তাদের বিপক্ষেই পোর্ট অফ স্পেনে ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে তামিম যেন অনেকখানি পথ এগিয়ে এসেছিলেন। সেই ভারতের, বাংলাদেশের আইসিসি টুর্নামেন্টের স্বীকৃত ত্রাস রোহিত শর্মা তার অতিথি। তামিম জানতে চাইলেন ওয়ানডেতে বড় ইনিংসের রহস্য। আইপিএলে গিয়েছিলেন তিনিও, ম্যাচ খেলা হয়নি। সে প্রসঙ্গ অকপটে সামনে আনলেন, আগের শোগুলির মতো এটিতেও ফুটে উঠল-- বিপিএলকে ঘিরে একটা ‘স্বপ্ন’ আছে তার- ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের একটা আলাদা ব্র্যান্ড, আলাদা ফ্যানবেজ।
আবারও দেশে ফেরা। লিটন দাস, সৌম্য সরকার, মুমিনুল হক, সঙ্গে তাইজুল ইসলাম। বিপিএলে লিটনের টেকনিকের পরিবর্তন, সৌম্য ও তাকে নিয়ে উচ্চাশা, মুমিনুলের টেস্ট অধিনায়কত্ব। ‘ঝাড়িটাড়ি কম মারিস রে ভাই, আমি তো তোর সিনিয়র’, মুমিনুলকে বলেন তামিম। আপনার মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে না?
তামিম এরপর চমক দিলেন বিরাট কোহলিকে এনে। এ সময়ের অন্যতম ‘পাওয়ারফুল’ ক্রিকেটারের কাছ থেকে তামিম জানতে চাইলেন কতো কিছু- অনুশীলন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে স্ট্যান্স, নিজেকে নিয়ে সংশয়। ‘ক্রিকেট পরিবারের’ একজন হিসেবে কোহলিকে নিয়ে গর্বের কথাও জানালেন। কোহলির সঙ্গে তামিমের আড্ডাকে এক কথায় আপনি বলতে পারেন- ‘মাস্টারক্লাস’। স্কাই, চ্যানেল নাইনের মতো প্লাটফর্মে যেসব দেখেন আপনি। সঙ্গে এলো ভাষা-বিতর্ক, 'হিট'-সিরিজের নিয়ম মেনেই যেন।
তামিমের শো ‘দেশে’র প্রেক্ষাপটে ফিরল আবার। এবার টাইমলাইন গেল আরেকটু আগের প্রজন্মে। ১৯৯৭, আইসিসি ট্রফি। তামিম বিশ্বাস করেন, সেবার যে উদযাপন হয়েছিল এদেশে ক্রিকেটকে ঘিরে, কোনোদিন বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতলেও সেটি হবে না আর।
আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, খালেদ মাসুদ পাইলটরা সেই স্বপ্নযাত্রার গল্পটা শোনালেন। সঙ্গে এলো প্রথম বিশ্বকাপ। এ আড্ডায় এলেন ‘আবাহনী’র কিংবা ‘৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তান অধিনায়ক ওয়াসিম আকরাম। স্মৃতিচারণের সঙ্গে ওয়াসিম বলে গেলেন, তামিম বা সাকিব আল হাসানের সঙ্গে তার লড়াইটা জমতো বেশ।
তামিমের শো যেমন জমে উঠেছিল।
****
না দেখা সিনেমা, কিংবা দেখা সিনেমা আবার দেখা, সিরিজ বিঞ্জওয়াচিং করা- হয়তো নিজেকে ব্যস্ত রাখতে এসব করেছেন আপনি। এখনও অপেক্ষায় আছেন, কবে ‘স্বাভাবিক’ হবে সবকিছু। চারদিকে অদ্ভুত এক সময়। এ প্রজন্ম কেন, বেশ লম্বা সময় ধরে মনুষ্য পৃথিবীই দেখেনি এমন সময়। জীবন যেখানে থমকে গেছে, ক্রিকেট সেখানে চলে কীভাবে?
