• চ্যাম্পিয়নস লিগ
  • " />

     

    লেভানডফস্কি-মুলার-গ্যানাব্রি নাকি নেইমার-এমবাপ্পে-ডি মারিয়া: লড়াইয়ের ভেতর অন্য লড়াই

    লেভানডফস্কি-মুলার-গ্যানাব্রি নাকি নেইমার-এমবাপ্পে-ডি মারিয়া: লড়াইয়ের ভেতর অন্য লড়াই    

    রাতে ইউরোপ সেরার খেতাব জিততে লড়াইয়ে নামছে বায়ার্ন মিউনিখ-পিএসজি। তর্কসাপেক্ষে এবারের আসরের সবচেয়ে ভালো পারফর্ম করা দুটি দলই ফাইনাল পর্যন্ত উঠে এসেছে। ফাইনালে আসার পথে বাঘা বাঘা সব প্রতিপক্ষদের তুচ্ছ করেছে এই দুটি দল। এবার ফাইনালে একে অন্যকে দেখে নেওয়ার পালা। তবে ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে বড় এই লড়াইয়ের আড়ালে ম্যাচজুড়ে চলবে আরও কিছু লড়াই।

    নেইমার বনাম লেভানডফস্কি

    নেইমারকে পিএসজির এবং রবার্ট লেভানডফস্কিকে বায়ার্নের সেরা তারকা বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। বায়ার্নের পোলিশ গোলমেশিন লেভানডফস্কি তো চলতি মৌসুমে রীতিমত উড়ছেন। ৪৬ ম্যাচ থেকে এখন পর্যন্ত ৫৫ গোল করেছেন। চ্যাম্পিয়নস লিগের এবারের আসরেও এরই মধ্যে ১৫ গোল করেছেন তিনি। ফাইনালে দুই গোল করলে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ১৭ গোলের রেকর্ড ছোঁবেন তিনি। আর হ্যাটট্রিক করতে পারলে তো নতুন করে ইতিহাসই লেখা হয়ে যাবে তার। ফাইনালে বায়ার্নের দুর্দান্ত আক্রমণভাগের নেতৃত্ব থাকবেন।

    আর অন্যপ্রান্তে বায়ার্ন ডিফেন্ডারদের সামাল দিতে হবে নেইমারকে। ২২২ মিলিয়ন ইউরোর বিশ্বরেকর্ড ফি-তে বার্সেলোনা থেকে প্যারিসে এসেছিলেন। মূলত ইউরোপীয় সাফল্যের জন্যই নেইমারকে পিএসজিতে এনেছিল ক্লাবটির কাতারি মালিকপক্ষ। ইউরোপের অভিজাতদের কাতারে উঠতে যে ভারী নামগুলো বেশ কার্যকরী হয়ে উঠতে পারে বড় মঞ্চে। তবে গত মৌসুমে চোটাঘাতে নেইমার চ্যাম্পিয়নস লিগে পিএসজিকে খুব একটা এগিয়ে নিতে পারেননি। এবারও প্রথম চার ম্যাচ নিষেধাজ্ঞায় কাটিয়েছেন। তবে ফেরার পর থেকেই আলো কেড়ে নিয়েছেন। গোল করা, করানো এবং দারুণ ড্রিবলিংয়ে প্রতিপক্ষের আক্রমণভাগে রীতিমত ত্রাস ছড়াচ্ছেন এই ব্রাজিলিয়ান।

    ফাইনালে তাই দুই দলের আক্রমণভাগে পুরোধার মাঝেও দারুণ একটি লড়াইয়ের প্রত্যাশা করতেই পারেন ফুটবলপ্রেমীরা।


