মেসি হওয়ার জ্বালা
লিওনেল মেসির ৩৩তম জন্মদিন আজ, এতক্ষণে হয়তো জেনে গেছেন আপনি। অন দিস ডে হয়তো মনে করিয়ে দিয়েছে আপনাকে। তবে জন্মদিনের প্রথম প্রহরে মেসি একটু আনমনে হয়ে ভাবতে পারেন, ৩৩ বছরে পাওয়া আর না পাওয়ার হিসেবটা কেমন হলো? বিশ্বসংসার তন্নতন্ন করে কেউ বিশ্বকাপটা নিয়ে আসেনি, আজকের দিনে নিজেকে দেওয়া এই কথা রাখতে না পারাটা হয়তো চকিতে মনে পড়ে যাবে তার।
আপনি ফুটবলের নিয়মিত দর্শক হলে মেসি আপনার জীবনের অনেকটা জুড়ে থাকার কথা। মেসির মতো একই প্রজন্মের হলে আপনার হয়তো মনে থাকবে; স্কুল থেকে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি যখন পার হয়েছেন, মেসির ক্লিনশেভড থেকে মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি হয়েছে। লম্বা চুল ছেটে ফেলে ছোট করেছেন মেসি, আপনারও বয়স একটু একটু করে বাড়তে শুরু করেছে। শুধু একটা ব্যাপার বদলায়নি, শনিবারের রাতে আপনি আগের মতোই মেসির গোল দেখে শিহরিত হয়েছেন। বোয়েটাংকে ঘোল খাইয়ে গোল করানোর মুহূর্তে আপনার রাতের ঘুমঘুম ভাব কেটে গেছে নিমেষের মধ্যে, ফ্রিকিক থেকে একের পর এক গোল দেখে আপনার শনিবারের রাত জাগার পালা দিন দিন বেড়েছে। ইট কাঠের ঘাম আর জঞ্জালে ভরা শহরে আপনি ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে অপেক্ষা করেছেন মঙ্গলবারের চ্যাম্পিয়নস লিগের রাতের জন্য। সপ্তাহশেষে রোনালদো-মেসির ক্লাসিকোর জন্য আপনি অফিসের বসকে টেক্সট পাঠিয়ে রেখেছেন, ‘রোববার সকালে অফিসে আসতে একটু দেরি হবে।’ আপনার জীবনে হতাশা এসেছে, আনন্দ এসেছে, প্রেম বা বিরহও হয়তো এসেছে (বা আসেনি); কিন্তু স্বতঃসিদ্ধের মতো আপনি জানতেন মেসি আপনাকে কমই হতাশ করবে। অথচ টিভি দেখতে দেখতে আপনি জানেন মেসির পায়ে বল গেলে কী হতে চলেছে।
আপনি জানেন, প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডার জানে, রেফারি বা ন্যু ক্যাম্পে স্লোগান তোলা দর্শকেরাও জানে। বাঁ পায়ে বল পাওয়ার পর আপনি দেখতে পাচ্ছেন, এই তো এখনই শুরু হবে সেই দৌড়। একজন বা দুজন ডিফেন্ডার ছিটকে পড়বে এদিক ওদিক, যেভাবে ভিআইপিকে পথ করে দিতে সরে যায় সামনের সব গাড়ি। ট্যাকল করার চেষ্টা করবে সবাই, হয়তো কেউ কেউ মেসির গায়ে পা-ও লাগিয়ে দিতে পারে। কিন্তু আপনি জানেন, মেসি পড়ে যেতে যেতেও পড়বে না। রোজারিওর মাঠে ছোট্ট মেসি পড়ে যাওয়ার পর ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াত আবার, তারপরও বলের কাছছাড়া করত না। বড় হয়েও যতক্ষণ না পড়ে যাচ্ছে ততক্ষণ মেসির পায়ের কাছে চুম্বকের মতোই সেঁটে থাকত বল। আপনি দেখতে পাচ্ছেন, ডান দিক দৌড়ে মেসি শুধু একটা জায়গা খুঁজছেন শট করার। ডিফেন্ডাররাও সেটা জানেন, কিন্তু সেই চলমান অশরীরীর মতো সেই