কিন্তু ক্রিকেট তো শুধু মাঠেই সীমাবদ্ধ নয়। ক্রিকেট গল্পের কারিগর।
সে গল্প শুনতে রাত সাড়ে দশটা ১২ দিনের জন্য হয়ে উঠেছিল আমাদের ‘রিমাইন্ডার’। তামিম সে রিমাইন্ডার দিতে বাধ্য করেছিলেন। তার ইচ্ছা ছিল- পাঁচজনকে নিয়ে শেষটা করবেন। সাকিব থাকতে পারলেন না।
মাশরাফি, মাহমুদউল্লাহ, মুশফিককে একসঙ্গে নিয়ে এলেন তামিম। হাজির করলেন সালাউদ্দিনকে। প্রথমদিন কিছুটা ‘রিজার্ভ’ ছিলেন যেন মাহমুদউল্লাহ, এবার উজাড় করে দিলেন যেন সব। তাদের আড্ডা শুনে আপনি হয়তো উচ্চস্বরে হেসেছেন, টেবিলে চাপড় মেরেছেন।
কিংবা হুট করে ২০১১-তে ফিরে গিয়ে আবেগী হয়ে পড়েছেন, বেঙ্গালুরু ফিরে এসেছে। তবে শুনেছেন গল্প। যে গল্প ক্রিকেটারদের, ক্রিকেটের। যে গল্প কিছু মানুষের, যাদের কাজ আপনাকে-আমাকে আনন্দ-বেদনা-হাসি-কান্নার রোলার-কোস্টারে ঘুরিয়ে নিয়ে আসা।
“এই যে তুই (তোর) পোলাও বিরিয়ানি কোর্মা খাওয়ার পর হঠাৎ পান্তাভাত খাওয়ার ইচ্ছা হলো কেন ভাই? বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, ফাফ ডু প্লেসি, কেন উইলিয়ামসনের মতো পোলাও-বিরিয়ানির পর আমাদের মতো পান্তাভাত কেন?”
মাশরাফির প্রশ্নে তামিম বললেন, “আমরা বাংলাদেশী ভাই, পান্তাভাতই সবচেয়ে প্রিয়। বাঙালির প্রিয় তো পান্তাভাতই। আমি নিজেও পান্তাভাত, আপনারাও পান্তাভাত। আমার কোনও সমস্যা নাই।”
মাশরাফি ধন্যবাদ দিলেন।
আর সে পান্তাভাত ঠেকল অমৃতের মতো। এই মিনি-সিরিজের শেষ এপিসোডটা এর চেয়ে ভাল হতে পারতো কি?
****
তামিমের মুখে হাসি। সে হাসিটা নিয়েই বলে গেলেন, “বলতে খারাপই লাগছে, এটা আমাদের শেষ শো ছিল। আরেকবার বলি, যে কারণে আমাদের এই শো-টা করা। টাকা-পয়সা দিয়ে অনেকেই অনেক কিছু করেছেন, আমিও আমার দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু আমি মানুষজনের মাঝে যদি একটু খুশি আনতে পারি, কারণ আমরা অনেক ভুগছি। মানসিকভাবেও। এটাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। আলহামদুলিল্লাহ, সাড়াও ভাল ছিল।”
একটু মুখ ঘুরিয়ে, হয়তো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, “কাল থেকে সাড়ে দশটা বাজলে হয়তো আমার খারাপ লাগবে, কারণ আমি শো-টা অনেক উপভোগ করেছি। হয়তো ভবিষ্যতে লম্বা ছুটি পেলে এমন করার ইচ্ছা থাকবে। তবে এখন এটাই শেষ আমাদের।”
সেই শেষের আগে তামিম গল্প শুনলেন, শোনালেন। “একটু আনন্দ” দিতে চেয়েছিলেন, ক্ষণিকের জন্য ১০.৩০-এর তামিম-শো-কে বানিয়ে ফেললেন অভ্যাস, বন্ধু, সিনিয়র, জুনিয়র, অগ্রজ, প্রতিপক্ষ- তার 'ব্যান্ড অফ ব্রাদার্স'-কে নিয়ে।