• এশিয়া কাপ ২০১৮
  • " />

     

    এশিয়ার ক্রিকেট "বিদ্রোহ"- দ্বিতীয় পর্ব

    এশিয়ার ক্রিকেট "বিদ্রোহ"- দ্বিতীয় পর্ব    

    ফুটবলের মত ক্রিকেটে মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের কোন বালাই নেই। প্রত্যেক মহাদেশে আইসিসির পূর্ণ সদস্যই যে মাত্র হাতে গোণা! ক্রিকেট পাগল উপমহাদেশীয়রা তাই দুনিয়ার একমাত্র মহাদেশীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট নিয়ে বড়াই করতেই পারে! দু'বছর বাদে আবার দুয়ারে এশিয়া কাপ। প্রথা ভেঙ্গে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে আসা এই টুর্নামেন্ট শুরুর প্রাক্কালে চলুন ঘুরে আসা যাক এর ইতিহাস থেকে। ৩২ বছরের পুরনো এই টুর্নামেন্টে কালের ধুলো কম পড়েনি আসলে।  আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব... 


     

    এশীয় রোমাঞ্চ...

    ইডেন পার্ক, অকল্যান্ড। ধুঁকে ধুঁকে সেমিতে উঠা পাকিস্তানের সামনে অকুতোভয় নিউজিল্যান্ড। ঘরের মাঠে ফাইনালে উঠার লড়াই একপেশে হবে এটাই ভেবেছিলেন সবাই। ১৯৯২ সালের ঐ বিশ্বকাপটার কথা বহুল চর্চিত হয়ে গেছে, ‘কর্নার্ড টাইগার’ থেকে আগ্রাসি বাঘ বনে বিশ্বমঞ্চ থেকে পাকিস্তানের শিরোপা ছিনিয়ে আনার কাহিনীটা তবুও পুরনো হয়না! আসলে গ্রেটদের জন্মের সময় মহাকালের চিৎকার গগনস্পর্শী; সে ইতিহাস তাই আপনি-আমি চাইলেও কালের ধুলায় লুকিয়ে পড়বে না!

    ঐ বিশ্বকাপ থেকেই আসলে এশিয়ার দিগ্বিজয়ের সূচনা! মুলতানের অচেনা অখ্যাত এক গাট্টাগোট্টা তরুণ ঐ বিশ্বকাপেই তো শেখালেন ‘অলস সৌন্দর্য’ এর ব্যাখ্যা। সুইংয়ের নেশায় মাতাল করে একজন বাঁহাতি পেসার ঐ মঞ্চেই তো বেছালেন ক্রিকেটীয় ইন্দ্রজাল। মেলবোর্নের সেই বিশ্বজয়ের পর পাকিস্তান দলটা আসলেই যেন হয়ে গেল ক্রিকেটীয় সুধার আধার। এতকাল পরে এসে ঐ দলের নামগুলো শুনলেও তো তাই রোমাঞ্চ জাগে - ইনজামাম, ওয়াসিম, ওয়াকার, সাকলাইন, সাঈদ আনোয়ার। নব্বইয়ের দশক যত এগিয়েছে দলে আসা তরুণ নামগুলো তাঁদের অসামান্য পারফরম্যান্স দিয়ে আরো রোমাঞ্চ ছড়িয়েছে!

    আর শ্রীলঙ্কা? তাঁরা তো তখন চোয়ালবদ্ধ; ‘মিনোস’ এর খোলস ছেড়ে শিকারির কাতারে নাম লেখাতে একজন অর্জুনার নেতৃত্বে তাঁরা তখন মরিয়া। ইনিংস সূচনায় জয়াসুরিয়া, মিডল অর্ডারে ডি সিলভার মত ধ্রুপদী সৌন্দর্য আর সাথে রানাতুঙ্গা, মহানামা, তিলকরাত্নেদের নির্ভরতা - লঙ্কান ব্যাটিং লাইনআপ ছিল যেকোন বোলিং আক্রমণকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে প্রস্তুত। পেস ব্যাটারির নেতৃত্বে ছিলেন চামিন্ডা ভাস। সাথে স্পিনের বিভ্রম নিয়ে একজন মুত্তিয়া মুরালিধরন।

    শচীন তখন বিশ্ব শাসন করতে শুরু করেছেন; সাথে কাম্বলি, মাঞ্জরেকার, সিধু, কুম্বলে,আজহারউদ্দিনের নিয়ে ভারত দলটাকেও আপনি কিছুতেই অবজ্ঞা করতে পারেন না। আসলে ক্রিকেটেরই তখন স্বর্ণযুগ- ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার তখনকার স্কোয়াড সে সোনারই একটা পরশ মাত্র। এই তিনদলের মাঠের লড়াইয়ে রোমাঞ্চ যে তাই উপচে পড়বে এতে আর অবাক হবার কি আছে?

