• ফুটবল, অন্যান্য
  • " />

     

    ফিরে দেখাঃ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ '০৩

    ফিরে দেখাঃ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ '০৩    

    অক্টোবরের এক তারিখ থেকে শুরু হচ্ছে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ এর ত্রয়োদশতম আসর। ১৯৯৩ থেকে শুরু হয়ে মোট বারো বার আয়োজিত এই প্রতিযোগীতায় এদেশের সেরা সাফল্য ২০০৩ সালে ঘরের মাটিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়া। এই অঞ্চলের ফুটবলে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের সবচেয়ে বড় সুযোগ এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ এবার কেমন করবে তার উত্তর ভবিষ্যতের হাতেই তোলা থাক। তার আগে “গরীবের বিশ্বকাপ” সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবলে বাংলাদেশের একমাত্র শিরোপা পথে গ্রুপ পর্বে মালদ্বিপের সাথে শেষ মুহুর্তে জয়ের গোল, সেমিতে মতিউর মুন্নার গোল্ডেন গোল, ফাইনালে টাইব্রেকারে সুজনের শেষ শট  এর সোনালি মুহুর্তগুলো একটু স্মৃতির পাতা থেকে ঘুরে আসা যাক।

    গ্রুপঃ- বরাবরের মতো সাফের আটটি দলকে দুই গ্রুপে ভাগ করা হয়।

    গ্রুপ A– ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, আফগানিস্তান

    গ্রুপ B-  বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, নেপাল, ভূটান

    বাংলাদেশ স্কোয়াডঃ

    গোলরক্ষকঃ আমিনুল হক, বিপ্লব ভট্টাচার্য

    ডিফেন্ডারঃ হাসান-আল-মামুন, ফিরোজ মাহমুদ হোসেন টিটু, রজনীকান্ত বর্মন, নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ সুজন, মোস্তফা আনোয়ার পারভেজ বাবু, মাহমুদুল হাসান

    মিডফিল্ডারঃ আরিফ খান জয়, মতিউর রহমান মুন্না, আরমান মিয়া, আব্দুল কাইয়ূম সেন্টু, সাইফুল ইসলাম, মনোয়ার হোসেন, মেহেদী হাসান উজ্জ্বল

    ফরোয়ার্ডঃ রোকনুজ্জামান কাঞ্চন, আলফাজ আহমেদ, আরিফুল কবির ফরহাদ, সাইফুর রহমান মনি

    কোচঃ জর্জ কোটান

    দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হন রজনীকান্ত বর্মন।

    জার্সি: লাল-সবুজের দেশ বাংলাদেশের জার্সি ঠিক করা হয় সাদা রঙ এর । কাঁধে আর হাতে নীল বর্ডার দেওয়া সাদা জার্সি, সাদা শর্টস আর সাদা মোজা পড়ে খেলতে নামেন খেলোয়াড়েরা।

    বাংলাদেশের ট্যাকটিকস:

    তৎকালীন বাংলাদেশের কোচ অস্ট্রিয়ান জর্জ কোটান বেশ কৌশলী ছিলেন । পুরো ৯০ মিনিট একই দমে খেলা সম্ভব না বুঝতে পেরে দুই অর্ধে দুই কৌশলে খেলান দলকে। মূল ফর্মেশন ছিলো ৫-৩-২ যা আক্রমনে ৩-৫-২ হয়ে যেতো। প্রথমার্ধ মূলত “পাস অ্যান্ড রান” পদ্ধতিতে খেলে গোল আদায়ের চেষ্টা করতো দল। এসময় উইং এর ব্যবহার হতো বেশী। দ্বিতীয়ার্ধে কিছুটা স্লো-বিল্ড আপ, মাঝমাঠ দিয়ে আক্রমণ এবং প্রথমার্ধে আদায়কৃত গোল ধরে রাখার চেষ্টা। এছাড়াও রক্ষণের দিকে দিয়েছিলেন বিশেষ নজর। তাই থ্রি-ম্যান ব্যাকলাইনে তিন সেন্টার-ব্যাক নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ সুজন এবং রজনী কান্ত বর্মন খেলতেন। দুই উইংব্যাক হিসেবে খেলতেন হাসান-আল-মামুন এবং পারভেজ বাবু। যারা প্রথমার্ধে মূহুর্মুহু আক্রমনে ব্যতিব্যস্ত রাখতেন প্রতিপক্ষের ডিফেন্স এবং দ্বিতীয়ার্ধে কিছুটা ডিফেন্সিভ হয়ে যেতেন। তবে সুযোগ পেলেই প্রতি আক্রমণে উঠতে ভুলতেন না।