    পিএসজির রক্ষণ বনাম বায়ার্নের আক্রমণ

    এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে বায়ার্নের খেলার তিনটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে হলে একটি শব্দই তিনবার উল্লেখ করতে হবে। আক্রমণ, আক্রমণ আর আক্রমণ। সুনামির মতো বায়ার্ন মিউনিখের একেকটি আক্রমণ প্রতিপক্ষের রক্ষণকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়, আত্মবিশ্বাস চূর্ণ করে দেয়। গ্রুপ পর্বে গতবারের ফাইনালিস্ট টটেনহাম আর কোয়ার্টার ফাইনালে বার্সেলোনাকে আক্রমণের পর আক্রমণ করে একেবারে ধসিয়ে দিয়েছে তারা। আক্রমণই আসল রক্ষণ, এই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত বায়ার্ন এবারের আসরে ১০ ম্যাচে এখন ৪২ গোল দিয়েছে তারা। তাদের সামনে রয়েছে শুধু ১৯৯৯-২০০০ মৌসুমে বার্সেলোনার ৪৫ গোলের রেকর্ড। যদিও বার্সা ৪৫ গোল করেছিল ১৬ ম্যাচ খেলে। ফাইনালে পিএসজিকে এক হালি গোল দিতে পারলে সেই রেকর্ডও বায়ার্নের পায়ে লুটিয়ে পড়বে। আর সেটা করা যে বায়ার্নের পক্ষে খুব করেই সম্ভব সেটা নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।


    তবে একহালি গোল দেওয়া সম্ভব হলেও প্রতিপক্ষের নাম পিএসজি হওয়াতে সেটা খুব একটা সহজ হবে না। প্যারিসের দলটির তারকাবহুল আক্রমণভাগ সব আলো কেড়ে নিলেও আড়ালে দলের রক্ষণভাগ চমক দেখিয়েছে এই মৌসুমে। ১০ ম্যাচে মাত্র পাঁচবার পিএসজির জালে ঢুকেছে বল। থিয়াগো সিলভা, প্রেসনেল কিম্পেমবে, হুয়ান বের্নাতরা ইস্পাতদৃঢ় রক্ষণের মাধ্যমে দলকে ফাইনালে নিয়ে এসেছেন। গোলরক্ষক কেইলর নাভাসও আছেন দারুণ ফর্মে। তাই পিএসজির রক্ষণ আর বায়ার্নের আক্রমণের মাঝেও আকর্ষণীয় একটি লড়াই দেখা যাবে।

    এলএমজি বনাম এনএমডি

    লেভানডফস্কি-মুলার-গ্যানাব্রি (এলএমজি) আর নেইমার-এমবাপে-ডি মারিয়া (এনএমডি)। বায়ার্ন এবং পিএসজি, দুই দলের আক্রমণ ত্রয়ী-ই আছেন দুর্দান্ত ফর্মে। বায়ার্নের ৪২ গোলের ২৮ টিই এসেছে এই তিনজনের পা থেকে। গোল করা, গোল বানানো, মুভমেন্টের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের রক্ষণকে ধোঁকা দিয়ে অন্যকে জায়গা করে দেওয়া, এসব কাজ পটুতার সঙ্গে করার মাধ্যমেই দলকে ফাইনালে নিয়ে এসেছেন তারা। পিএজসির বিপক্ষে ফাইনালে এই ত্রয়ীর তালমিল অব্যাহত থাকলে পিএসজিকে ভুগতে হতে পারে।


    বায়ার্নের তুলনায় পিএসজির আক্রমণত্রয়ী এবারের আসরে একসঙ্গে খেলার সুযোগ পেয়েছেন কম। প্রথম চার ম্যাচে নিষিদ্ধ ছিলেন নেইমার। এমবাপে, ডি মারিয়ারাও চোটের জন্য দলের বাইরে ছিলেন। তবে সেমিফাইনালে লাইপজিগের বিপক্ষেই এই ত্রয়ী দেখিয়ে দিয়েছে, একসঙ্গে জ্বলে উঠলে মুহূর্তেই প্রতিপক্ষের জন্য সর্বনাশা হয়ে উঠতে পারে তারা।