মেসি অমোঘ হয়ে ছুটে আসেন। শুধু একটু জায়গার অপেক্ষা, এরপরেই বাঁ পায়ের কাঁটাকম্পাস দিয়ে মাপা শট। গোলকিপারও যেন পুরো দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছেন সিনেমার স্লো মোশনের মতো। অনুশীলনে ভিডিওতে বার বার বলা হয়েছিল, এভাবেই মেসি আসবে। এই কোণা থেকেই শট নেবে। কিন্তু নিয়তিকে রুখবার সাধ্য কী তার? ফ্রিকিক হলেও গোলকিপার জানেন, মেসি কোন প্রান্ত দিয়ে শট নেবেন। তাতে কী আর কাজ হয়?সেই বাঁকানো ফ্রিকিক অব্যর্থ মিসাইলের মতো তাই ঢুকে যায় শত্রুবুহ্যের ভেতর। কুরুক্ষেত্রে অভিমন্যু ব্যুহ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলেও মেসির শট ঠিকই ঢুকে যায় জালে।
আজকের দিনে আপনি হয়তো ভেবে একটু বিষণ্ণ হতে পারেন, একটু একটু করে ফুরিয়ে আসছে সময়। বয়স ত্রিশের ভুল দরজায় ঢুকে গেছে অনেক আগেই। অনেক কিংবদন্তির বুটেই এই বয়স থেকে মরচে ধরতে শুরু করে, কেউ কেউ শুনতে পান অবসরের সিম্ফোনি। মেসির ওপর যে বয়সের ছাপ পড়েনি তা নয়। রক্ষণে এখন আর আগের মতো অবদান রাখেন না, বল পেয়ে আগের মতো নিয়মিত সেই অবিশ্বাস্য দৌড়ে কয়েকজনকে ছিটকে ফেলে দেন না। এখন খেলার চেয়ে খেলানোতেই মনযোগ অনেক বেশি। অথচ কী অদ্ভুত, এই বয়সেও গোলের জন্য তার ওপরেই নির্ভর করে দল। এই মৌসুমে এখনও লা লিগায় সবচেয়ে বেশি গোল তার, এখনও তাকে ছাড়া খেলতে নামলে পথ হারিয়ে ফেলে দল। কিন্তু সবকিছুরই তো শেষ আছে। মেসি এই মুহূর্তে যতই অপরিহার্য হোন, একটা সময় শেষ তাকে বলতেই হবে। বার্সেলোনার জার্সি গায়ে ১০ নম্বর জার্সিটা মেসি আর পরছেন না, এমন দৃশ্য দেখতেই হবে। প্রতিটা জন্মদিন সেই বাস্তবতার দিকেই এগিয়ে নিয়ে যায় একটু একটু করে। আপনি মেসির ভক্ত না হলেও সেদিনের কথা ভেবে একটু বিষণ্ণ আপনার লাগতেও পারে।মেসিকে ছাড়া ফুটবল হচ্ছে, এই দৃশ্য দেখতে তো এই প্রজন্মের অনেকেই অভ্যস্ত নয়!
মর্ত্য ও অমর্ত্যের ব্যবধান যে ট্রফি
১৫ বছর আগে বার্সেলোনার দলটার কথাই চিন্তা করুন। মেসি ছাড়া সবাই অনেক আগেই চলে গেছেন অনেক আগেই। একটা সময় ‘বড়দা’ রোনালদিনহো ছায়া হয়ে ছিলেন মাথার ওপর। খুব দ্রুত সেই জায়গাটা নিয়েছেন মেসি। ডান প্রান্তে খেলা শুরু করে ফলস নাইনে এসেছেন, আবার খেলেছেন বাঁ প্রান্তে। অঁরি, ইতো, ইব্রা, ভিয়া, সুয়ারেজ… বিশ্বমানের কম স্ট্রাইকারের সঙ্গে খেলেননি বার্সেলোনায়। কিন্তু গোল করার কাজটা তার মতো আর কেউ করতে পারেনি। জাভি, ইনিয়েস্তার সঙ্গে ক্যারিয়ারের প্রায় অনেকটুকু কাটিয়েছেন, এই দুজনের সঙ্গে টেলিপ্যাথিক একটা যোগাযোগই যেন ছিল। নেইমার আসার পর সুয়ারেজকে মিলে এমএসএন ত্রয়ীতে একের পর এক জয়ের গল্প লিখেছেন। সেই নেইমারও নেই এখন, একদম তরুণ ডেম্বেলেরাও এখনও নিতে পারেননি তার জায়গা। দলের