• লা লিগা
  • " />

     

    কোচ জিদান বড় না খেলোয়াড় জিদান?

    কোচ জিদান বড় না খেলোয়াড় জিদান?    

    খেলোয়াড় ও কোচ দুই ভূমিকায় সফল এমন কারও নাম বলতে বললে সবার আগে কার ছবিটা মাথায় আসবে? 

    দুই যুগ আগে হলে দুইজনের নাম এসে পড়ত চট করে। একজন ইয়োহান ক্রুইফ, আয়াক্স আর বার্সেলোনার হয়ে সবকিছু জেতার পর বিশ্বকাপে হয়ে গিয়েছিলেন ট্র্যাজেডির নায়ক। পরে কোচ হিসেবেও সম্ভাব্য সব শিরোপাই পেয়েছেন, ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাববিস্তারী ব্যক্তিত্বও মনে করা হয় তাকে। আরেকজন কাইজার ওরফে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, তাঁর ক্রুইফের মতো সেই অতৃপ্তি নেই। খেলোয়াড় ও কোচ - দুই ভূমিকাতেই বিশ্বকাপ জয় করার কীর্তি তাঁর মতো আর আছে মাত্র দুজনের (মারিও জাগালো ও দিদিয়ের দেশম)।

    তবে আরেকজন এর মধ্যে ক্রুইফ আর বেকেনবাওয়ের সঙ্গে একই বন্ধনীতে উঠে আসছেন। জিনেদিন জিদানকে তার প্রজন্মের তো বটেই, সর্বকালেরই সেরা ফুটবলারদের ছোট্ট তালিকায়ও রাখা হয়। ম্যানেজার বা কোচ হিসেবে তার ক্যারিয়ার এখনও খুব বেশিদিনের নয়, তবে অর্জনের দিক দিয়ে জিদানের সঙ্গে তুলনা করার মতো কোচ কমই আছেন। রিয়াল মাদ্রিদকে নিয়ে যা করেছেন, সেটা ফুটবল ইতিহাসেই আর কারও নেই। তবে নানা কারণে এবারের লা লিগার শিরোপাটা একটু বেশিই আলাদা করে দেখবেন জিদান। প্রশ্নটা হয়তো অনুচ্চারে হলেও উঠে যাচ্ছে, খেলোয়াড় জিদান বড় না কোচ জিদান? 

    আপাতদৃষ্টিতে প্রশ্নটা অর্থহীন মনে হতে পারে। খেলোয়াড়ি অর্জন আর কোচ হিসেবে অর্জন তো পুরোপুরি আলাদা, একটার সঙ্গে অন্যটা সম্পর্কহীন। জিদান খেলোয়াড় হিসেবে যা জিতেছেন, সেটার সঙ্গে কোচ হিসেবে প্রাপ্তির তুলনাও আসলে ফুটবলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ঠিক যুক্তিযুক্ত নয়। বরং প্রশ্নটা ঘুরিয়ে এভাবে করা যায়, কোচ জিদান কি একটু বেশি আন্ডাররেটেড? অথবা আরেকটু সাহস দেখিয়ে এভাবে করে ফেলা যায়, খেলোয়াড় জিদান কি একটু বেশি ওভাররেটেড? 

    আগে কোচ জিদানের কথায় একটু আসা যাক। জিদানের কোচিং নিয়ে সংশয়বাদীর তালিকা কখনোই খুব একটা কম ছিল না। ২০১৬ সালে রিয়ালের দায়িত্ব নেওয়ার ভুরু কুঁচকে ফেলেছিলেন অনেকে। মাথা গরম লোকটা কোচ হিসেবে খেলোয়াড়দের সামলাবে কী করে? রিয়ালেরই সাবেক কোচ ওটমার হিজফেল্ডও বলে ফেলেছিলেন, ‘এই ছেলেকে কোচ করাটা তো জুয়া খেলা। ওর না আছে কোচিংয়ের অভিজ্ঞতা, না আছে লোক সামলানোর দক্ষতা। এখন পর্যন্ত কোনো দলকে তো কোচিংই করায়নি। শুধু খেলোয়াড় হিসেবে সে বিখ্যাত, এই যা! ও তো আসলে লটারি জিতে গেছে।’ লটারি আসলে কে জিতেছে, সেটা এখন সবাই জানে। তবে জিদান কোচ হিসেবে সম্ভাব্য সব সাফল্যের পরও প্রশ্ন উঠেছে অন্য দিক থেকে। 

     

