এরিকসেন এবং যখন সময় থমকে দাঁড়ায়...
ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন,
তোমার জন্য কাল থমকে গিয়েছিল সময়। ফুটবলবিশ্ব তোমার জন্য একসাথে বসেছিল প্রার্থনায়, সেটা বৃথা যায়নি। ডেনমার্কের ওই সতীর্থ যখন তোমার দিকে থ্রো করছিলেন, তখন তার দূরতম কল্পনাতেও ছিল না এর পরে কি হতে যাচ্ছে। তুমি যখন লুটিয়ে পড়লে মাটিতে, এরপরের মিনিট পনেরো-দশেকে পৃথিবীতে কি হয়েছে, তা তুমি জানো না।
ফিনল্যান্ডকে হারানোর জন্য তুমি খেলছিলে, সেই ফিনল্যান্ডের সমর্থকেরাই দুইটা ফ্ল্যাগ ছুড়ে দিলে মাঠে। তোমার ওই অবস্থার প্রাইভেসি রক্ষণের জন্য। তোমার বন্ধু সাইমন কায়ের, স্মাইকেলদের দুশ্চিন্তায় অবস্থা খারাপ। পুরো ডেনমার্ক দল কাঁদছিলো তোমার জন্য, কাঁদছিলো পুরো মাঠ। তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে গেল পুরো বিশ্বে। সংক্রমিত হলো ফুটবলবিশ্ব। কোপেনহেগেনের সেই মাঠে সেদিন শোক নেমে এলো। উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা বিরাজ করলো সকলের মনে। শোকের কান্নায় প্লাবিত হলো সকল মানবহৃদয়। এদিন মিলে গিয়েছিল সকলের প্রার্থনা, সবার প্রাথর্না ছিল একটাই- ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনের সুস্থতা।
প্রথমার্ধের বাকি থাকা পাঁচ মিনিটের খেলা শেষে পাঁচ মিনিটের বিরতি বাদে দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শেষ হলো। স্মাইকেলরা মাঠে খেলেছেন শুধু খেলার জন্যেই। তোমাকে ওই অবস্থায় রেখে তাদের জন্য লড়ে যাওয়া সহজ ছিল না। তারপরেও তারা লড়ে গেছেন হয়তো তোমাকে লড়ে যাওয়ার বার্তা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই। তুমি খেলা চালিয়ে যাওয়ার কথা যতক্ষণ বলোনি, ততক্ষণ তারা মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নেয়নি। বদলি হিসেবে নামার সময় যেকোন ফুটবলারেরই আনন্দে থাকার কথা, ইয়ানসেনের এদিন তোমার জায়গায় নামতে একটুও আনন্দ হয়নি।
সহজ সেভটা করতে পারেননি কেসপার স্মাইকেল। পেনাল্টি মিসের কথা তোমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া ঠিক হবে কিনা জানিনা। হয়বিয়ার বদলে তুমি থাকলে পেনাল্টিটা তুমি নিয়ে ডেনমার্ককে হার থেকে বাঁচাতে পারতে। তাতে আর কিই-বা আসে যায়! সবচেয়ে বড় কথা, ডেনমার্ক হেরেছে, তবু মানবতা জিতেছে, জিতেছে জীবন। মাঠের এক কোণায় তোমাকে ঘিরে ড্যানিশ ফুটবলারদের প্রাইভেসি ওয়াল দেয়ার ছবি তো ঘুরে বেড়াচ্ছে অন্তর্জালজুড়ে, সাথে কুড়াচ্ছে প্রশংসাও। কোপেনহেগেনের সেই মাঠে থাকা দর্শকেরাও কি প্রশংসার কম দাবিদার? ফিনিশ দর্শকদের ‘ক্রিশ্চিয়ান’ বলার পরে ড্যানিশ দর্শকদের ‘এরিকসেন’ আওয়াজ তুমি কি শুনতে পেয়েছিলো? স্থগিত ঘোষণার পরেও হাজার পনেরো দর্শক মাঠ ছাড়েনি তোমায় নিয়ে থাকা আশঙ্কায়।
খেলা আজ আর শুধু খেলা হিসেবে নেই। খেলা এখন প্রায় যুদ্ধেরই নামান্তর। তবু কোপেনহেগেনের পার্কেন স্টেডিয়ামে সেদিন প্রমাণিত হলো- খেলার বাইরে যে জীবনের মুল্য অনেকখানি।তোমার প্রতিপক্ষ দল তাদের ইতিহাসে এই প্রথমবার কোন বড় টুর্নামেন্টে খেলতে নেমেছে। তাদের থেকে এগিয়ে থাকা দলকে গোল দিয়ে তারা সেই উদযাপনটুকও করেনি। ফুটবল যে শুধুই একটি খেলা নয়, এর সাথে কত আবেগ জড়িয়ে, জীবন জড়িয়ে, বাণিজ্য এখানে আসে কেবলই উপসর্গ হিসেবে- বিপ্লবের ধজাধারীদের এবার কি সে বোধোদয় হলো?