    এশিয়া কাপ তাই তখন শুধু একটা বিদ্রোহ টুর্নামেন্ট কেবল নয়; বলের সাথে ব্যাটের, শৌর্যের সাথে প্রাবল্যের আর বীরের সাথে বীরের - নব্বই দশকের এশিয়া কাপগুলোকে আপনি এভাবে তুলনা করলেও তাই অত্যুক্তি হয়না। রোমাঞ্চের পসরা বসানো সেই এশিয়া কাপগুলো আর কেবল সিগারেট কোম্পানিগুলোর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেনি। স্পন্সরের ডালা ঝাঁপিয়ে পরেছে সেখানে; উড়েছে কোটি কোটি ডলার। উপমহাদেশ সেখান থেকেই হয়েছে শক্তিশালী ক্রিকেট স্তম্ভ। ভারত হয়েছে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা ধনী ক্রিকেট বোর্ড।


    আরো পড়ুনঃ 

    এশিয়ায় ক্রিকেট "বিদ্রোহ"- প্রথম পর্ব


    ছন্দপতন...

    ১৯৯৭ পেপসি এশিয়া কাপের পূর্ব পর্যন্ত এশিয়া কাপের ছক ছিল বাঁধা! বাংলাদেশ শুধু খেলার আনন্দেই যাবে, পাকিস্তান ভাল খেলতে খেলতে শেষ মুহুর্তে এসে খেই হারাবে এবং ফাইনালে ভারত-শ্রীলঙ্কা ফাইনাল খেলে ভারত কাপ জিতবে। আগে হওয়া ৫টি আসরের চারটিতেই এশিয়া কাপ জয়ীর নাম তাই ভারত।

    ওই বছরের এশিয়া কাপের চিত্রনাট্যের মঞ্চায়নটাও চলছিল একই ধাঁচে। কিন্তু ফাইনালে উঠে আর বিশ্বজয়ী শ্রীলঙ্কা দল পুনরায় ভুল করল না। ভারতকে রীতিমত নাকানি-চুবানি খাইয়ে ঘরের মাঠে দ্বিতীয়বারের মতো কাপ জিতল তখনকার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা। পুরো টুর্নামেন্টে একটা ম্যাচও তারা হারেনি, আসলে কোন দলই তাদের সাথে বিন্দুমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেনি। ওপেনিংয়ে জয়াসুরিয়া-কালুভিথারানা, মিডল অর্ডারে আতাপাত্তু, গুরুসিনহা, ডি সিলভা, রানাতুঙ্গা আর বোলিংয়ে ভাস, মুরালি, ধর্মসেনা - প্রত্যেকে ছিলেন নিখুঁত। দলের সব ব্যাটসম্যানের ঐ টুর্নামেন্টে স্ট্রাইক রেট ছিল আশির কাছাকাছি নয়তো উপরে। টুর্নামেন্টসেরাও একজন শ্রীলঙ্কান - অর্জুনা রানাতুঙ্গা!

     

     

    বাংলাদেশ কিন্তু ঐ টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচটা ভালই খেলেছিল। পাকিস্তানের ৩১৯ রানের জবাবে খেলতে নেমে পুরো ৫০ ওভার টিকে করেছিল ২১০ রান। আতহার আলী এবং আকরাম খান দুইজনই পেয়েছিলেন ফিফটি। পাকিস্তানি বোলিংয়ের বিরুদ্ধে এই স্কোর মোটেও মন্দ নয়! কিন্তু এরপরই আবার তালগোল পাকিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কা আর ভারতের সাথে বিশাল ব্যবধানেই পরাজয় বরণ করতে হয়।

    ঐ টুর্নামেন্টের ছন্দপতনের আরেকটি কারণ ছিল বৃষ্টি। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের প্রথম ৯ ওভারে পাকিস্তান মাত্র ৩০ রান তুলতেই হারায় ৫ উইকেট। প্রসাদ ৫ ওভার বোলিং করে রীতিমত ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলেন পাকিস্তানের উপর। কিন্তু বেরসিক বৃষ্টি ভারতের উৎসবে আক্ষরিক ভাবেই জল ঢেলে দেয়। রিজার্ভ ডে ছিল, তবুও ঐ ম্যাচটি শেষ হতে পারেনি!

    বৃষ্টি প্রতি ম্যাচেই বাগড়া দিয়েছে ঐ এশিয়া কাপে। বারবার ঘটিয়েছে ছন্দপতন। বেশির ভাগ ম্যাচেই তাই খেলা হয়নি পূর্ণ ওভার।

     

    দুর্ভাগা পাকিস্তান...