    মাঝমাঠে খেলতেন তিনজন। আরিফ খান জয়, মতিউর মুন্না এবং আরমান মিয়া। এর মধ্যে জয়ের কাজ ছিলো মূলত স্ন্যাচারের। মধ্যসীমা থেকে প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডদের দিকে বলের যোগান বন্ধ করা। মতিউর মুন্না ছিলেন বক্স-টু-বক্স মিড। একদিকে জয়কে সাহায্য করতেন একইসাথে করতেন ফরোয়ার্ডদের সাথে লিঙ্ক তৈরির কাজ। আর আরমান মিয়া ছিলেন নিঁখাদ বল প্লেয়ার। প্রথমার্ধে উইং বেশী ব্যবহার হওয়ার কারনে তেমন চোখে পড়তো না তাঁকে। তবে দ্বিতীয়ার্ধেই নিজের সেরাটা দেখাতেন তিনি। নিঁখুত সব পাসে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সে ফাটল ধরাতেন। স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতেন আলফাজ আহমেদ এবং রোকনুজ্জামান কাঞ্চন। দেশসেরা আলফাজ তখন কিছুটা অফ ফর্মে আর কাঞ্চন দুর্দান্ত খেলছেন তখন। তাই সামনে মুলত তিনিই খেলতেন আর পেছনে আলফাজ দিতেন যোগ্য সহায়তা।

    দ্বিতীয়ার্ধে সাধারনত দুটি পরিবর্তন দেখা যেতো। লেফট ব্যাক পারভেজ বাবুকে তুলে নামানো হতো মাহমুদুল হাসান কে যিনি রক্ষণ কাজে তুলনামূলকভাবে পারঙ্গম। এছাড়া আলফাজকে তুলে প্রয়োজন অনুযায়ী ফরহাদ কিংবা উজ্জ্বল কে নামানো হতো খেলার গতি বাড়ানোর জন্যে। গোলকিপারের কথা তো বলাই হয়নি। ওই টুর্নামেন্টে গোলবার আগলানোর দায়িত্বের জন্যে  আমিনুল হক এবং বিপ্লব ভট্টাচার্যের মধ্যে জোর প্রতিযোগিতা হয়েছিলো। একদিকে অনেক দিনের ইনজুরি থেকে আমিনুল মাত্র ফিরেছেন অন্যদিকে বিপ্লব বেশ ভালো ফর্মে। তবে কোচ কোটান আমিনুলের ওপরেও আস্থা রাখেন শেষ পর্যন্ত।

     

    গ্রুপ পর্বের কথাঃ

    প্রথম ম্যাচ (১১.১.২০০৩) – প্রতিপক্ষ নেপালঃ

    প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ পায় নেপালকে। এই নেপালকে হারিয়েই ১৯৯৯ সালের সাফ গেমস ফুটবলে স্বর্ণপদক জয় করে বাংলাদেশ। তবে টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই শিরোপার অন্যতম প্রত্যাশী ভারত হেরে যাওয়ায় এদেশের মানুষের মনে যে অঘটনের চিন্তা আসেনি তা বলা যাবে না। তবে সকলের দুশ্চিন্তা দূর করে প্রথম মিনিট থেকে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সে ঝাঁপিয়ে পড়েন আলফাজ, কাঞ্চনেরা। গোল হতে হতেও হচ্ছিলো না। অবশেষে প্রথমার্ধের ৩০ মিনিটে গোলের মুখ খোলেন আলফাজ। পুরো ম্যাচে আর গোল হয়নি। তবে বাংলাদেশ খেলেছিল ফেভারিটের মতই। নেপাল খুব বেশী আক্রমণে উঠতে পারেনি। দু-একবার যাও বা চেষ্টা করেছিলো তাও আটকে গেছে নজরুল, রজনী, সুজনদের দেয়ালের সামনে।

    বাংলাদেশ একাদশঃ আমিনুল; হাসান-আল-মামুন, রজনী, নজরুল, সুজন, পারভেজ বাবু (মাহমুদুল ৭৬’); জয়, মুন্না (সাইফুল ৮৫’), আরমান; আলফাজ, কাঞ্চন (মনি ৭৬’)