    গোল আর গোল

    দুই দলের আক্রমণভাগের বৃত্তান্ত এরই মধ্যে জানা হয়ে গেছে আপনার। এমন দুর্ধর্ষ আক্রমণভাগ নিয়ে দল দুটি যখন মাঠে নামে, তখন গোলের পসরা আপনিতেই যেন সেজে ওঠে। বায়ার্ন মিউনিখ চ্যাম্পিয়নস লিগে তো এখন পর্যন্ত আসর সর্বোচ্চ ৪২ গোল করেছেই, বুন্দেসলিগাতেও ১০০ গোলের মাইলফলক ছুঁয়েছে ক্লাবটি। সবমিলিয়ে ২০১৯-২০ মৌসুমে ১৫৮ গোল করেছে ক্লাবটি। 

    পিএসজিও খুব বেশি পিছিয়ে নেই। ফ্রেঞ্চ লিগে ২০১৯-২০ মৌসুমে ১১ ম্যাচ কম খেলেও ৭৫ গোল করেছিল দলটি। সব ম্যাচ খেলতে পারলে হয়ত বায়ার্নকেও ছাড়িয়ে যেতে পারত তারা। চ্যাম্পিয়নস লিগেও এবার গ্রুপ পর্বে গ্যালাতাসারে এবং ক্লাব ব্রুজের বিপক্ষে পাঁচবার করে বল জালে পাঠিয়েছে তারা। তাই বায়ার্ন এবং পিএসজির বিপক্ষে গোলবন্যা হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

    দুই জার্মান কোচের লড়াই

    বায়ার্ন মিউনিখ এবং পিএসজি দুই দলের কোচের দায়িত্বেই রয়েছেন দুই জার্মান হানসি ফ্লিক এবং থমাস তুখল। পিএসজির হয়ে এবার যেন অনেকটা ‘অসাধ্য’ সাধন করে দেখিয়েছেন তুখল। ক্লাবটির ৫০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দলটিকে ফাইনালে নিয়ে এসেছেন তিনি। শেষ ষোল এবং কোয়ার্টার ফাইনালে বছরের পর পিএসজি পা হড়কালেও তুখলের অধীনে সেই ‘অপয়া’ পর্বগুলো এবার স্বচ্ছন্দে পাড়ি দিয়েছে। উড়তে থাকা ডর্টমুন্ডকে মাটিতে নামিয়েছে, ইতিহাস গড়ার পথে থাকা আটালান্টার পথ রোধ করেছে তার দল। এবার সামনে শুধু বায়ার্ন বাধা।

    তবে সেই বাধা টপকানো সহজ নয় মোটেও। বায়ার্নের দায়িত্বেও যে রয়েছেন তারই স্বদেশী ‘মাস্টারমাইন্ড’ হানসি ফ্লিক। ২০১৪ বিশ্বকাপে জার্মান দলে জোয়াকিম লোয়ের সহকারী ছিলেন তিনি। আর গত বছরের জুলাইতে বায়ার্নে নিকো কোভাচের সহকারী হিসেবে বাভারিয়ানদের ডাগআউটে আসেন ফ্লিক। নভেম্বরে কোভাচ চাকরি হারানোর পর তার জায়গায় ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব নেন এই জার্মান। কোভাচের অধীনে লিগে ১০ ম্যাচ পর চারে নেমে গিয়েছিল বায়ার্ন। সেখান থেকে বায়ার্নকে শীর্ষে তুলে আনেন তিনি, চ্যাম্পিয়নস লিগেও বায়ার্নকে অপরাজেয় হিসেবে গড়ে তোলেন তিনি।

    ফাইনালে তুখল অথবা ফ্লিকের যেই শেষ হাসি হাসুন না কেন, টানা দ্বিতীয়বারের মতো জার্মান কোচরাই চ্যাম্পিয়নস লিগের ট্রফি উঁচিয়ে ধরবেন। গত মৌসুমে লিভারপুলের হয়ে শিরোপা জিতেছিলেন আরেক জার্মান কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ।