• লা লিগা
  • " />

     

    নতুন বিপ্লবের খোঁজে জিদান আর রিয়াল

    নতুন বিপ্লবের খোঁজে জিদান আর রিয়াল    

    জিনেদিন জিদান দলকে একটা মেশিনে রূপান্তর করেছিলেন। যে মেশিন শুধু জিততে জানে। যে কোনো মূল্যে জিততে পারে। মার্চে লা লিগার দুই নম্বরে থেকেও তাই জুন-জুলাইয়ের টানা দশ জয় জিদানকে পাইয়ে দিয়েছিল বহু আকাঙ্ক্ষিত লা লিগা শিরোপা। এরপর অবশ্য গেল মৌসুমের শেষটা রিয়াল মাদ্রিদের হয়েছিল হার দিয়ে। ম্যান সিটির কাছে হেরে চ্যাম্পিয়নস লিগের দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বিদায় নিয়েছিল জিদানের দল। ফেব্রুয়ারিতে প্রথম লেগে ঘরের মাঠে হারের পর, দ্বিতীয় লেগে সার্জিও রামোসবিহীন রিয়াল মাদ্রিদের জয়টা আদতে কঠিনই ছিল। শেষটা মন্দ হলেও, গেলবার তাই জিদানের রিয়াল ছিল দুর্দান্তই।

    তবে নতুন মৌসুমের সমস্যা হলো, আগের সব পাপ-পুণ্যের হিসাব এখানে ধোপে টেকে না। রিয়াল মাদ্রিদও সেটা ভালো করেই জানে। এক যুগে রিয়াল মাদ্রিদ লা লিগা জিতেছে তিনবার। একবারও লিগ শিরোপা ধরে রাখতে পারেনি তারা। রিয়ালের কোনো কোচের টানা দুইবার লা লিগা জয়ের সবশেষ রেকর্ডটির বয়সও প্রায় তিরিশ বছর পুরোনো। জিদানও জানেন, কাজটা তার জন্য কঠিন। বার্সেলোনার অবস্থা যতই টালমাটাল হোক, শিরোপা ধরে রাখার পথে তারাই বাধা রিয়ালের। শত্রুদের হালকাচালে দেখার উপায় নেই, আয়েশ করারও খায়েস নেই। জিদানের রিয়ালের এই অভিজ্ঞতা আছে, পরিণতিও জানা আছে।


    ২০১৬-২০১৮ পর্যন্ত টানা তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা রিয়াল মাদ্রিদ এই সময়ে লা লিগা জিততে পেরেছিল মাত্র একবার। ইউরোপ সেরা অথচ, স্পেনেই সেরা নয়। সাংঘর্ষিক তাত্ত্বিকতার সমাধান না মিললে তা কখনও কখনও মেনেও নিতে হয়। লিগ আর নকআউট- দুই টুর্নামেন্টের ফারাক অনেকটা টেস্ট ক্রিকেট আর টি-টোয়েন্টির মতো। জিদানের কাছে তাই টানা তিন চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের চেয়েও গতবারের লিগ জয়ে তৃপ্তি ছিল বেশি। জিদান নিজেই  তা বলেছেন।

    টানা তিন চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের মাঝের মৌসুমটায় লা লিগাও জিতেছিল রিয়াল। সেটি ছিল রিয়াল মাদ্রিদের ম্যানেজার হিসেবে জিদানের প্রথম পূর্ণাঙ্গ মৌসুমও। ডাবল জিতে পরের মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদ শুরু করেছিল অনন্য উচ্চতা থেকে। নেইমারকে হারিয়ে সেবারও ধুঁকছিল বার্সেলোনা। কিন্তু সেবার আর লিগে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি জিদানের রিয়াল। যদিও আরও একবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে ইতিহাস গড়েছিল লস ব্লাঙ্কোরা। তবে ২০১৮ এর মে-তে জিদান ক্লাব ছাড়ার আগে লিগ জিততে না পারার আক্ষেপের কথাও জানিয়েছিলেন। রিয়াল মাদ্রিদের কাছে চ্যাম্পিয়নস লিগের আকর্ষণ হয়ত আলাদা, কিন্তু জিদানের জন্য লা লিগার আবেদনে কখনও কখনও আড়াল হয়ে যায় সে দর্শন।

    তিন বছর পর জিদানের কাছে এখনের পরিস্থিতি ২০১৭ সালের মতো মনে হতে পারে। ঢিল না দিয়ে জয়ের মেশিন  চালু রাখাই তাই জিদানের মূল কাজ এবার। এবার তার ভান্ডারে নতুন গোলাবারুদ তেমন যোগ হয়নি। হামেস রদ্রিগেজ, গ্যারেথ বেলদের বিদায় করে ভারমুক্ত হয়েছেন। আরও বেশ কিছু খেলোয়াড়ও এবার রিয়াল ছেড়েছেন। তাতে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের দিনে স্বস্তি মিলেছে রিয়ালের। কিন্তু দলবদলে একেবারেই চুপচাপ এবার রিয়াল। একরকম ঘোষণা দিয়েই রিয়াল মাদ্রিদ এবার নতুন খেলোয়াড় দলে না ভেড়ানোর পণ করেছে। সে সিদ্ধান্ত যাতে অকালে বাদলা হয়ে রিয়ালের আকাশে সংশয়ের মেঘ সৃষ্টি না করে সেটা এখন জিদানের কাছে একমাত্র  চাওয়া প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের।