    দ্বিতীয় ম্যাচ (১৩.১.২০০৩) – শক্তিশালী মালদ্বীপঃ

    কাগজে-কলমে এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে কঠিন ম্যাচ গ্রুপের। মালদ্বীপ তখন দূর্দান্ত ফর্মে। ভুটানকে প্রথম ম্যাচেই হারিয়েছে ৬-০ গোলে। ম্যাচটিও হচ্ছিলো জমজমাট। এদিন বাংলাদেশের ডিফেন্সকে বেশ কয়েকবার শক্ত পরীক্ষার মধ্যেই ফেলেছিলেন মালদ্বীপের ফরোয়ার্ডেরা। বাংলাদেশও আক্রমণ শানিয়েছিলো অনেক। তবে কোনো পক্ষই গোলের দেখা পাচ্ছিলো না। সবাই যখন ড্রকেই ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছে। খেলার ৯০ মিনিটে হটাত মালদ্বীপের বক্সের ডানপাশে বল পেয়ে যান জয়। ডি-বক্সে স্ট্রাইকারের উদ্দেশ্যে ক্রস করতে যান জয়। কিন্তু ফুটবল দেবতার অনন্য ইচ্ছায় বল বাঁক খেয়ে সরাসরি ঢুকে যায় মালদ্বীপের জালে। গোল!!! অন্তিম সময়ে এমন গোলে পুরো বাংলাদেশ তখন আনন্দে মাতোয়ারা আর প্রতিপক্ষ হতবাক।

    বলা হয়ে থাকে, ফুটবলে যেকোনো টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হতে হলে লাগে “চ্যাম্পিয়ন’স লাক”। এই ম্যাচ যেনো বুঝিয়ে দিলো এই টুর্নামেন্টে এই লাক এবার বাংলাদেশের। 

    বাংলাদেশ একাদশঃ আমিনুল; হাসান-আল-মামুন, রজনী, নজরুল, সুজন, পারভেজ বাবু; জয়, মুন্না, আরমান; আলফাজ (ফরহাদ ৬৯’), কাঞ্চন 

    তৃতীয় ম্যাচ (১৫.১.২০০৩) – সহজ প্রতিপক্ষ ভূটানঃ

    আগের দুটি ম্যাচ জিতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা প্রায় নিশ্চিত। তার উপর প্রতিপক্ষ ভূটান, যারা তখনকার সময়ে সাফের সবচেয়ে দুর্বল দল। জর্জ কোটান এই ম্যাচে দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের দেন বিশ্রাম। নিয়মিত একাদশের কেবল নজরুল এবং মতিউর মুন্না খেলেন। এছাড়া বদলী হিসেবে পরে কাঞ্চন , আলফাজ এবং পারভেজ বাবু নামেন। দলকেও খেলান পরিবর্তিত ৪-৩-৩ ছকে। তবে জয় পেতে সমস্যা হয়নি। খেলার ৩ আর ৫৪ মিনিটে দুটি গোল করেন প্রথমবারের মতো মূল একাদশে জায়গা পাওয়া ফরহাদ। আগের দুই ম্যাচে গোল পেতে ব্যর্থ কাঞ্চন এদিন বদলী হিসেবে নেমে ৭৮ মিনিটে টুর্নামেন্টে নিজের গোলের খাতা খোলেন। দল মাঠ ছাড়ে ৩-০ গোলের জয় নিয়ে।

    বাংলাদেশ একাদশঃ বিপ্লব; টিটু, নজরুল, মাহমুদুল, সেন্টু; সাইফুল (পারভেজ বাবু ৭৫’), মনোয়ার (কাঞ্চন  ৬২’), মুন্না;  ফরহাদ, মনি (আলফাজ ৫৬’), উজ্জ্বল

    সেমিফাইনাল লাইন-আপঃ

    গ্রুপ A থেকে তিন ম্যাচেই জয় তুলে নিয়ে শীর্ষস্থান দখল করে পাকিস্তান। ভারত ও শ্রীলংকা দুই দলই ৪ পয়েন্ট পেলেও গোল ব্যবধানে সেমিতে উঠে যায় ভারত। অপরদিকে B গ্রুপে বাংলাদেশ ৯ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন এবং মালদ্বীপ ৬ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ রানার্স-আপ হয়ে সেমিতে ওঠে। ফলে সেমির লাইন-আপ হয় বাংলাদেশ বনাম ভারত এবং পাকিস্তান বনাম মালদ্বীপ।

