ওয়ার্নের 'শতাব্দিসেরা গ্যাটিং বল' ও জাদুর 'প্রেস্টিজ'
“প্রত্যেকটি অসাধারণ জাদুরই তিনটা ধাপ থাকে। প্রথম ধাপটা প্রতিজ্ঞা, ‘দ্য প্লেজ’। জাদুকর আপনাকে সাধারণ কিছু একটা দেখাবেন- কার্ড, পাখি, বা একটা মানুষ। আপনাকে সেটি ভালভাবে দেখতে বলবেন। আদতেই সেটি বাস্তব কিনা, উলটাপালটা কিছু করা হয়েছে কিনা, সাধারণ কিনা। অবশ্যই সেসব সাধারণ নয়।
দ্বিতীয় ধাপটা পরিবর্তন। রুপান্তর- ‘দ্য টার্ন’। জাদুকর সাধারণ কিছুকে অসাধারণ বানাবেন যে ধাপে। আপনি এখন কৌশলটা খুঁজছেন এর পেছনের। কিন্তু পাবেন না, কারণ আপনি আসলে খুঁজছেন না। আদতে সত্যটা জানতে চান না আপনি, উলটো বোকা বনতে চান। তবে এখনই তালি দেবেন না আপনি। কারণ কোনও কিছু হাওয়া করে দেওয়াটাই যথেষ্ট নয়। আপনাকে সেটি ফিরিয়ে আনতে হবে।
প্রত্যেকটি জাদুর তাই শেষ একটি ধাপ থাকে, সবচেয়ে কঠিন একটি ধাপ। মর্যাদা। ‘দ্য প্রেস্টিজ’।”
-দ্য প্রেস্টিজ, ক্রিস্টোফার নোলান
ওল্ড ট্রাফোর্ড, ম্যানচেস্টার। ৪ জুন, ১৯৯৩। শেন ওয়ার্নের সব মিলিয়ে ৫ম ও ১ম অ্যাশেজ সিরিজ। ১ম টেস্ট। অস্ট্রেলিয়াকে আগে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়ে ২৮৯ রানে অল-আউট করল ইংল্যান্ড। মাইক আথারটন ও গ্রায়াম গুচ ভাল শুরু এনে দিলেন স্বাগতিকদের। আথারটনকে ফেরালেন মার্ভ হিউজ, অধিনায়ক গুচের সঙ্গে যোগ দিলেন গ্যাটিং। গ্যাটিংকে সেট হতে দিতে চান না অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডার। ডেকে পাঠালেন ওয়ার্নকে।
ওল্ড ট্রাফোর্ডে বৃষ্টিস্নাত দিন। ঠান্ডা বাতাস বইছে। তবে ম্যানচেস্টারের এ ভেন্যু স্পিনারদের সহায়তার জন্য পরিচিত। অবশ্য ওয়ার্ন তখন স্নায়ুচাপে ভুগছেন দারুণ। অ্যাশেজের মতো মঞ্চে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার উপক্রম তার। এর ওপর প্রস্তুতি ম্যাচ ভাল যায়নি।
উস্টারশায়ারের বিপক্ষে প্রথম কাউন্টি ম্যাচে দ্বিতীয় ইনিংসে ওয়ার্ন দিয়েছিলেন ২৩ ওভারে ১২২ রান। গ্রায়েম হিক তাকে ছয় মেরেছিলেন ৮টি। বোর্ডার বলেছিলেন, ওয়ার্নকে ‘সারপ্রাইজ প্যাকেজ’ হিসেবে রাখতে চান তিনি ইংলিশদের জন্য। ‘সাদা চুল’-এর লেগস্পিনারকে নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়ে গেছে এর আগেই, তবে তখন তো এতো ফুটেজ-বিশ্লেষণের বালাই বা উপায় নেই। ওয়ার্নকে কঠোরভাবে বলে দিয়েছিলেন, প্রস্তুতি ম্যাচে যাতে লেগস্পিন ছাড়া অন্য কিছু না করেন। ওয়ার্নের হাত নিশপিশ করছিল, একটা ফ্লিপার বা গুগলি মারার জন্য। মারলেন না।
