রাজ্জাক, নাফীস, নস্টালজিয়া
আব্দুর রাজ্জাক তেমন কিছু বললেন না, বলার মতো অবস্থা নেই তার। শাহরিয়ার নাফীস অবশ্য নোট নিয়ে এসেছেন, গুবলেট পাকাতে চান না কোনও। যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে দুজন কথা বললেন, সেখান থেকে একটু দূরেই বাংলাদেশের লড়াইটা চালাচ্ছেন লিটন দাস ও মেহেদি হাসান মিরাজ। মিরপুর টেস্টের তৃতীয় দিন লাঞ্চ বিরতিতে শের-ই-বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামের মিডিয়া সেন্টারের সামনের চত্ত্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়ে গেল বাংলাদেশ ক্রিকেটের একটা অধ্যায়। রাজ্জাক ও নাফীস-- বাংলাদেশ ক্রিকেটের দীর্ঘদিনের সারথি বিদায় বললেন শীর্ষ পর্যায়ের যথাক্রমে ১৮ ও ১৬ বছরের পেশাদার ক্যারিয়ারকে।
৮ বছর আগে জাতীয় দলের হয়ে শেষ খেলেছেন টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক নাফীস। ২০১৮ সালে চার বছর পর এক টেস্টের জন্য ফিরেছিলেন রাজ্জাক। জাতীয় দলে ফেরার সম্ভাবনা কার্যত দুজনেরই শেষ হয়ে গেছে আগেই। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ঘরোয়া ক্রিকেটও বন্ধ বেশ কিছুদিন ধরে, গত বছর ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে রাজ্জাক ও বিসিএলে শেষ খেলেছিলেন নাফীস। ৩৮-পেরুনো রাজ্জাককে কদিন আগেই করা হয়েছে বিসিবির জাতীয় নির্বাচক প্যানেলের সদস্য, আর ৩৫-পেরুনো নাফীস হয়েছেন বিসিবির ক্রিকেট অপারেশনসের ডেপুটি ম্যানেজার। নতুন ভূমিকায় আসার ঘোষণার পরই মোটামুটি শেষ হয়ে গেছে তাদের ক্রিকেট ক্যারিয়ার, এদিন শুধু আনুষ্ঠানিকতাটাই হলো।
তবুও, বিদায় আর শেষ তো সবসময়ই অদ্ভুত।
নাফীস যেমন বলছিলেন, তিনি আসলে এখনও বুঝতে পারছেন না, “‘কঠিন (অনুভূতি)। আমি খেলব না সেটার জন্য কষ্ট লাগছে ব্যাপারটা তা না। একটা অদ্ভুত অনুভূতি। একটা জিনিস বলব, আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে অনেক ভেবেচিন্তে নিয়েছি। যখন মনে করেছি ক্রিকেটে খেলোয়াড় হিসেবে আর কিছু কন্ট্রিবিউট করতে পারব না, তখন ভেবেছি ক্রিকেটের সঙ্গেই থাকব। মনে হয়েছে এটাই আদর্শ সময়। কাজেই কষ্ট হয়নি।”
রাজ্জাকও আছেন ঘোরের মাঝে, “গতকাল পর্যন্ত আমি ছিলাম ক্রিকেট খেলোয়াড়। আর এখন আমার আরেকটা পরিচয় বলতে হবে। যতটা সহজে বলছি আমার জন্য ততটা সহজ না। আমি এখনো ঘোরের মধ্যে আছি। ১৯৯৪ থেকে আমার মূলত ক্রিকেটে আসা, যখন আমি বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছি। সে জিনিসটাকে বিদায় বলা! সময়ের দাবিতে মানুষকে ছেড়ে দিতে হয়। আবেগ বলে যে ব্যাপারটা আছে, আমার মধ্যে সেটা কাজ করছে।”
রাজ্জাকের নির্বাচক হওয়া, নাফীসের বিসিবির নতুন ভূমিকা, ঘরোয়া ক্রিকেট বন্ধ, জাতীয় দলের ফেরার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাওয়া-- সব সমীকরণ মিলিয়ে এ দুজনের বিদায়কে খুব স্বাভাবিকভাবে নিলেও হয়তো তাই অদ্ভুত লাগবে, আবেগ নামের ব্যাপারটা কাজ করবে, রাজ্জাক-নাফীস এবং আরও অনেকের মাঝেই।
****
২০০২ সালে যশোরের শামসুল হুদা স্টেডিয়ামে প্রথম শ্রেণিতে অভিষেক হয়েছিল রাজ্জাকের, খুলনার হয়ে সিলেটের বিপক্ষে। জাতীয় লিগে ক্যারিয়ারে সবসময়ই খুলনার হয়ে খেলেছেন তিনি। ২০০৪ সালে ওয়ানডে অভিষেকের পর থেকে ২০১৪ সালে পর্যন্ত নিয়মিত খেলা রাজ্জাকা ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে সবার আগে ২০০ উইকেট পেয়েছিলেন। এখনও এ ফরম্যাটে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির তালিকায় তিনে রাজ্জাক। মাঝে অ্যাকশনজনিত সমস্যার কারণে ২০০৮ সালে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি, এরপর উইকেট পেলেও ইকোনমি রেট ও বোলিং গড়টা বেড়েছিল তার। ২০০৬ সালে অভিষেক হলেও টেস্ট ক্যারিয়ারটা সেভাবে দীর্ঘ হয়নি রাজ্জাকের, ১৫৩ ওয়ানডের বিপরীতে খেলেছেন ১৩টি টেস্ট।