    জিদান দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার পর অনেকে বলেছিলেন, এটা পুরোপুরি ফ্লুক। জিদানের এতে খুব বেশি কৃতিত্ব নেই। পরের মৌসুমে যখন চ্যাম্পিয়নস লিগের সাথে লা লিগাও জিতলেন তখনও মিনমিন করে কেউ বললেন, জিদানের আসলে কোনো নির্দিষ্ট ফুটবল দর্শন নেই। ট্যাকটিক্যালি আসলে জিদান এমন আহামরি কোনো কোচ নন। ‘অবিশ্বাসীদের’ দলে থাকা কেউ কেউ প্রশ্নটা হয়তো এখনও তুলবেন। চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়কে আপনি হয়তো ট্যাকটিক্যাল মাস্টারক্লাসের উদাহরণ নাও মানতে পারেন। এখানে নকআউটে সাতটি ম্যাচেই নির্ধারিত হয়ে যায় সবকিছু, নির্দিষ্ট দিনের খেলার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। কিন্তু লিগ জয়টা পুরোপুরি নির্ভর করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আর ম্যাচ-টু-ম্যাচ ট্যাকটিকসের ওপর। সাফল্যের এই ‘পদ্মা সেতুর’ স্প্যানগুলো দৃশ্যমান হলেই শুধু হবে না, সংযোগ সড়কের মতো লিগ জয়েও করতে হয় বাড়তি অনেক কাজ। সেই কাজটা জিদান এর মধ্যে দুইবার করে ফেলেছেন। তার চেয়েও বড় কথা, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে ছাড়া জিদান জিততে পারেন না যারা বলেছিলেন, তাদের জন্যও এবারের লিগ জয়টা বড় একটা জবাব। ট্যাকটিক্যালি জিদানকে হয়তো গার্দিওলা, মরিনহোদের কাতারে ফেলতে ‘ফুটবল-বিশেষজ্ঞরা’ হয়তো কয়েকবার ভাববেন। কিন্তু এবারের লিগ জয়টা তাদের জন্যও ছিল মোক্ষম একটা জবাব। 

    আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে জিদানের কোচিং-দর্শনটা কী? ক্লপের যেমন গেগেনপ্রেসিং, গার্দিওলার টিকি-টাকা, বা মরিনহোর ‘পার্ক দ্য বাস’, সেটা জিদানের ক্ষেত্রে কী? এই প্রশ্নের সহজ উত্তরটা হচ্ছে ‘প্রাগমাটিজম’ বা ‘বাস্তববাদিতা’। আরেকটু অন্যভাবে বললে ‘ফ্লেক্সিবিলিটিও’ বলা যায়। জিদান জিততে চান, আর সেই জয়ের রাস্তাটা খুঁজে নেন দলের সামর্থ্যের ওপর। দল যা করতে পারে, সেটার ওপর ভর করেই নিজের কৌশল জানান। সেজন্য তার দর্শনকে বাঁধাধরা ছকে ফেলা যাবে না, কিন্তু নিজস্ব একটা ব্র্যান্ড তিনি ঠিকই তৈরি করতে পেরেছেন। 

    একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার বোঝা যাবে। ২০১৭ সালে যেবার জিদান লা লিগা আর চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতলেন, সেবার রোনালদোরা প্রতি ম্যাচেই গোল করছিলেন; সব প্রতিযোগিতা মিলে ৬৪ ম্যাচে টানা গোল করেছিল জিদানশিষ্যরা। সেবার ৪-৩-৩- ফর্মেশন থেকে বদলে ৪-৪-২ ফর্মেশনে সরে এসেছিলেন জিদান, ইসকো তাতে হয়ে উঠেছিলেন আরও দুর্বার। গোল ঠেকানোর চেয়ে গোল করার দিকেই বেশি মনোযোগী ছিল রিয়াল। আর এই মৌসুমে উলটো কাজটাই বেশি করতে হয়েছে জিদানকে। বেনজেমা এবার আক্রমণে অনেকটা নিঃসঙ্গ শেরপা ছিলেন, স্ট্রাইকার হিসেবে তেমন কোনো বিকল্পও ছিল না জিদানের। তবে বেনজেমার সঙ্গে গোল করার দায়িত্বটা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন সবাই। ফলাফল? রিয়াল এবার ২১জন ভিন্ন ভিন্ন গোলদাতা পেয়েছে। বেনজেমার পর লা লিগায় রিয়ালের সবচেয়ে বেশি গোল একজন সেন্ট্রাল ডিফেন্ডারের, সার্জিও রামোস। তার চেয়েও বড় কথা, জিদান এবার বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন রক্ষণের ওপর। এই মৌসুমে মাত্র ২৩ গোল হজম করেছে রিয়াল, ৩৮ ম্যাচের লিগে এটাই এখন পর্যন্ত তাদের সবচেয়ে কম গোল খাওয়ার রেকর্ড। রক্ষণটা আগে দুর্ভেদ্য করেছেন জিদান। কারণ জানেন এটাই তার মূল অস্ত্র। এই ‘প্রাগমাটিজম’ বা ‘ফ্লেক্সিবিলিটিটাই’ আধুনিক ফুটবলের সবচেয়ে বড় দাবি। যেটা জিদান করতে পেরেছেন ভালোভাবেই। 

