ক্লাসিকোর জৌলুস ফিরিয়ে ন্যু ক্যাম্প থেকে জয় নিয়ে ফিরল রিয়াল মাদ্রিদ
ফুলটাইম
বার্সেলোনা ১-৩ রিয়াল মাদ্রিদ
এল ক্লাসিকোর পুরোনো জৌলুস ফিরে পেতে এমন কিছুই দরকার ছিল বোধ হয়। শুরুর দশ মিনিটের ভেতর দুই গোলই ছন্দ তুলে দিয়েছিল ম্যাচে। তাতে দুই দলকে আলাদা করার উপায় ছিল না। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে বার্সেলোনা থাকল এগিয়ে। কিন্তু গড়বড় হয়ে গেল ক্লেমো লংলের সার্জিও রামোসকে করা এক ফাউলে। রেফারি প্রথমে অবশ্য আমলে নেননি। ভিএআর তখন দেখাল তার খেলা। ওই মুহুর্তই বদলে দিল সবকিছু, রিয়াল মাদ্রিদ পেল পেনাল্টি। সেই রামোসই নিলেন স্পট কিক, গোল করে এগিয়ে নিলেন দলকে। বার্সাও হারিয়ে গেল সেখানেই। শেষে লুকা মদ্রিচ বার্সার গ্লানি বাড়িয়েছেন আরেকটু, আর ন্যু ক্যাম্পের ক্লাসিকোটা হেসে খেলে জিতে গেছে রিয়াল মাদ্রদি। তবে তার আগে ক্লাসিকোর তর্ক-বিতর্ক উস্কে দিয়ে গেছে ভিএআর। তাতে বার্সা হতাশ হয়েছে, জিনেদিন জিদান পেয়েছেন কোচ হিসেবে ন্যু ক্যাম্পের প্রথম জয়, আর ক্লাসিকো ফিরে পেয়েছে চিরচেনা রূপ।
ক্লাসিকোর পরিচিত চেহারায় লিওনেল মেসিও থাকেন। কিন্তু ন্যু ক্যাম্পে পুরোনো মেসির বদলে দেখা গেল সাম্প্রতিক সময়ে পরিচিত হয়ে ওঠা মেসির সেই বিবর্ণ চেহারাটাই। ফাঁকা ন্যু ক্যাম্পের আকাশে একরাশ হতাশায় আরও একবার আড়াল হতে চেয়েছেন মেসি। রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে গোল না করার রেকর্ডটা ৯০০ দিনেরও বেশি পেরিয়ে গেল এবার। ম্যাচ শেষে সব আলো কেড়ে নিলেন রামোসই। নিজের ৪৫ তম ক্লাসিকোতে রিয়ালের ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিকই জয়ের নায়ক।
যে ঘটনা নিয়ে এতো বিতর্ক তার শুরু ম্যাচের ঘন্টাখানেকের দিকে। ফ্রি-কিক থেকে বক্সের ভেতর রামোসের জার্সি টেনে ধরেছিলেন লংলে। রামোস অবশ্য প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন ফ্রি-কিকটা মাথার ওপর দিয়ে চলে যাওয়ার পরেই। লংলের টানে হয়ত রামোস পড়ে যাননি, তবে জার্সি টেনে ধরা তো অপরাধই। ভিএআরের পরামর্শে পরে রেফারি মার্টিনেজ মুনেরা গেছেন মাঠের বাইরে রিপ্লে দেখতে। এরপরই পেনাল্টির বাঁশি বাজিয়েছেন রেফারি। রামোস পরে ৬৩ মিনিটে ডানদিকে নিচু শট নিয়ে গোল করেছেন ওই পেনাল্টি থেকে। বার্সা সমর্থকেরা অবশ্য দাবি করবেন, এমন ঘটনা অহরহই তো ঘটে, ভিএআর দেখেও না দেখার ভান করে তখন! সেই দাবিতে অবশ্য কিছুই যাবে আসবে না রিয়ালের। আদতে বোকামিটা করেছেন ল্যাংলেটই। ২০০৭-০৮ মৌসুমের পর প্রথমারের মতো টানা দুই ক্লাসিকো জয়ের আনন্দ তো আছেই, সঙ্গে টানা দুই ম্যাচ হারের পর এমন একটা জয় স্বস্তিও ফিরিয়ে দিয়েছে হুট করে চাপে পড়ে যাওয়া জিদানকে।
জিদানের জন্য যেটা স্বস্তি রোনাল্ড কোমানের জন্য সেটা তিক্ততা। কোচ হিসেবে নিজের প্রথম ক্লাসিকোতে একাদশে তিনজন টিনএজার নামিয়ে দিয়েছিলেন কোমান। তাতে কাজ হয়নি এমনটিও দাবি করা যাবে না। ওই তিনজনের ভেতর সবচেয়ে বিখ্যাত নামটাই বার্সাকে শুরুর দিকে বিপদমুক্ত করেছিলেন। এরও আগে বিপদ ডেকে এনেছিল বার্সা নিজেদের দোষেই। ডান দিক থেকে বল পেয়ে করিম বেনজেমা মোটামুটি কোনোরকম বাধা-বিপত্তি ছাড়াই বক্সের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। সামনে ছিলেন ফেদেরিকো ভালভার্দে। সার্জিও বুসকেটস কিছুদূর ভালভার্দেকে তাড়া করে এরপর ছেড়েই দিলেন। কিন্তু উরুগুইয়ান আর থামেননি। বেনজেমাও তাকে খুঁজে নিলেন দারুণ এক পাসে। এরপর কোণাকুণি শটে গোল করে ৫ মিনিটেরই রিয়ালকে লিড এনে দেন ভালভার্দে।
