• ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাংলাদেশ সফর ২০২১
  • " />

     

    অপেক্ষা পেরিয়ে আত্মবিশ্বাস জোগানোর ইনিংস মিরাজের

    অপেক্ষা পেরিয়ে আত্মবিশ্বাস জোগানোর ইনিংস মিরাজের    

    ‘কিসিং দ্য গ্রাউন্ড’ আর ‘সিজদাহ’-- ক্রিকেটে দুটিই উদযাপনের অংশ হলেও এর পেছনের অন্তত সাংস্কৃতিক ব্যাপারটা আলাদা। মুসলিম ক্রিকেটারদের ‘সিজদাহ’-কে অনেক কমেন্টেটরই তাই শুরুর দিকে ‘কিসিং দ্য গ্রাউন্ড’ বলতেন, এখনও বলেন। ২০১৮ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে এমন জোড়া সিজদাহ যে কোনো কমেন্টেটরকেই ধন্দে ফেলে দিতে পারে। সেঞ্চুরির পর মাহমুদউল্লাহ সিজদাহ করলেন, তার সঙ্গে একটু পর যোগ দিলেন ৩৪ বলে ২৭ রান করা মেহেদি হাসান মিরাজও। 

    মিরাজ পরে ব্যাখ্যা করেছিলেন তার সিজদাহ দেওয়ার কারণটা, “আসলে এই টেস্টের আগে আমাদের ব্যাটসম্যানরা রান পাচ্ছিল না তেমন। প্রথম ইনিংসের পর এ ইনিংসেও পেয়েছে, প্রথম ইনিংসে আমিও ফিফটি করেছি। ওই সময় রিয়াদ ভাইকে দেখে আসলে সব অনুভূতি সামনে চলে এসেছে, নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।” 

    সেই ২৭ রানের অপরাজিত ইনিংসের পর মিরাজের টেস্টে সর্বোচ্চ ছিল ৩৮, সেটিও ইনিংসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্কোর দলের। এ সময়ে তিনি নিজে ব্যাটিংয়ে সিজদাহ দেওয়ার সুযোগ পাননি, অন্য কারও সঙ্গেও এভাবে সামিল হননি। 

    **** 

    গত বছর অ-১৯ বিশ্বকাপে আকবর আলিদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগে বাংলাদেশ এ টুর্নামেন্টে শিরোপার সবচেয়ে কাছে গিয়েছিল দেশের মাটিতে ২০১৬ সালে। সেবার টুর্নামেন্টের সেরা ক্রিকেটার হয়েছিলেন মিরাজ, ১২ উইকেট নিয়েছিলেন ১৭.৬৬ গড়ে, ব্যাটিংয়ে করেছিলেন ৬০.৫০ গড়ে ২৪২ রান। মিরাজ তখনও ‘অলরাউন্ডার’ই ছিলেন। 

    সে বছরই সিনিয়র লেভেলে অভিষেক তার, ইংল্যান্ডের সঙ্গে টেস্টে নিজের প্রথম ইনিংসেই ৬ উইকেট নিয়েছিলেন, তবে দল হেরেছিল খুব কাছে গিয়ে। মিরপুরে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ইতিহাস গড়লো বাংলাদেশ, মিরাজ হলেন ম্যাচসেরা। ২ ইনিংসে নিলেন ১২ উইকেট। মিরাজ অফস্পিনার তখন। সেই অফস্পিনার হিসেবেই থাকলেন। তার দলে জায়গা পাওয়ার ক্ষেত্রেও ব্যাটিংটা সেভাবে সামনে এলো না, নিচের দিকে খেলে তিনিও যে খুব লাইমলাইটে এলেন, তাও নয়। 

    টেস্ট ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত ছয় বা এর ওপরে তিনি খেলেছেন মাত্র দুই ইনিংস, বেশিরভাগই খেলেছেন আটেই। ২০১৭ সালে হায়দরাবাদে ভারতের বিপক্ষে সেখানেই করেছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি, দ্বিতীয়টি করেছিলেন ২০১৮ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওই টেস্টে। 

    আজকের আগে টেস্ট ও ওয়ানডে মিলিয়ে মিরাজ ৩০ পেরিয়েছেন ১০ বার, এর মাঝে দল জিতেছে মাত্র একবার। এই ত্রিশ-পেরুনো ইনিংসগুলির একটিতে আবার ওপেনিংয়েও নেমেছিলেন তিনি, ২০১৮ এশিয়া কাপের ফাইনালে। 

    ব্যাটিংটা পারেন, তবে বোলিংটাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাকে জায়গা করে দিয়েছে বলে মত তার, “আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি ব্যাটিংটাও করতে পারি। আমি প্রতিনিয়ত চেষ্টা করি ভালো ব্যাটিং করতে।  (তবে) আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমি বোলার হিসেবে শুরু করেছি। আমি যদি ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতাম তবে জাতীয় দলে খেলতে পারতাম না। এখনও বলছি, ব্যাটসম্যান হিসেবে আমি এখনও বাংলাদেশ দলে খেলতে পারতাম না”, চট্টগ্রামে সিনিয়র লেভেলে যে কোনো ফরম্যাটে নিজের প্রথম সেঞ্চুরির পর বলেছেন মিরাজ। 