    আর দুর্দান্ত ম্যান ম্যানেজমেন্ট তো আছেই। খেলোয়াড় হিসেবে যতটা, তার চেয়েও কোচ হিসেবে সম্ভবত আরও বেশি জনপ্রিয় জিজু। এতদিন ধরে মাদ্রিদের বিশ্বসেরা সব তারকাকে সামলাচ্ছেন দারুণভাবে। কখনো বেল, হামেসদের মতো উপেক্ষিতদের সামলাতে হচ্ছে তাকে, আবার কখনো দেখতে হচ্ছে তরুণ রদ্রিগো, ভিনিসিয়াসরা যেন অল্প বয়সেই ভুল পথে চলে না যান। ম্যান ম্যানেজমেন্ট নিয়ে জিদানের নিজস্ব একটা তত্বও আছে, ‘দেখুন, ভালো কোচ হওয়ার জন্য সবসময় যে চেঁচিয়ে যেতে হবে, আমি কিন্তু তা মনে করি না। অবশ্যই কথা বলতে হবে, তবে সেটা বেশি না হলেও হয়। যেটা দরকার, দলের ওপর আপনার কর্তৃত্ব আছে কি না। আমার মনে হয়, কথা কম বলেও শক্ত হওয়া যায়, কঠোর হওয়া যায়।’  ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্রটা সবসময় সবচেয়ে ভালো শিক্ষক হয় না। তবে জিদান এক্ষেত্রে আশ্চর্য ব্যতিক্রম। টনি ক্রুস যেমন বলেছেন, জিদান নিজে ওই পর্যায়ের ফুটবল খেলেছেন বলে কার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়, সেটা তিনি খুব ভালো করে জানেন।  


     

    আধুনিক কোচের মানদন্ডে জিদান তাই বেশ আন্ডাররেটেড। এমনিতে কথাও বলেন কম, সংবাদ সম্মেলনে তার কথার মধ্যে ‘বাইটও’ খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে জিদান কোচিংয়ের কঠিন পথটা এতোটা সহজ করে ফেলেছেন, প্রায় ভাঙাচোরা একটা দল নিয়েও তাই লা লিগার শিরোপা জিতিয়ে আনার কঠিন কাজটাও হয়ে গেছে। বড় ট্রফির মধ্যে একমাত্র বিশ্বকাপটাই কোচ হিসেবে পাওয়া বাকি, ফ্রান্সের হয়ে সেটা হয়ে যাওয়ার বাজিও আপনি লেগে ফেলতে পারেন।

    খেলোয়াড় জিদানের চেয়ে একটা জায়গাতেই কোচ জিদান আসলে এগিয়ে গেছেন। সেটা হচ্ছে ‘ধারাবাহিকতা।’ কোচ জিদান যেমন টানা তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম তিন মৌসুমেই। পাঁচ বছরের মধ্যে জিতে গেছেন দুইটি লা লিগাও। তার চেয়েও বড় কথা, ফর্মেশন ভেঙেচুরে-কখনো আক্রমণ কখনো রক্ষণের ওপর নির্ভর করে সাফল্য আনতে শিখে গেছেন। ডাগআউটের জিদান তাই সমকালীন কোচদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে ধারাবাহিক। কিন্তু খেলোয়াড় জিদান কি এতোটা ধারাবাহিক ছিলেন? 