বার্সা জবাব দিয়েছিল মিনিটে তিনেক বাদেই। মিডফিল্ড থেকে মেসির উড়িয়ে মারা বল ধরে বাম প্রান্তে বক্সের ভেতর ঢুকে পড়েছিলেন একাদশে ফেরা জর্দি আলবা। বার্সার এই আক্রমণটাও চিরচেনা। বাইলাইনের কাছ গিয়ে আলবা কাটব্যাক করেছেন ফাতির উদ্দ্যেশে। কাছের পোস্ট থেকে পা কাত করে নাম্বার নাইনের মতোই বাকি কাজটা সেরেছেন ফাতি। ম্যাচের ৮ মিনিট, স্কোরলাইন তখন ১-১।
প্রথমার্ধের বাকি সময়ে দুই দলই সমান সুযোগ পেয়েছিল। প্রথমার্ধে এক মিনিটের ব্যবধানে দুইদলের দুই আক্রমণ দারুণ কিছুর ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিল তখনই। ক্লাসিকোর গোলখরা তখন কাটাতেও পারতেন মেসি। ২৪ মিনিটে দারুণ এক টার্ন নিয়ে রামোসকে বোকা বানিয়ে ডান পায়ে কাছের পোস্টে শট করেছিলেন আর্জেন্টাইন। তবে থিবো কোর্তোয়া ছিলেন সতর্ক, তাকে আর বোকা বানাতে পারেননি মেসি। শেষ পর্যন্ত এল ক্লাসিকোতে টানা ৬ ম্যাচ গোলশুন্য থেকে পার করতে হয়েছে বার্সা অধিনায়ককে। ক্লাসিকোতে একটানা এর চেয়ে বেশি ম্যাচ গোল না করে থাকেননি মেসি। পরের মিনিটে অন্যপ্রান্তে বার্সাকে বাঁচিয়েছেন নেতো। বেনজেমাকে ওয়ান অন ওয়ানে ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
বার্সার বেশিরভাগ আক্রমণই চলছিল রিয়ালের রাইটব্যাক আর রাইট সেন্টারব্যাকের মাঝের জায়গা দিয়ে। আলবা ফেরায় রিয়ালের রক্ষণের পুরোনো সমস্যা প্রকট হচ্ছিল আরও। মেসিও প্রথমার্ধে দারুণ ছন্দে ছিলেন, নাচো ফার্নান্দেজ ফিলিপ কৌতিনহোকে আটকাতে রীতিমত ধুঁকছিলেন। একবার হলুদ কার্ডও দেখেছিলেন তিনি। জিদান আর ঝুঁকি নেননি, বিরতির আগেই নাচোকে সরিয়ে লুকাস ভাসকেজকে নামিয়ে দেন রিয়াল কোচ।
ওই পরিবর্তন অবশ্য দ্বিতীয়ার্ধে খুব একটা কাজে দিচ্ছিল না রিয়ালের। বার্সাই বরং বারবার ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে হানা দিচ্ছিল রিয়ালের রক্ষণে। বিরতির পর প্রথম ১৫ মিনিট সার্জিনিয়ো ডেস্ট, পেদ্রিদের মতো তরুণরাও ক্লাসিকো উপভোগ করছিলেন। ৫২ মিনিটে সেই ফাতিই বার্সাকে এগিয়ে দিতে পারতেন। মেসির পাস থেকে বক্সের ভেতর তিনি যে শট নিয়েছিলেন, সেটা তখন অল্পের জন্য গেছে দূরের পোস্টের বাইরে দিয়ে। পরের মিনিটে কৌতিনহো হাতছাড়া করেছেন সুবর্ণ সুযোগ। ফাতির ক্রস থেকে দূরের পোস্টে ফাঁকায় থেকেই কৌতিনহো বলে হেড করেছেন বাইরে দিয়ে। শেষ পর্যন্ত এই মুহুর্তগুলো বার্সার আফসোস আরও বাড়িয়েছে।
কোমানের দলের দুর্বলতা টের পাওয়া গেছে রামোসের গোলের পরই। ম্যাচে তখনও প্রায় আধ ঘন্টা মতো সময় বাকি ছিল। কিন্তু রিয়াল এরপর ধীরস্থির হয়ে রক্ষণে মনোযোগী হয়েছে। আর বার্সা পথ হারিয়েছে। ৮২ মিনিটের পর ঝুঁকিটা কোমান নিয়েই নিয়েছিলেন। আন্টোয়ান গ্রিযমান, ত্রিনকাও, উসমান দেম্বলে, মার্টিন ব্রাথওয়েট কাউকে নামাতে বাদ রাখেননি কোমান। শেষে নির্ধারিত সময়ের মিনিট খানেক আগেই জুয়ায় হার মেনেছেন তিনি। বল নিয়ে তেড়ে আসা ভিনিসিয়াসের দিকে নেতো সেভ করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন, বল তার থেকে ছিনিয়ে নিলেও নিজে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি। বদলি লুকা মদ্রিচ পেয়ে গিয়েছিল বক। বক্সের ভেতর নেতো, জেরার্ড পিকেসহ সবাইকে নাচিয়ে এরপর ফাঁকা জালে গোল করে বার্সার ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করেছেন মদ্রিচ।
বার্সেলোনা
নেতো, ডেস্ট, পিকে, ল্যাংলেট, আলবা, বুসকেটস, ডি ইয়ং, কৌতিনহো, ফাতি, পেদ্রি, মেসি
রিয়াল মাদ্রিদ
কোর্তোয়া, নাচো, ভারান, রামোস, মেন্ডি, কাসেমিরো, ক্রুস, ভালভার্দে, আসেনিসও, বেনজেমা, ভিনিসিয়াস