    হাই ভোল্টেজ সেমিফাইনাল (১৮.১.২০০৩) – বাংলাদেশ বনাম ভারতঃ

    এই ম্যাচটা ফাইনালে হলেই খুশি হতেন বেশীরভাগ ফুটবল বোদ্ধা। বাংলাদেশও ভারতকে ফাইনালে মোকাবেলা করতে হবে ভেবেই নিজেদের ছক সাজিয়েছিলো। তবে প্রথম ম্যাচেই পাকিস্তানের কাছে ভারতের হারে সেই ছক উলটে যায়। তবে টানা তিন ম্যাচই জিতে বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাস উত্তুঙ্গে। সাথে ভারতের সেই সময়কার সেরা খেলোয়াড় বাইচুং ভুটিয়া সেই টুর্নামেন্টে খেলতে পারেননি। সাথে ফিরে আসছিলো ৯৯ সাফ গেমসের স্মৃতি। সেবারও শিরোপা জয়ের পথে সেমিতে সুপার-সাব শাহাজউদ্দিন টিপুর দেওয়া একমাত্র গোলে ভারতকে হারিয়েছিলো বাংলাদেশ।

    ম্যাচের শুরু থেকেই বরাবরের মতো নিয়ন্ত্রণে নেন বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা। ম্যাচের বয়স ৫ মিনিট হতেই আরমানের নেওয়া কর্নার থেকে কাঞ্চনের হেড গোল লাইন থেকে ক্লিয়ার করেন ভারতের ক্লাইম্যাক্স লরেন্স। তবে ভারতও কিছুক্ষণের মধ্যে গুছিয়ে নেয় নিজেদের। পল আঞ্চেরির দুটি শট রুখে দেন আমিনুল। চলতে থাকে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ। তবে কাঙ্ক্ষিত গোল পাচ্ছিলো না কেউই। প্রথমার্ধ শেষ হয় গোলশূণ্য অবস্থায়।

    দ্বিতীয়ার্ধে বলের উপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ ছিলো বেশী। সুযোগ পেলে বাংলাদেশও যাচ্ছিলো আক্রমণে। কিন্তু প্রতিপক্ষের ডিফেন্সিভ থার্ডে গিয়ে আর পূর্ণতা পাচ্ছিলো না। অবশেষে ৭৭ মিনিটে এলো সে মূহুর্ত। কর্ণার পায় বাংলাদেশ। আরমান এর মাপা কর্নার সেকেন্ড পোস্টে। কাঞ্চন লাফিয়ে উঠে হেড করলেন। মাঠ ও মাঠের বাইরে অসংখ্য দর্শককে আনন্দে ভাসিয়ে বল জালে। গোওওওল!!! খেলার ১৩ মিনিট বাকী থাকতে এমন গোল। ফাইনাল দেখতে শুরু করলো বাংলাদেশ এবং ভুলটা করলো।

    গোলের ঠিক চার মিনিট পরেই বক্সের কিছুটা বাইরে বল পান ভারতের আলভিটো ডি চুনহা। আশেপাশে পাস দেবেন তেমন কেউ নেই। ডিফেন্ডার ট্যাকল করতে কিছুটা গড়িমসি করেন। গোলরক্ষক আমিনুলও পোস্ট থেকে কিছুটা বাইরে। আচমকা শট নেন আলভিটো। আমিনুলের মাথার উপর দিয়ে বল জালে। খেলায় সমতা। টুর্নামেন্টে সেই প্রথম বাংলাদেশের জালে বল। ৩৫১ মিনিট নিজের পোস্ট অক্ষত রাখলেও ক্ষণিকের ভুলে গোল খেয়ে বসলেন আমিনুল। এই গোল কিছুটা ভড়কে দেয় বাংলাদেশকে। কিছুক্ষণ পরেই বাম পাশ থেকে উড়ে আসা বল অভিষেক যাদব বুকে রিসিভ করেন। সেটা থেকে বিজয়নের জোরালো শট সামান্যর জন্যে বারের উপর দিয়ে চলে যায়। তবে বাকী সময় ভালোভাবেই কাটিয়ে দেয় বাংলাদেশ।