    এখানে আপনার ভুরু কুঁচকে যেতে পারে। যে লোকের চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে অমন মহাকাব্যিক একটা ভলিতে গোল আছে, বিশ্বকাপ ফাইনালে যার জোড়া গোল আছে, আরেকটা বিশ্বকাপের ফাইনালে যিনি রাঙাতে রাঙাতেও পারেননি শেষে গিয়ে, তার ধারাবাহিকতা নিয়ে কেন প্রশ্ন উঠবে? তবে জিদানের ফুটবল ক্যারিয়ার বলছে, জাতীয় দলে না হলেও ক্লাব ক্যারিয়ারে এই ধারাবাহিকতার অভাবে বেশ ভুগতে হয়েছিল তাকে।

    ব্যাপারটা আরেকটু তলিয়ে দেখা যাক। ১৯৯৬ সালে বোর্দো থেকে যখন জুভেন্টাসে এলেন, তখনই আসলে জিদান ইউরোপিয়ান ফুটবলের সত্যিকারের মঞ্চে পা রেখেছিলেন। ওই সময়ের সিরি আ ছিল বিশ্বের সেরা লিগ, সেটা ট্যাকটিক্যালি এবং টেকনিক্যালিও। জুভেন্টাসে আসার পর পূর্বসুরি মিশেল প্লাতিনির সঙ্গেও জিদানের নিয়মিত তুলনা হতে লাগল। প্লাতিনি ছিলেন জিদানের আগে ফ্রান্সের অবিসংবাদিত সেরা, একজন পারফেক্ট নাম্বার টেন। সেই প্লাতিনিরই ক্লাব জুভেন্টাসে এসে জিদান আবিষ্কার করলেন, এতোদিনের মনের আনন্দে খেলা ফুটবলের চেয়ে জয়ের জন্য ফুটবল খেলা কতটা কঠিন। জুভেন্টাসে এসে তাকে নাম্বার টেনের বদলে নাম্বার সিক্সের ভূমিকাতেই বেশি খেলতে হলো শুরুতে। ডিপ লায়িং প্লেমেকার হিসেবে ঠিক মানিয়ে নিতে পারছিলেন না, পরে অবশ্য কোচ মার্সেলো লিপ্পি দিদিয়ের দেশমকে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের দায়িত্ব দেওয়ায় জিদান আরেকটু স্বাধীনতা পেয়ে যান। তারপরও জিদান প্লাতিনির ছায়া থেকে বেরুতে পারছিলেন না একটা কারণে- গোল করা। প্লাতিনি যেখানে নাম্বার টেনের ভূমিকায় একের পর এক গোল করেছেন, সেখানে ক্লাব ক্যারিয়ারে জিদান সেভাবে গোলই পাননি। জিদান ক্লাব ক্যারিয়ারে ম্যাচপ্রতি গোল ০.১৯টি, প্লাতিনির (০.৫৩) তুলনায় অনেক কম। 

    জুভেন্টাসে প্রথম মৌসুমে সংগ্রাম করার পর দ্বিতীয় মৌসুমটা দারুণ কেটেছিল জিদানের। সেবার সিরি আ জিতেছিলেন, নিজেও ছিলেন লিগের সেরা খেলোয়াড়। এরপরেই ১৯৯৮ সাল থেকে জিদানের ক্লাব ক্যারিয়ারে শুরু হয় ভাটার টান। হঠাৎ করে গোল করা তো বটেই, গোল করানোও ভুলে যান জিদান। এই সময়ে টানা আট মাস গোল করেননি, ১৯৯৯-০০ মৌসুমজুড়ে গোল করিয়েছিলেন মাত্র একটি। অথচ ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে জাতীয় দলের হয়ে দুর্দান্ত একটা সময় কাটিয়েছিলেন জিদান। কিন্তু ক্লাব ফুটবলে সেটার প্রতিফলন সেই সময় ছিল না। জুভেন্টাসে তার জন্য ৪-৩-১-২ ফর্মেশনে দল সাজিয়েছিলেন আনচেলত্তি, কিন্তু জিদান ইতালিতে তার শেষ তিন বছরে কোনো বড় শিরোপা পাননি। অবশ্য এই সময়ে ১৯৯৮ বিশ্বকাপের জন্য সবাই তাকে মনে রাখেন। তবে ফ্রান্সের হয়ে দ্বিতীয় ম্যাচে লাল কার্ড দেখার পর কোয়ার্টার ফাইনালের আগে মাঠেই নামতে পারেননি। কোয়ার্টারে ইতালির বিপক্ষেও সেভাবে কিছু করতে পারেননি, খুব ভালো কিছু করতে পারেননি সেমিতেও। ফাইনালের পারফরম্যান্স কিন্তু সে বছর বিশ্বকাপে তার সার্বিক চিত্র ছিল না। বরং ২০০০ ইউরোতেই দেখা গিয়েছিল সত্যিকারের জিদানকে। ফ্রান্সও সেবার খেলেছিল দারুণ বিনোদনদায়ী ফুটবল। জিদান অবশ্য জাতীয় দলের এই ফর্মের জন্য কৃতিত্ব দিয়েছেন জুভেন্টাসের সময়কে। ইতালিতে এসেই জয় কী জিনিস সেটা জানতে পেরেছিলেন, পরে বলেছেন।