    “দেখেন বাংলাদেশ দলে প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড় অনেক। আমার জন্য সবচেয়ে ভাল অপশন-- অফস্পিনার বোলার-ব্যাটসম্যান হিসেবে যদি আমি খেলি, তাহলে টিম ম্যানেজমেন্ট, কোচ  এবং অন্য সবাই আমাকে (নিয়ে) চিন্তা করবে যে, বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংটাও সে ভালো করে। আমি সবসময়ই চেষ্টা করি বোলিংটা ভালো করার জন্য। বোলিং আমার অস্ত্র, আর ব্যাটিং হল আমাকে আত্মবিশ্বাস দেয়, বোলিংটাকে সাহায্য করে। আমি চেষ্টা করি দুটোর সমন্বয়ে যতটা ভালো করা যায়।”


    ****

    এমন না যে একেবারে নিখুঁত ইনিংস। ইনিংস বড় করতে গেলে এমন ‘লাক’ বা ‘কপাল’ বা এমন কিছুর সহায়তা পাওয়াটা স্বাভাবিকই। মিরাজও জীবন পেয়েছেন। আবার এমন কিছু শট খেলেছেন, ইনিংসের গতি এমন রেখেছেন, তাতে করে এই সেঞ্চুরিটা তার প্রাপ্য- বলতে হবে এমনও। শ্যানন গ্যাব্রিয়েলকে করা পাঞ্চ, কেমার রোচকে করা ফ্লিক বা জোমেল ওয়ারিকানকে ইনসাইড-আউট বা সুইপে মারা চার-- এসব শট কথা বলে মিরাজের ব্যাটিং সামর্থ্যের পক্ষেই। 
     


    এই টেস্টের আগে শেষ এক সপ্তাহ ব্যাটিং নিয়ে প্রস্তুতিটা ভাল হয়েছে তার। নেটে তামিম ইকবাল পরামর্শ দিয়েছেন, মুশফিক দিয়েছেন। তামিম বলেছেন, বাড়তি পেসের বা শরীরঘেঁষা ডেলিভারি আরও ভালভাবে কীভাবে খেলা যায়। মুশফিক তাকে নিয়ে একসঙ্গে ব্যাটিং অনুশীলন করেছেন। তামিমের পরামর্শ কাজে লাগিয়ে গ্যাব্রিয়েলকে সামলেছেন মিরাজ, মুশফিকের কথামতো বাইরের বলে খোঁচা দেননি। 

    উইকেটে এসে পেয়েছিলেন সাকিব আল হাসানকে, স্বাভাবিক ক্রিকেটের সঙ্গে যিনি শট খেলতে বলেছেন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। স্লগের বদলে প্যাডল সুইপ বেশি কার্যকর হবে, এমন পরামর্শ দিয়েছেন। মিরাজের মতে, এই ছোট ছোট ব্যাপারগুলিই আসলে গুরুত্বপূর্ণ। 

    টেস্ট শুরুর আগে আল মাহমুদ- খুলনায় মিরাজের প্রথম কোচ ফোন করে বলেছিলেন, একটা সেঞ্চুরি করা চাই। মিরাজ বিশ্বাস করেননি, তার পক্ষে সেঞ্চুরি করা সম্ভব। 

    তবে এখন বিশ্বাসটা বেড়ে গেছে তার। 

    **** 

    মাইলফলক ব্যাপারটা অদ্ভুত। আদতে অন্য কিছুর মতোই শুধুই আরেকটি একক ডিসক্রিট ভ্যালু বা বিচ্ছিন্ন মানের পার্থক্য। পেলে উচ্ছ্বাস, না পেলে হতাশা-- সবকিছুর মতো এটির ক্ষেত্রেও তাই। অথচ দলীয় ট্যালিতে শুধুই আরেকটা রানের ব্যাপার। ক্রিকেট ইজ আ টিম গেম প্লেইড বাই দ্য ইন্ডিভিজুয়ালস-- কথাটা হয়তো এসব কারণেই। 

    এদিন নাঈম হাসান যখন আউট হলেন ৯ম ব্যাটসম্যান হিসেবে, সেঞ্চুরি থেকে তখনও ৮ রান দূরে দাঁড়িয়ে মিরাজ। আউট হওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ মিরাজের দিকে তাকিয়ে থাকলেন নাঈম, চোখেমুখে হতাশার ভাবটা স্পষ্ট। সতীর্থর মাইলফলক মিসের শঙ্কা যেন তখনই পোড়াচ্ছে তাকে। নাঈমের ক্যারিয়ারে এটি ৬ষ্ঠ টেস্ট, এই টেস্টের আগে তার ও মিরাজের ব্যাটিং গড়ের পার্থক্য ০.২২। তবুও নাঈম যেন এ ইনিংসে শুধুই আরেকজন টেইল-এন্ডার, আর মিরাজ পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান। মিরাজ ব্যাটিং পারেন, সেটি তিনিও জানেন, হয়তো নাঈমও জানেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটই যেন সেভাবে জানে (জানত) না শুধু। 