    পাকিস্তান দলে পুরো নব্বই দশক জুড়ে তারকারা খেলেছেন। কালের সীমানা ছাড়িয়ে ঐ দলের অনেকেই ঠাঁই পেয়েছেন ইতিহাসের পাতায়; নাম লিখিয়েছেন ‘অলটাইম গ্রেট’দের কাতারে। জিতিয়েছেন বিশ্বকাপ, সিরিজ জিতেছেন দেশে-প্রবাসে, চোখে-চোখ রেখে লড়াই করেছেন কুলীন অস্ট্রেলিয়ান-ইংলিশ-ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান খেলোয়াড়দের বিপক্ষে।

    দ্বিপাক্ষিক সিরিজে যে পাকিস্তান বাঘ, এশিয়া কাপে গিয়েই সেই পাকিস্তান যেন পথহারা, দিকভ্রান্ত পথিক। ছয় আসরের মধ্যে মাত্র একবার ফাইনালিস্ট, শিরোপার স্বাদ নেই। বাকি টুর্নামেন্টগুলোর গ্রুপ ম্যাচেও তেমন নজরকাড়া পারফরম্যান্স নেই। পাকিস্তান অবশ্য এসব ঘটনাকে উপেক্ষা করার জন্য বলতেই পারে - সবই গত শতকের কথা! একবিংশ শতাব্দীর প্রথম এশিয়া কাপের কাপজয়ী দলটা যে পাকিস্তান!

    ২০০০ সাল ক্রিকেটীয় ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্যে আবেগের। ঐ বছর এশিয়া কাপের স্বাগতিকও ছিল বাংলাদেশ। তখন দেশে ক্রিকেটের অন্যরকম জোয়ার; মাত্রই আগের সাক্ষাতে এই ক্রিকেট দল পাকিস্তানকে পরাজিত করেছে- তাও বিশ্বকাপের মঞ্চে। মানুষের আগ্রহ তাই সেবার যতো না পরদেশকে নিয়ে তার চাইতেও বেশি নিজের দলকে নিয়ে। ইতিহাসে প্রথমবারের মত কোন এশিয়া কাপে বাংলাদেশের মানুষ খেলা দেখতে বসল শুধু খেলা দেখার আগ্রহেই নয়; বরং জয়ের রোমাঞ্চ আবার গায়ে মাখার জন্যে।

     

     

    রোমাঞ্চটা দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে অবশ্য দেরি হয়নি। শ্রীলঙ্কার সাথে উদ্বোধনী ম্যাচে বাংলাদেশ প্রথমে ব্যাট করে ১৮০-ও ছাড়াতে পারেনি। অরবিন্দ ডি সিলভার ব্যাটিং তান্ডবে সেই ম্যাচ শ্রীলঙ্কা ৯ উইকেটে জিতে যায়। অবশ্য জাভেদ ওমর ঐ ম্যাচে 'ক্যারি দ্য ব্যাট থ্রু দ্য ইনিংস'-র মাধ্যমে ৮৫ রান করে অপরাজিত থাকেন। কিন্তু বিনিময়ে ১৪৬ বল খেলার জন্যে তাকে কম-বেশি দুয়োও শুনতে হয়।

    ভারতের সাথে পরের ম্যাচে অবশ্য আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশ জয়ের আশা জাগিয়েছিল। প্রথমে ব্যাট করে সুমনের ৫৭, বুলবুলের ৪৭, আকরাম খানের ৫২ বলে ৬৪ রানে ভর করে আর পুরো ৫০ ওভার খেলে ২৪৯ রান - জয়ের আশাটা মোটেও বাড়াবাড়ি কিছু নয়। সৌরভ গাঙ্গুলির অবশ্য ভিন্ন চিন্তা ছিল। বাংলাদেশের জয়ের আশা তাঁর ব্যাটের শৌর্যে হারিয়ে যেতে থাকল ভারতের ইনিংসের প্রথম ওভার থেকেই। তাঁর ১২৪ বলে অপরাজিত ১৩৫ রানের উপর ভর করে ১০ ওভার হাতে রেখেই ম্যাচ জিতে গেল ভারত।

    আর পাকিস্তান রীতিমত গুঁড়িয়ে দিল বাংলাদেশকে। নিল আগের সাক্ষাতে হারের বদলা। মাত্র ৩ উইকেট হারিয়ে ৩২০ রান করার পর বাংলাদেশকে গুটিয়ে দিল ৮৭ রানে!

     

    ২৯ মে থেকে ৭ জুনের ঐ টুর্নামেন্টের সূচীটা ছিল বেশ অদ্ভুত। প্রথম দিকে পাকিস্তানের কোন ম্যাচই ছিল না। আর শেষে মাত্র ৬ দিনের মধ্যে ফাইনালসহ তাঁদের খেলতে হল ৪টি ম্যাচ! তাতে অবশ্য পাকিস্তানের কিছু আসে যায়নি। ইউসুফ ইয়োহানার (এখন মোহাম্মদ ইউসুফ) অমানবিক ব্যাটের উপর ভর দিয়ে পাকিস্তান জিতল প্রথম এশিয়া কাপ। আবদুল রাজ্জাক হলেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি।

     

    ঐ এশিয়া কাপ আরেকটি দিক থেকে 'অন্যরকম' হয়ে থাকবে! তিনটি টেস্ট দলের অংশগ্রহণে এশিয়া কাপ সেবারই শেষবারের মত দেখেছিল দর্শকরা!

     

    একজন বাংলাদেশি হিসেবে এই 'শেষ'-টিই ছিলো আসলে আবেগ আর গৌরবের!

     

    (চলবে)

     


    পরবর্তী পর্বঃ

    এশিয়ার ক্রিকেট "বিদ্রোহ"- শেষ পর্ব