    পেরেজকে শান্ত রাখতে জিদানের দরকার আরেকটি বিপ্লব। এই বিপ্লবে ‘মেশিন’ দিয়ে কাজ হবে না। এতে দরকার ধৈর্য্য, সময় আর বিশ্বাস। ২১ বছরের মার্টিন ওডেগার্ড আর তার চেয়ে এক বছর বড় বোর্হা মায়োরালকে ক্লাবে ফিরিয়েছেন জিদান। রিয়াল সোসিয়েদাদের হয়ে ধারের মেয়াদ ফুরোনের আগেই ডাক পড়েছে ওডেগার্ডের। জিদান তাকে চেনেন কাস্তিয়ার সময় থেকে। লা লিগার প্রথম ম্যাচের স্কোয়াডেও জিদান রেখেছেন তাকে। ওডেগার্ডকে জিদান দেখছেন ভবিষ্যৎ হিসেবে। এই কুঁড়িদের ফুটিয়ে তোলাই এবার জিদানের কাজ। ৩৫ বছর বয়সি লুকা মদ্রিচ, ৩১ বছর বয়সি টনি ক্রুসরা পুরো মৌসুম এক তালে জিদানকে সাফল্য এনে দেবেন সে আশা না করাই ভালো এবার। এই দলে নতুন রক্তের সঞ্চার দরকার। প্রতি মৌসুমে নিজেদের ছাড়িয়ে যেতে না পারলে শিরোপা মেলে না- ইউরোপিয়ান ফুটবলে বেদবাক্যের মতো মানতে হয় এই তত্ত্ব। লিভারপুল তাই ইতিহাসগড়া মৌসুম শেষেও দলে এনেছে থিয়াগো আলকান্তারাকে। রিয়াল মাদ্রিদের অবস্থা এবার ভিন্ন। যা আছে তাই দিয়েই কাজ চালাতে হবে জিদানকে।

    নতুনদের বিপ্লবের সময়টাও এসে গেছে রিয়ালে। বার্সেলোনার কাছ থেকে রিয়াল মাদ্রিদ শিক্ষা নিয়ে থাকলে এই বিপ্লবে দেরি করবেন না জিদান। শেষ যুগে ফুটবল শাসন করা বার্সেলোনা বা স্পেন- পুরোটাই ছিল প্রায় একই ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে। মাঝমাঠে জাভি, ইনিয়েস্তা, বুসকেটসকে সাফল্যের পেছনের নায়ক বললে ভুল হয় না। মদ্রিচ তো অবধারিতভাবেই শেষদিকে এসে ঠেকেছেন। গতবার অবশ্য মৌসুমের শুরুতেই জিদান নতুন আবহ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। ফেদেরিকো ভালভার্দে তখন ছিলেন দারুণ সংযোজন। কিন্তু মার্চের লকডাউনের পর লা লিগা হয়ে গেল নতুন ধরনের ‘নক আউট’ টুর্নামেন্ট। জিদান জানতেন, এক ম্যাচ হারা মানেই গর্তে পড়ে যাওয়া। ঝুঁকি নেওয়ার সুযোগ নেই, জিদানও নেননি। ফর্মেশন নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করলেও মিডফিল্ডটা রেখেছিলেন অটুট। মদ্রিচ তার অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলে দিয়েছিলেন শেষ দশ ম্যাচ। ওই দশ ম্যাচে মদ্রিচ মাহাত্ম্যের গুণে তাকে সেরা খেলোয়াড়েরের পুরস্কার দেওয়ার দাবিও তুলেছিলেন অনেকে।


    এবার সমীকরণ আলাদা। সপ্তাহের মাঝে চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলতে হবে, কোপা ডেল রে ম্যাচ থাকবে, অংশ নিতে হবে স্প্যানিশ সুপার কাপেও। পৃথিবিতে আরেক দফা দুর্যোগ নেমে না এলে ‘নক আউট’ ফরম্যাটে পাওয়ার আর সম্ভবনা নেই লিগে। ভালভার্দের কাধে জিদান তাই অনুমিতভাবেই এবার বাড়তি দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবেন। ওডেগার্ড আরও বেশি আক্রমণাত্মক ধাঁচের ফুটবলার। গেল মৌসুমে লিগে রিয়ালের ২২ জন খেলোয়াড় গোল করছিলেন। বদলিদের কারিশমাও দরকার হবে জিদানের। ওডেগার্ডকে প্রস্তুত করারও দায়িত্ব এবার জিদানের কাছে।