    শুরু হয় অতিরিক্ত সময়ের খেলা। তখন পর্যন্ত গোল্ডেন গোল নিয়ম চালু ছিলো। অর্থাৎ এই ৩০ মিনিটে যে দল আগে গোল করবে তারাই জয়ী। একদল আক্রমণে উঠলেই অপর দলের সমর্থকদের বুক কাঁপে, এই বুঝি সব শেষ। তবে খুব বেশীক্ষণ এদেশের মানুষকে এমন অবস্থায় কাটাতে হয়নি। ম্যাচের বয়স তখন অতিরিক্ত সময়ের আট মিনিট। মাঝমাঠে বল কেড়ে নিয়ে মুন্নার দৌড় এবং প্রায় বিশ মিটার দূর থেকে  জোরালো লং-রেঞ্জ শট। পুরো ভারতীয় দলকে হতবাক করে এবং এদেশের আপামর মানুষকে আনন্দে ভাসিয়ে বল গোল লাইন অতিক্রম করলো। ফেভারিট ভারতকে গোল্ডেন গোলে হারিয়ে ফাইনালে বাংলাদেশ! যেখানে তাদের শিরোপা লড়াইয়ে হবে গ্রুপ পর্বে হারিয়ে আসা মালদ্বীপের সাথে। কেননা অন্য সেমিতে তারা পাকিস্তানকে ১-০ গোলে পরাজিত করেছে।

    বাংলাদেশ একাদশঃ আমিনুল; হাসান-আল-মামুন (টিটু ৯৬’), রজনী, নজরুল, সুজন, পারভেজ বাবু (ফরহাদ ৫৬’); জয়, মুন্না, আরমান; আলফাজ (উজ্জ্বল ৯১’), কাঞ্চন 

    ফাইনাল (২০.১.২০০৩) – আবারো মালদ্বীপঃ

    শিরোপা থেকে হাত ছোঁয়া দূরত্বে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষ চেনা মালদ্বীপ। তবে ম্যাচ শুরুর আগেই বাংলাদেশ ধাক্কা খায়। নিয়মিত অধিনায়ক ও দলের সেরা ডিফেন্ডার রজনী ইনজুরিতে পড়েন। দলে আসেন ভূটানের বিপক্ষে দূর্দান্ত খেলা রাইট ব্যাক টিটু। আর নিয়মিত রাইট ব্যাক হাসান-আল-মামুন চলে যান সেন্টার ব্যাক পজিশনে।

    খেলার শুরু থেকেই বরাবরের মত বাংলাদেশ আক্রমণে। ফল পেতেও দেরী হলো না। ম্যাচের তখন ১৪ মিনিট। বাম প্রান্ত দিয়ে উঠে আসা লেফটব্যাক পারভেজ বাবুর ডান পায়ের ক্রস। ডি-বক্সে থাকা কাঞ্চন বাম পায়ের জোরালো শটে জড়িয়ে দিলেন বল জালে। প্রথম দুই ম্যাচে গোল না পাওয়াতেই যাকে নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়ে গিয়েছিলো সেই কাঞ্চন করলেন টানা তিন ম্যাচে তিন গোল। ১-০ গোলে এগিয়ে গেলো বাংলাদেশ। জাতি আনন্দে মাতোয়ারা। শিরোপা এবার জিতবোই। প্রথমার্ধে এরপর বেশ কিছু সুযোগ পেলেও মালদ্বীপের কীপারের দৃঢ়তায় আর গোলের দেখা মিললো না। ১-০ তে এগিয়েই বিরতিতে গেলো দল।

    দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই মালদ্বীপ আক্রমণে। বাংলাদেশও এই সময়ে কিছুটা ডিফেন্সিভ পজিশনে চলে গেলো। যদিও তাতে শেষ রক্ষা হলো না। দ্বিতীয়ার্ধের ১৩ মিনিটে ডানদিক থেকে সহ খেলোয়াড়ের করা লো-ক্রস জালে ঠেলে দিলেন স্ট্রাইকার আলি উমার। ম্যাচে আবারো সমতা। বাকী সময় দুই দল সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও আর গোল আদায় করতে পারেনি। খেলা ১-১ গোলে ড্র।

    আবার অতিরিক্ত সময়, আবারো যেকোনো সময়ে গোল হজম করে ম্যাচ হেরে যাওয়ার আশঙ্কা। তবে এবার কষ্টটা হবে অনেক বেশী। কারণ শিরোপা যে ছিলো নিঃশ্বাস ছোঁয়া দূরত্বে।