এরিকসেন, ফুটবল খেলতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হয়েছে এর আগে নিশ্চয়ই। এসব গল্পও জানবে কোনওদিন, তখন গর্ববোধের মাত্রাটা অসীমতক ছাড়িয়ে যাবে। ডেনমার্কের খেলার সময়েই সেইন্ট পিটার্সবার্গে তোমার কয়েকজন সতীর্থ খেলতে নেমেছিল। সেখানে তোমার ইন্টার সতীর্থ রোমেলু লুকাকু দুটি গোল করেছেন। এবং তা যে তোমাকেই উৎসর্গ করেছেন, সে খবর কি পেয়েছ? ক্যামেরায় এসে ‘ক্রিস, ক্রিস, আই লাভ ইউ’ বলে বিশ্বকেও লুকাকু তোমার প্রতি তার ভালোবাসা জানিয়ে দিয়েছেন। যার সাথে তিনি তার পরিবারের থেকে বেশি সময় কাটিয়েছেন। ফুটবলের জন্যই তো সতীর্থ, কোচ, খেলোয়াড়, ফুটবলপ্রেমী দর্শককুল সকলেরই ভালবাসা জুটলো তোমার জীবনে। এই ফুটবলের জন্যেই তোমার কাছে অচেনা কত দেশের কত মানুষ দুশ্চিন্তায় থেকে তোমার জন্য করেছে প্রার্থনা। এই ভালোবাসার জন্যে, লুকাকুর ভালোবাসার জন্যে তো তোমাকে বাঁচতে হবে।
আহ, বাঁচার কথা আসায় এতক্ষণে তারাও এলেন মনে। যারা তোমায় বাঁচাতে এগিয়ে এলেন। সবার প্রথমেই যাদের কথা বলার কথা, তারা এলেন কিনা সবার শেষেই। অবশ্য এসব ফ্রন্ট লাইনের যুদ্ধারা সবসময়ই পড়ে যান আড়ালে। সেইসব মেডিকেল স্টাফদের ধন্যবাদ না দেওয়াটা হবে বড়ই অনুচিত। লেখাটা এখানেই শেষ করে দিলে আরেকটা অনুচিত বিষয়ও থেকে যেত- যাকে চিঠি লেখা সেই তারই যে খবর নেওয়া হলো না! এই অবস্থায় সবার আগে জানতে চাওয়া উচিত- কেমন আছো তুমি এরিকসেন? জেনেছি তুমি কথা বলতে পারছো, শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছ। দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠো, প্রার্থনা থাকলো এটিই। লুকাকুর ক্রিস, ফুটবল তোমাকে দেখার অপেক্ষায়!
সেদিন কোপেনহেগেনের পার্কেন স্টেডিয়ামে ঘটে যাওয়া সবকিছু, কিংবা বিশ্বের পাওয়া ভালোবাসার কথা হয়তো তুমি কোনও একদিন জানবে। তবে এসব গল্প হয়তো তোমার কখনোই জানা হবে না যে- বাংলাদেশ নামক এক দেশও তোমার জন্য কতটা উৎকণ্ঠায় ছিল!