    নতুনদের দলে ভেড়ানোর কাজটা জিদান অবশ্য অনেকদিন ধরেই করছেন। ভিনিসিয়াস আর রদ্রিগো জিদানের অন্যতম প্রধান অস্ত্র। এই তরুণদের রিয়ালকে দেওয়ার আছে অনেক কিছুই। মার্কো আসেনসিও সময়ে সময়ে জ্বলে ওঠেন ঠিকই, কিন্তু সেভাবে এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠতে পারেননি। ক্যারিয়ারের প্রায় একটি বছর তার হারিয়ে গেছে চোটে। তাও চোট থেকে ফিরে গতবার ফিরে রিয়ালের দশ জয়ে তারও অবদান ছিল। ছোট ছোট এই গল্পগুলো বছরজুড়ে চলা লিগের ভাগ্য গড়ে দেউ প্রায়ই। সেই গল্পগুলোই নতুন করে একসুরে আবার বাঁধতে হবে।

    আবার অন্যদিকে অনেক প্রশ্নও আছে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর, বেলও ছাড়লেন ক্লাব, থাকলেন শুধু বেনজেমা। গতবার রিয়ালের লিগ জয়ের মূল নায়ক সম্ভবত তিনিই। সব প্রতিযোগিতায় ৪৪ ম্যাচে ২৭ গোল করেছিলেন বেনজেমা। এবার মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই ৩৩- এ পুরোবেন তিনি। একই ধারাবাহিকতায় রিয়ালের গোলের ধারা টানতে পারবেন তিনি? এডেন হ্যাজার্ড রিয়ালের প্রথম মৌসুমে একেবারেই সুবিধা করতে পারেননি। আপনি ধরেই নিতে পারেন এ বছর তার শেষ সুযোগ। রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবে নিজেকে প্রমাণের সুযোগ খুব বেশিদিন মেলে না। হ্যাজার্ডের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু রিয়ালের আদলে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করে যেতে হবে। চোটসহ আরও নানান কারণে চেলসির সেই চেনা হ্যাজার্ডকে গতবার খুঁজে পাওয়া যায়নি। এবার অবধারিতভাবেই ছন্দ খুঁজে পেতে হবে বেলজিয়ানের। এবারও তাকে নিয়ে সংশয় আছে। রিয়ালের অনুশীলনে হ্যাজার্ড যোগ দিয়েছেন ৫ কেজি ওজন বাড়িয়ে। ফুল ফিট হ্যাজার্ডকে পেতে জিদানের অপেক্ষা তাই বাড়ছে আরও। কিন্ত এই ধৈর্য্য জিদানের থাকবে কয়দিন? একই কথা প্রযোজ্য লুকা ইয়োভিচের জন্যও। তার ওপর সম্ভবত ধৈর্য্য হারিয়েও ফেলেছেন জিদান। সে কারণেই হয়ত ইয়োভিচের আগে মায়োরালের ওপরই ভরসা রাখবেন তিনি।


    রক্ষণে রিয়ালের তেমন সমস্যা নেই সত্যি। তবে সার্জিও রামোস তো আর তরুণ হচ্ছেন না। ৩৫ এ পড়তে যাচ্ছেন তিনি। ম্যাচ শেষে রিয়াল অধিনায়কের শরীর যদি রিকভারিতে আরেকটু সময় বেশি নেয়, তাতে অনুযোগের কিছু নেই। কিন্তু কথা হলো, রামোস না থাকলে কী করবে রিয়াল? ২৫ বছর বয়সী লেফটব্যাক ফার্লন্ড মেন্ডি তো গতবারই জিদানকে ভরসা দিয়েছেন। সেন্টারব্যাক এডার মিলিতাও সুশৃঙ্খল। আনাড়ি ভুল-ভ্রান্তি তিনি করেন না। সেদিক থেকে ভরসা মিলতে পারে মিলতাওতে। তবে রামোসের অনুপস্থিতিতে দলের রক্ষণে একজন নেতার অভাব রিয়ালকে ভুগিয়েছে গেলবার। ম্যান সিটির বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচেও তার প্রমাণ মিলেছে, রাফায়েল ভারান খেই হারাতে পারেন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে। রক্ষণে রামোসের অবর্তমানে সেই নেতৃত্বহীন রিয়ালকে দিশা খুঁজে পাইয়ে দিতে হবে জিদানকে।

    জিদানের জন্য এসব কাজ হয়ত সহজ নয়। যে জন্য কোচের কোনো জন্যেই কথাটা সত্য। তবে জিদান কোচ হিসেবে সময়ের পরিক্রমায় নিজেও যেভাবে রুপান্তরের ভেতর দিয়ে গেছেন, তা প্রমাণ করছে তিনি এই কাজের জন্য যোগ্য লোক। প্রথম দফার আড়াই বছরে জিদান ম্যান ম্যানেজার হিসেবে নাম কামিয়েছেন। ট্যাকটিক্যাল দূরদর্শীতা প্রমাণ করেছেন গত মৌসুমে। ৪-৩-৩, ৪-৪-২, ৪-১-৪-১, ৪-২-৩-১ সবকিছু ঝালিয়ে দেখেছেন জিদান, তাতে ফলও মিলেছে তার দলের। এবার জিদানের প্রয়োজন তার এই দক্ষতার দারুণ এক সমন্বয়। যেটা রিয়াল আর জিদানের যাত্রাকে করতে পারে আরও টেকসই।