তবে ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিলেন। নেটে ঝাড়ছিলেন রাগ। ওল্ড ট্রাফোর্ডে প্রথম টেস্টের আগে আত্মবিশ্বাস গিয়ে পৌঁছাল তলানীতে। জায়গা হারিয়ে ফেলতে পারেন, শঙ্কা করেছিলেন এমনও। চা-বিরতির আগ দিয়ে বোর্ডারের ডাক শুনে ওয়ার্নের মাথায় ঘুরছিল একটাই কথা, বলটা যাতে পিচের অন্যপ্রান্তে পৌঁছায়।
মিড-অফ থেকে হিউজ ওয়ার্নকে ‘বিরক্ত’ করছিলেন, “ওই বড় লেগস্পিনটা করো, ওই বলটা করো যেটা উলটো দিকে ঘোরে।” ডিকি বার্ডকে সুয়েটার দিয়ে ওয়ার্ন অ্যাশেজে নিজের প্রথম বলটা করতে গেলেন। ওভার দ্য উইকেট থেকে। গ্যাটিং তখন স্পিনে বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। ১৫ বছর ধরে খেলছেন। তার সামনে ওয়ার্ন সাধারণ একজন। ওয়ার্নের হাতের বলটাও তাই।
হাত থেকে বলটা বের হওয়ার পরই ওয়ার্নের ভাল লাগা কাজ করলো একটা। যাক, ঠিক আছে। ড্রিফট করলো, পড়লো গিয়ে লেগস্টাম্পের বাইরের রাফ-এ। গ্যাটিং ওয়ার্নের ‘প্লেজ বা প্রতিজ্ঞা’রুপি বলটাকে সাধারণই বিবেচনা করলেন। অবশ্য শুনতে পাচ্ছিলেন বলের হিসহিস ‘টার্ন’-এর শব্দ। ফ্রন্টফুটে ঝুঁকতে গেলেন, অ্যারাউন্ড দ্য লেগে বোল্ড যাতে না হন, খেয়াল রাখলেন সেদিকটাতেও।
তবে বলটা হুট করেই রূপ হলো ‘অসাধারণ’-এ। প্রায় আড়াই ফুট টার্ন করে গিয়ে আঘাত করলো অফস্টাম্পের মাথায়। একটা বল কীরকম হবে, কোনদিকে টার্ন করবে, সেটি ব্যাটসম্যানের মতো অনুমান করতে হয় উইকেটকিপারকেও। ইয়ান হিলি লেগস্টাম্পের বাইরে সরে গিয়েছিলেন। হুট করেই লাফিয়ে উঠলেন।
গ্যাটিং হতভম্ব। আদতে তিনি বল স্টাম্পে লাগার শব্দ পাননি। ঘুরে দেখেন বেল পড়ে গেছে, ভেবেছিলেন হিলি স্টাম্প ভেঙেছেন বল ধরে। খানিক বাদে হিলির কাছেই শুনলেন, বোল্ড হয়েছেন তিনি। তখনও ঠিক কী ঘটেছে বুঝতে পারেননি কেউ। আম্পায়ার বার্ডকেও ক্ষণিকের জন্য বিস্মিত লাগলো, ওল্ড ট্রাফোর্ডের শীতল বাতাসে কাঁপছেন তিনি তখন।
সে সিরিজে মাঠে জায়ান্ট স্ক্রিন বসানো হয়েছিল। সেখানেই রিপ্লেতে সবাই দেখলেন, আদতে তারা কীসের সাক্ষী হয়েছেন। হিলি বললেন ওয়ার্নকে, ক্যারিয়ারের সেরা বলটি তিনি করে ফেলেছেন। বিরতিতে গিয়ে বিবিসির প্রডাকশনে বারবার দেখলেন ওয়ার্নরাও। ওয়ার্ন বুঝলেন, ‘অসাধারণ’ কিছু করে ফেলেছেন।