তবে ঘরোয়া প্রথম শ্রেণিতে রাজ্জাক খেলে গেছেন নিয়মিত, ভেঙেছেন রেকর্ড। বাংলাদেশীদের মাঝে প্রথম বোলার হিসেবে প্রথম শ্রেণিতে ৪০০, ৫০০, ৬০০ উইকেট পাওয়া রাজ্জাক বিদায় বললেন ৬৩৪ উইকেট নিয়ে, সঙ্গে ইনিংসে ৪১ বার ৫ উকেট, ম্যাচে ১০ উইকেট ১০ বার-- সবই রেকর্ড। সঙ্গে লিস্ট ‘এ’-তে ২৮০ ম্যাচে নিয়েছেন ৪১২ উইকেট, বাংলাদেশের রেকর্ড যেটিও। টি-টোয়েন্টিতে আছে ৯৯ উইকেট। ব্যাটিংয়ে তিন ফরম্যাট মিলিয়ে সাড়ে ৪ হাজারের ওপর রানও আছে এই বাঁহাতির, এমনকি ওয়ানডেতে বাংলাদেশের দ্রুততম ফিফটির রেকর্ডটিও তার, ২০১৩ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেটি করেছিলেন ২১ বলে। বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৬ বার ম্যাচসেরা হয়েছিলেন তিনি।
২০১৪ সালে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েছিলেন, তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে রাজ্জাক পারফর্ম করে গেছেন নিয়মিত। প্রথম শ্রেণিতে ২০১৫-১৬ ও ২১০৭-১৮-তেও এক মৌসুমে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ড ভেঙেছিলেন দুইবার। তবে নির্বাচকরা বারবার উপেক্ষা করেছিলেন তাকে সে সময়, অবশ্য ২০১৮ সালে হুট করেই এক টেস্টের জন্য ফেরানো হয়েছিল।
এখন নিজে নির্বাচক রাজ্জাকের আশা, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটটা তিনি যেমন ‘সিরিয়াসলি’ খেলেছেন, বাকিরাও তাই করবেন, “আমি আশা করব আমার থেকে আরও গুরুত্ব দিয়ে খেলবে। সেভাবে খেলে জাতীয় দলে আসবে। এটা না হলে আসলে আমাদের ক্রিকেটের জন্য ভাল কিছু হবে না। আর মিস করার ব্যাপারটা হচ্ছে। আমার এই ক্যারিয়ারটা আমার জীবনে বিশেষ (কিছু)। আমার মনে হয় না কখনো ভুলতে পারব। এটা ভোলার মতো না। আমার কাছে স্মরণীয় (হয়ে) থাকবে।”
“‘আমার পরিবারকে ধন্যবাদ জানাই। কারণ খুব কম বয়সে আমি বিকেএসপিতে ভর্তি হতে চেয়েছি। তারা সমর্থন করেছে। আমি যত রকম খেলা খেলেছি সব কিছুতে সমর্থন করেছে। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পর তো আর কিছু বলার থাকে না।”
****
বাংলাদেশ ক্রিকেটে শাহরিয়ার নাফীস এসেছিলেন নতুন দিনের গান শুনিয়ে। ২০০৪ সালে প্রথম শ্রেণিতে অভিষেক করা নাফীসের টেস্ট অভিষেক হয়ে গিয়েছিল পরের বছরই। ২০০৫ সালে ন্যাটওয়েস্ট ট্রফিতে ওয়ানডে অভিষেক তার। ক্যারিয়ারের চতুর্থ ম্যাচে দল হারলেও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৭৫ রানের ইনিংসে জন্য ম্যাচসেরা হয়েছিলেন তিনি।
পরের বছর ফতুল্লা টেস্টে একই প্রতিপক্ষের সঙ্গে করেছিলেন ১৩৮ রান, সম্ভবত তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় ইনিংস। অবশ্য বাংলাদেশ হেরেছিল ৩ উইকেটে। সে বছর ওয়ানডেতেও এক পঞ্জিকাবর্ষে করেছিলেন হাজার রান।