দরকারে এখন মাঝেসাঝে নিচে নেমে খেলেছেন, কিন্তু এখনও তাঁর বাঁ পাটাই স্পেনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত পিস্তল। ক্লাবের হয়ে সম্ভাব্য সবকিছুই জিতেছেন। তারপরও মেসিকে নিয়ে কথা হলে যেন প্রাপ্তির চেয়ে আক্ষেপ নিয়েই গল্প হয় বেশি। বিশ্বকাপের অতৃপ্তি তো পুরনো, প্রতি চার বছর পর তা ফিরে ফিরে আসে। কে জানে, হয়তো পরের বিশ্বকাপে ৩৫ বছরেও আসবে। বার্সেলোনার হয়েও বিশেষ করে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেই হারিয়ে ফেলেন, সেই কথাও কম হয় না। রোমের বিপক্ষে সেদিন কেন প্রেরণা দিতে পারলেন না সতীর্থদের? বা লিভারপুলের বিপক্ষে অ্যানফিল্ডে কেন এরকম ছায়া হয়ে ছিলেন? মেসির খেলার সঙ্গে তার নেতৃত্ব নিয়েও উঠে যায় প্রশ্ন।
অথচ এই লোকটা তো চাইলেই সব পেতে পারতেন। ১৯ বছর বয়সেই স্পেনের নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন, চাইলে লাল জার্সি গায়েই কাটিয়ে দিতে পারতেন বাকি ক্যারিয়ার। জাভি, ইনিয়েস্তাদের সঙ্গে সর্বজয়ী স্পেন দলের একজন হওয়ার জন্য মঞ্চটা তো তার জন্য সাজানোই ছিল। আর্জেন্টিনার হয়ে ভালোবাসা পেতে কাটিয়ে দিতে হয়েছে প্রায় এক জীবন, অথচ উপেক্ষা আর অবহেলা কি কম পেয়েছেন? ম্যারাডোনা, তেভেজরা ফুটপাথে খেলে বেড়ে উঠেছেন, সারাজীবন ঘরের ছেলের মতো বরণ করে নিয়েছে আবেগী আর্জেন্টাইনরা। মেসি তাদের কাছে ছিল বড়লোকের সেই ছেলেটার মতো, যে মাঝেমধ্যে ছুটি কাটাতে আসত এলাকায়। ম্যারাডোনার মতো ক্যারিশমা কখনোই ছিল না তার, এমনকি তেভেজও অনেক বেশি জনপ্রিয় তার চাইতে। নিজের জন্মস্থান রোজারিওতেই তাঁকে নিয়ে খুব মাতামাতি ছিল না, তাকে আপন করে নেয়নি কেউ কখনো সেখানে। আর্জেন্টিনায় তো তাঁর মূর্তি ভাঙার ঘটনাও ঘটেছে। ম্যারাডোনাকে কখনো কারও মতো হতে হয়নি, অথচ মেসিকে সারাজীবন ম্যারাডোনার মতো হয়ে ওঠার জন্য অদৃশ্য একটা তপস্যা হয়েছে পুরো আর্জেন্টিনা জুড়ে। অথচ স্বল্পবাক মেসিও বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন, মনেপ্রাণে সব সময় তিনি একজন আর্জেন্টাইন। রোজারিওর একটা মেয়ের সঙ্গেই ঘর বেঁধেছেন, কোল আলো করে এসেছে তিনটি ফুটফুটে ছেলে। এখনো ছেলেবেলার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে তাঁর, ছুটি কাটাতে মাঝেমধ্যে ছুটে যান সেখানে। এত বছর স্পেনে থাকার পরেও কথায় সেই রোজারিওর আঞ্চলিক টানটাও গোপন থাকে না। রোজারিওর স্থানীয় খাবার এখনও তার সবচাইতে প্রিয়। বিশ্বকাপের ব্যর্থতার পরও তাই চেষ্টা করে গেছেন দেশের হয়ে কিছু একটা পাওয়ার আশায়, ‘অবসর নাটকের’ পরও আবার গায়ে চড়িয়ে নিয়ে গেছেন আকাশী নীল জার্সি। ত্রিশ পেরিয়েও বিশ্বকাপে যাওয়ার জন্য মেসির ওপরেই ভরসা করতে হয়েছে আর্জেন্টিনাকে, নইলে কবেই ভেঙে যেত রথের চাকা! একবুক কষ্ট নিয়ে তাই বলেছেন, দেশের হয়ে একটা বিশ্বকাপের জন্য সব ছেড়ে দিতে রাজি আছেন।