    এ টেস্টে বাংলাদেশ দলে চারজন স্পিনার, তবে ভিন্ন কন্ডিশনে সে সংখ্যা কমে এলে মিরাজের দলে জায়গা নিয়ে যে লড়াই, সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী নাঈমও। তবে মিরাজের কাছে সবার আগে দলই এবং এর কম্বিনেশন, “আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অনেক অনেক কঠিন। আল্লাহর রহমতে আজকে হয়তো ভালো হয়েছে, ভবিষ্যতে ভালো ও খারাপ সময় যাবে। টিম কম্বিনেশনের জন্য অনেক কিছু হতে পারে। সবার আগে দল প্রথম। আমি হয়তো আজকে ১০০ করেছি পরেরদিন রান নাও করতে পারি।  উইকেট পেতে পারি নাও পেতে পারি। এগুলো পার্ট অফ লাইফ।  কিন্তু আমার কাছে যেটা মনে হয় টিম কম্বিনেশনের জন্য অনেক সময় অনেক কিছু করতে হয়। সবার আগে দল, আমরা প্রত্যেকটা ক্রিকেটারের মাথাতেই থাকে- সবার আগে দল। দলের জন্য খেলতে হবে, দলের চিন্তা করতে হবে। এখন অবশ্যই নিজের আত্মবিশ্বাসটা বেড়েছে। অনেকদিন ধরে রান পাচ্ছিলাম না। নিজেও হতাশ ছিলাম। বিগত কিছুদিন নিজেও কাজ করেছি। ভালো ব্যাটিং হয়েছে। নাঈম ভালো অফস্পিনার। আমিও খেলছি, এটা হয়তো টিম ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত। তারা যেটা ভালো মনে করেছে সেটাই ভবিষ্যতে করবে এবং এখনো করছে।”

    নাঈম যাওয়ার পর মিরাজের জন্য ছিলেন শুধু মোস্তাফিজ, যিনি নিজেই নার্ভাস ছিলেন, “মোস্তাফিজ আমাকে বলেছে যে, দোস্ত, আমার (মোস্তাফিজ) খুব ভয় লাগতেছিল তোর (মিরাজ) টেনশনে যে তোর ৯০ হয়ে গেছে, ওখানে যদি আমি আউট হয়ে যাই! তবে আমি ওকে একটা কথাই বলেছি, 'দোস্ত, এটা তোর হাতেও না, আমার হাতেও না। তুই তোর স্বাভাবিক ক্রিকেট খেল। যদি আমার কপালে থাকে, আল্লাহ্‌ যদি আমার ওপর রহম করে তাহলে ১০০ হবে। এটা তো তোর হাতে নাই। তুই তোর মতোন খেল। চেষ্টা কর ভালোমতন খেলার। আমার যদি কপালে থাকে, তাহলে ১০০ হবেই।' আমি ওইভাবেই মানসিকভাবে (প্রস্তুতি) নিয়ে নিয়েছি। আমার করতেই হবে-- এটা আমি কখনও চিন্তা করিনি। আমি চিন্তা করেছি যে, আল্লাহ্‌ যদি আমার কপালে রাখে তাহলে সেঞ্চুরি হবেই। এটার ওপর অনেক বিশ্বাস করেছি।”

    মিরাজ আদতে নিজের ব্যাটিংয়ের ওপর এদিন বিশ্বাস করেছেন। 

    ****

    জোমেল ওয়ারিকানকে প্যাডল সুইপ করেছেন এরপর। সিঙ্গেলের আগে উদযাপন শুরু করলেও ডাবলস পূর্ণ করতে ভোলেননি। মিরাজ পৌঁছে গেছেন জাদুকরি তিন অঙ্কে, যে তিন অঙ্ক উচ্ছ্বাসে ভাসায়, উদযাপনের সুযোগ করে দেয়, আর জোগায় আত্মবিশ্বাস। যে তিন অঙ্ক যেন একটা অপেক্ষার শেষ টানে।

    “আমার নিজের জন্য অনেক বড় একটা পাওয়া। আমি নিজে খুব একটা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম না। কিন্তু এখন আমার মধ্যে বিশ্বাস জন্মেছে যে যদি আমি ব্যাটিং নিয়ে আরো পরিশ্রম করি, কাজ করি তাহলে অবশ্যই ভালো অলরাউন্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব। আমার কথা হলো যেহেতু আমার সুযোগ আছে তাহলে কেন আমি সেই সুযোগ কাজে লাগাব না”, বলেছেন মিরাজ। 

    সেঞ্চুরির পর ড্রেসিংরুমে ব্যাট উঁচিয়ে ধরার কিছুক্ষণ পর ব্যাট-হেলমেট একপাশে রেখে সিজদাহ দিয়েছেন মিরাজ। এবার আর অন্য কারও অর্জনের আবেগে নয়, এবার বেশ একটা অপেক্ষার পর, নিজের আত্মবিশ্বাস জোগানো এক ইনিংসের পর।