তবে ‘প্রেস্টিজ’ বা ‘মর্যাদা’টা তো বাকি। ওয়ার্ন নিজেও বলেন, সেই বলটা আদতে ‘ফ্লুক’ ছিল। শুধু হাত থেকে বের হওয়ার পর তার একটা ভাল লাগা কাজ করেছিল। বলে ড্রিফট ছিল, পর্যাপ্ত রেভস ছিল, পরে ইয়া বড় এক টার্ন করেছে যেটি রাফে পড়ে।
ওয়ার্ন সে সফরে ইংল্যান্ড যাওয়ার আগে হিউজকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কেমন সফর এই অ্যাশেজ’। হিউজ বলেছিলেন, ‘টেস্টে রেস্ট-ডে থাকে। স্পন্সর হিসেবে থাকে ফোর-এক্স, মুফতে বিয়ার পাবে তাই। আর ইংল্যান্ড দল হিসেবে জঘন্য।’
ওয়ার্ন ভেবেছিলেন, ‘বেশ তো’।
সেই সফরের প্রথম বলটাই বদলে দিল তার জীবন। বদলে দিল ক্রিকেটও।
ওয়ার্ন ফ্লুক বলুন আর যাই বলুন, সে বল নিয়ে কথা শুরু হয়ে গেল। গ্যাটিংকে নিয়ে কৌতুকও শুরু হলো-- ‘হ্যামবার্গার বা স্যান্ডউইচ হলে তিনি দেখতে পেতেন সেটি, বল বলে দেখেননি।’ গ্যাটিংয়ের শুরুতে মনে হয়েছিল, এই লেগস্পিনার অল্পতেই থেমে গেলে খারাপ লাগবে তার।
গ্যাটিং যেটি বলতে চাচ্ছিলেন, ওয়ার্ন নামের জাদুকরের ‘দ্য প্রেস্টিজ’ বা ‘মর্যাদা’র ধাপটি বাকি আছে। ওয়ার্নের ভাষায়, ঠিক গ্যাটিংয়ের মতো ডেলিভারিতেই বিশাল টার্নে রবিন স্মিথকে আউট করেছিলেন তিনি। সে সিরিজে ওয়ার্ন নিয়েছিলেন ৬ ম্যাচে ৩৪ উইকেট।
ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে ২০০৫ সালে যান। অ্যাশেজে এপিক-এজবাস্টন টেস্ট। ৫ আগস্ট, বিকেল ৫.৫৫। রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে ওয়ার্নের করা বলটা প্যাড-আপ করতে গেলেন অ্যান্ড্রিউ স্ট্রাউস, বলের লাইনে ঠিকঠাকই গিয়েছিলেন। হঠাৎ করেই খেয়াল করলেন, আদতে কিছু করার নেই আর তার। প্রায় ২ ফুট টার্ন করে বলটা গিয়ে লাগলো মিডল-লেগে। স্ট্রাউস হতভম্ব।
গ্যাটিংয়ের বলটা ছিল ‘বিংশ শতাব্দির সেরা বল’, এটি যেন একবিংশ শতাব্দির। মাঝে শিবনারাইন চন্দরপলকে সিডনিতে এতো বড় টার্নে আউট করেছিলেন। ক্যারিয়ারজুড়েই ব্যাটসম্যানকে নিয়ে খেলেছেন, দেখিয়েছেন জাদু।
ক্যারিয়ারে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের মাটিতেই নিয়েছেন ২২ টেস্টে ১২৯ উইকেট। ক্যারিয়ার শেষ করেছিলেন ৭০৮ উইকেট নিয়ে। টেস্টের সেরা লেগস্পিনার হিসেবে, তর্কসাপেক্ষে সেরা স্পিনার হিসেবে। ১৯৯৩ সালের ৪ জুন ওল্ড ট্রাফোর্ডে যদি জাদুর ‘প্লেজ বা প্রতিজ্ঞা’ ও ‘টার্ন বা রুপান্তর’ দেখিয়ে থাকেন ওয়ার্ন, ক্যারিয়ারজুড়েই ছিল তার ‘মর্যাদা’। বা ‘দ্য প্রেস্টিজ’। যে জাদুতে আপনি শুধু বিমোহিত হতে পারেন।