হে মহারাজ , এসো আমাদের সমতলে
মেসি একটু অন্তর্মুখী বলেই হয়তো অনেক প্রশ্নের জবাব দেননি। অথচ চাইলেই দিতে পারতেন। পুরো ক্যারিয়ার বার্সাতেই কাটিয়ে দিয়েছেন। অন্য লিগের চ্যালেঞ্জ নিতে চান না, এমন অভিযোগ তো প্রায়ই ওঠে। ইংলিশ লিগে কেমন করতেন, তা নিয়ে সংশয়বাদীদের দলটা কম ভারি নয়। তবে মেসি বলতে পারতেন, চ্যাম্পিয়নস লিগে ইংলিশ প্রতিপক্ষের সঙ্গে ৩০ ম্যাচে ২২ গোল আছে তার। বিশ্বকাপ নিয়ে এত কথা হয়, অথচ বুরুচাগা গোল না করলে ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ হয়তো পাওয়া হতো না। হিগুয়াইন বুরুচাগা হতে পারলে হয়তো এই তর্কও শেষ হয়ে যেত। তবে মেসি এসব নিয়ে অনুযোগ করেননি। ‘ঝিনুক তুমি নীরবে সহোর’ মতো সয়েই গেছেন। হয়তো নিজেকে আরেকটু প্রকাশ করতে পারলে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতেন, অন্তত প্রাণ খুলে নিজের কথাটা বলতে পারতেন। নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করেন বলে হয়তো মাঠে নিজেকে ‘নেতাও’ প্রমাণ করা হয়নি। তবে মেসি চাইলে বলতে পারতেন, পারফরম্যান্স দিয়েই তো কম উদ্দীপ্ত করেননি দলকে। বার্সেলোনার কথা না হয় বাদ গেল, আর্জেন্টিনা তো তার কাঁধে চড়ছে সেই কবে থেকে। মেসি এসব নিয়ে সবসময় মৌনীই থেকেছেন।
সর্বকালের সেরাদের তালিকায় তাই মেসির স্থান কোথায়, সেটা নিয়ে তর্ক করতে গেলে আপনি তাই নিজেকেই বঞ্চিত করবেন শুধু। ব্যালন ডি অর বা একের পর এক রেকর্ড দিয়েও তাঁকে বিচার করতে যাওয়া আসলে হবে বোকামি। বিশ্বকাপ পেয়ে গেলেই মেসি ফুটবলের অবিস্ংবাদিত সম্রাট হয়ে যেতেন কি না, সেটা নিয়ে তর্ক করাটাও তাই কাজের কথা নয়। আপনি বার্সেলোনার বা আর্জেন্টিনার সমর্থক হোন বা না হোন, তাতেও আসলে কিছু যায় আসে না। আপনি শুধু নিজেকে কল্পনা করতে পারেন আফগানিস্তানে পলিথিনে মেসির নাম লেখানো আলী মুর্তজা নামের সেই শিশুটির জায়গায়। মেসিকে কাছে পেয়ে যে শিশুটি তাঁকে কাছছাড়া করতে চাইছিল না কোনোভাবেই। মুর্তজার মতো এমন অনেক শিশুর মধ্যেই আসলে বেঁচে থাকবেন মেসি। তাঁর হতাশা নিয়ে অনেক লেখা হতে পারে, তাঁর বিশ্বকাপের অপূর্ণতা নিয়ে চলতে পারে কাঁটাছেড়া- কিন্তু এসব একদিক দিয়ে গুরুত্বহীন। মেসি যেমন বলেছিলেন, ছোটবেলায় রোজারিওর রাস্তায় খেলতে গিয়ে যে মজা পেতেন, এখনো মাঠে নামলে সেই একই রকম উপভোগ করেন। ফুটবল খেলার যে সত্যিকারের আনন্দ, সেটা মেসির মতো কয়জন ধারণ করেন? এই পথ চলাতেই আর আনন্দ, সেটির ভাগ থেকে আপনি বঞ্চিত হবেন কেন?
আরও কিছুদিন মেসি সেই আনন্দ দিয়ে যাবেন, আজকের দিনেই এটাই যা সান্ত্বনা!