     


     

    তবে ধারাবাহিকতার এই অভাবটা জিদান কিছুটা ভুগেছেন রিয়াল মাদ্রিদে এসেও। এখানে একটা প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া যায়। জুভেন্টাসের মতো রিয়ালেও প্রথম মৌসুম ‘বেশ ভালো’, দ্বিতীয় মৌসুম ‘দুর্দান্ত’ কাটানোর পর তৃতীয় আর চতুর্থ মৌসুমে সেভাবে খুঁজেই পাওয়া যায়নি জিদানকে। রিয়ালের পাঁচ বছরে জিদান লিগ জিতেছিলেন শুধু একবার, আর চ্যাম্পিয়নস লিগও ওই একবারই। রিয়ালের হয়ে ছয় বছর খেলার কথা থাকলেও জিদান চুক্তিটা শেষ করে দিয়েছিলেন এক বছর আগেই, ২০০৬ সালে। আর সেই ২০০৬ বিশ্বকাপেই সম্ভবত তার ফুটবল ক্যারিয়ারের সেরা পারফরম্যান্স দেখিয়েছিলেন। সম্ভবত এই টুর্নামেন্টেই সবচেয়ে বেশি ম্যাচে ধারাবাহিক ছিলেন জিদান, বিশেষ করে স্পেন ও ব্রাজিলের বিপক্ষে শেষ ষোলো ও শেষ আটের দুইটি ম্যাচের পারফরম্যান্স জায়গা করে নিয়েছে ফুটবল পুরাণে। ২০০৬ বিশ্বকাপে জিদানের অতিমানবীয় পারফরম্যান্সই তাকে অনেকটা এগিয়ে রেখেছে সমকালীন ফুটবলারদের চেয়ে। তারপরও ক্লাব ক্যারিয়ারে জিদানের ‘ধারাবাহিকতা’ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বার বার। কিছু ম্যাচে অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সের কারণে জুভেন্টাস আর রিয়াল- এই দুই জায়গাতেই সমর্থকদের চোখের মণি ছিলেন জিজু। তবে দুই ক্লাবের সমর্থকেরাই একটু আফসোস নিয়ে বলেছেন, তারা সম্ভবত সেরা ফর্মের জিদানকে দেখতে পাননি। জুভেন্টাসের ওই সময়ের প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ‘জিদান যতটা আনন্দদায়ী, অতটা কার্যকরী নন’। কথাটা যে ভুল সেটা জিদান ফ্রান্সের হয়েই প্রমাণ করেছিলেন। কিন্তু পূর্বসূরি প্লাতিনি বা আরও কারোর মতো ক্লাব ফুটবলে জিদান সেভাবে সাফল্য এনে দিতে পারেননি। বরং জিদান চলে যাওয়ার পরের দুই মৌসুমে দুইবার সিরি আ জিতেছে জুভেন্টাস, যেরকম জিদান স্পেন ছাড়ার পরের দুই মৌসুমেই লিগ জিতেছিল রিয়াল। অথচ কোচ হিসেবে এর মধ্যেই দুইটি লা লিগা জিতেছেন জিদান, আর চ্যাম্পিয়নস লিগ তো টানা তিন বার হয়ে গেছে। শুধু দেশের হয়ে শিরোপাটাই বাকি আছে কোচ জিদানের। সেটা হলে মাঠের চেয়ে মাঠের বাইরের জিদানকে হয়তো বেশি এগিয়ে রাখবে ফুটবলের ইতিহাস। 

    তারপরও শুধু ফ্রান্সের হয়েই জিদানের যে কীর্তি, তাতে খেলোয়াড় জিদান বড় না কোচ জিদান, এই প্রশ্নের অবিসংবাদিত উত্তর এখনই দেওয়া মুশকিল। তবে একটা ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করে রাখা যায়, কোচ জিদান সম্ভবত খেলোয়াড় জিদানের চেয়েও বেশি পরিণত, আরও বেশি ঠাণ্ডা মাথার। তার সাফল্যই বলছে সে কথা।

     

    তথসূত্রঃ জোনাল মার্কিং, মাইকেল কক্স।