২০০৮ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম অনুজ্জ্বল দিক আইসিএল অধ্যায়ের অংশ ছিলেন বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টির প্রথম অধিনায়ক, একসময়ের সহ-অধিনায়ক নাফীসের যোগ দেওয়া। ভারতের সেই ক্রিকেট লিগে খেলে বিসিবি থেকে নিষেধাজ্ঞা পেয়েছিলেন ১০ বছর। এরপর সে নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি মিলেছিল তার, জাতীয় দলে ফিরেছিলেনও। গত বছর নিজের ইউটিউব শো-তে নাফীস অবশ্য বলেছিলেন, তখনকার বোর্ড ও টিম ম্যানেজমেন্ট তাকে দলে চায় না, ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকেই ‘নিষিদ্ধ নয়, অস্বীকৃত’ আইসিএলে গিয়েছিলেন তিনি।
সব মিলিয়ে ৭৫ ওয়ানডে ও ২৪টি টেস্ট খেলেছেন তিনি। তবে রাজ্জাকের মতো তিনিও ঘরোয়া ক্রিকেটে ছিলেন নিয়মিত, প্রথম শ্রেণিতে বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের মাঝে চতুর্থ সর্বোচ্চ ৮১৪১ রান তার, ১৫টি সেঞ্চুরির সঙ্গে আছে ৪৮টি ফিফটি। লিস্ট ‘এ’-তে ৫ হাজার, আর টি-টোয়েন্টিতে ১ হাজারের ওপর রান তার। রাজ্জাকের মতো নাফীসও এক মৌসুমে বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণিতে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড সাম্প্রতিক সময়েই গড়েছেন দুইবার-- ২০১৫-১৬ ও ও ২০১৪-১৫-তে। তবে টেস্টে আর ফেরা হয়নি তার।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে নাফীস হয়তো অনেকের কাছে একটা আক্ষেপের নাম হলেও নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে তৃপ্ত তিনি, “আমার কোনো অতৃপ্তি নেই। হয়ত পরিসংখ্যান অনেক ভাল হতে পারত। কিন্তু পরিসংখ্যান দিয়ে বিচার করছি না। খেলে বাংলাদেশের মানুষের, গণমাধ্যমের যে ভালোবাসা পেয়েছি। আমার মনে হয় এর চেয়ে বেশী সম্ভব ছিল না।”
“আমার বয়স যখন ১০, তখন আমার বাবা-মা আমাকে খেলার জন্য সমর্থন যুগিয়েছেন। এটা তো শুরু। এরপর সবচেয়ে বড় অবদান আমার স্ত্রীর। আমি অনেক কম বয়েসে বিয়ে করি। অনেক উঠানামা ছিল। সে আমার পাশে ছিল সব সময়।”
****
একজন হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম স্পিন-ভরসা, বাঁহাতি স্পিনে বাংলাদেশের বিপ্লবের আরেক নাম। আরেকজন ব্যাটিংয়ে দেখিয়েছিলেন দারুণ ধারাবাহিকতা। একজনের অ্যাকশনজনিত সমস্যা, আরেকজনের ‘নিষিদ্ধ’ লিগে খেলতে যাওয়া-- সেসব ফেলে দুজনই আবারও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেছিলেন, ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে গেছেন দীর্ঘদিন।
বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতিতে মাঠ থেকে বিদায় বলার ঘটনা যেমন বিরল, তেমনি বিদায়ী সংবর্ধনাও সেভাবে জোটে না সবার। জাতীয় দলে ব্রাত্য হয়ে পড়ার পর ঘরোয়া ক্রিকেটে নিভৃতেই বিদায় বলেন তারা। রাজ্জাক-নাফীস সেদিক থেকে ‘সৌভাগ্যবান’, বিসিবি ও ক্রিকেটারস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (কোয়াব)-এর কাছ থেকে আলাদা করে সংবর্ধনা পেলেন তারা, নতুন একটা সংগঠন ‘পিচ ফাউন্ডেশন’-এর আত্মপ্রকাশের মঞ্চে।
এখনও তারা ক্রিকেটের সঙ্গে থাকবেন, তবে দল নির্বাচন বা প্রশাসনে। নতুন দুয়ার খুললেও আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়ে গেল আরেকটা। আব্দুর রাজ্জাক ও শাহরিয়ার নাফীস-- দুই বাঁহাতি বাংলাদেশ ক্রিকেটের দীর্ঘদিনের সারথি, যাদের ক্যারিয়ার নিয়ে আছে আক্ষেপ, আছে তৃপ্তি, আছে উচ্ছ্বাস-বেদনার গল্প। একজনের এক আঙুল তুলে করা উইকেটের, আরেকজনের দুহাত তুলে করা সেঞ্চুরির উদযাপনের ছবি বাংলাদেশ ক্রিকেট অনুসারী একটা প্রজন্মের কাছে নস্টালজিয়ার নাম। ঘরোয়া ক্রিকেটে দুজনের নিবেদনই ছিল অনুকরণীয়, তাদের ক্যারিয়ারও দীর্ঘ, বর্ণিল। তাদের বিদায়টা অনুমিত হলেও তাই সে ক্ষণটা হয়ে ওঠে অদ্ভুত।