    শুরু থেকেই দুই দল গোলের জন্যে খেলতে শুরু করে। আমিনুল বেশ কয়েকটি সুযোগ রুখে দেন। তবে সেরা সুযোগ পেয়েছিলো বাংলাদেশ। ফরহাদ ডি-বক্সের বাইরে থেকে একজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে বক্সে ঢুকেই বাম পায়ের প্লেসিং শটে বল জালে পাঠিয়ে দেন। গর্জে উঠে পুরো স্টেডিয়াম। পর পর দুই ম্যাচে ভাগ্য দেবীর এমন সহায়তা কয়টা দল পায়? কিন্তু শ্রীলংকান রেফারী অনুরা ডি সিলভা গোলের বাঁশীর পরিবর্তে বাজালেন ফাউলের বাঁশী। কারণ বক্সের বাইরে ফরহাদকে ট্যাকল করতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন মালদ্বীপের এক ডিফেন্ডার। তার নিপুণ অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে সেটাকেই ফাউল ধরে গোল বাতিল করলেন রেফারী। তবে রেফারীর সিদ্ধান্তের ওপর তো কিছু নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আসে সুযোগ। বক্সের বাইরে থেকে মুন্নার শট, ঠিক যেমন নিয়েছিলেন সেমিতে ভারতে সাথে। আফসোস! এবার পোস্ট কাঁপিয়ে ফিরে এলো বল। টানা এমন দুটি সুযোগ হাতছাড়া হওয়াতে মনে হচ্ছিলো আজ ভাগ্য বাংলাদেশের বিপক্ষে। এর মধ্যে মুন্না আবার আলোচনায়। মাঝমাঠে হার্ড ট্যাকল করতে গিয়ে মারাত্মক ফাউল করে বসেন। ইতোমধ্যে একটা হলুদ কার্ড দেখায় লাল কার্ড প্রায় নিশ্চিত। তবে বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা ঘিরে ধরেন রেফারীকে। কিছুটা তাদের চাপেই হোক আর হোম-গ্রাউন্ডের সুবিধা দিতেই হোক কার্ড আর বার করেন নি তিনি। বাংলাদেশও বেঁচে যায় দশ জনের দলে পরিণত হওয়ার হাত থেকে। এর মাধ্যমে গোল বাতিলের ভুল সিদ্ধান্তকে যেনো কিছুটা পুষিয়ে দিলেন রেফারী। অমীমাংসিত রইলো খেলা ১-১ এ।

    টাইব্রেকারের উত্তেজনাঃ

    পূর্ণ সময় শেষ। এখন খেলা টাইব্রেকারে। যেই সময়ে স্নায়ুর চাপে ভুগে দলকে ডুবিয়েছেন অনেক রথী-মহারথী। বাংলাদেশের পক্ষে পেনাল্টি নেওয়ার দায়িত্ব পান যথাক্রমে নজরুল, ফরহাদ, হাসান-আল-মামুন, মাহমুদুল  হাসান এবং সুজন।

    বাংলাদেশ প্রথমে শট নেওয়ার সুযোগ পায় আর প্রথম শটে দুই দলের হয়ে গোল করেন নজরুল এবং আহমেদ নাজ। দ্বিতীয় শটে ফরহাদ গোল করলেও ভুল করে বসেন মালদ্বীপের আশরাফ লুতফী। তার নেওয়া শট ডানদিকে ঝাঁপিয়ে ঠেকিয়ে দেন আমিনুল। একই সাথে সমালোচকদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন কেন তাকে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা গোলরক্ষক বলা হয়। টাইব্রেকারে বাংলাদেশ এগিয়ে যায় ২-১ এ। এরপর আর কোনো ভুল না করলেই দলের শিরোপা নিশ্চিত। এরপরের দুটি শটে ভুল করলেননা হাসান-আল-মামুন এবং মাহমুদুল হাসান। তবে মালদ্বীপের ইসমাইল নাসিম এবং ইব্রাহীম ফাজিলও এসময় ভুল করেননি। ফলে টাইব্রেকারে বাংলাদেশ ৪-৩ এ এগিয়ে আর খেলার নিষ্পত্তি হতে একটি শট বাকী।

    শেষ শটঃ

    এগিয়ে এলেন সুজন। এই শটে গোল দিতে পারলেই জয় নিশ্চিত। দরকার শুধু স্নায়ুর উপর নিয়ন্ত্রণ রেখে বলটাকে জালে জড়িয়ে দেওয়া। তবে বিষয়টা শুনতে যত সোজা অতটা নিশ্চয়ই নয়। তাহলে তো আর ৯৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে বাজ্জিও কিংবা মালদিনির মতো লিজেন্ড এমন ভুল করতেন না। কিছুটা লম্বা রান-আপ নিয়েই দৌড়ে এসে জোরের উপর শট। মালদ্বীপের কীপার ডাইভ দিলেন উলটো দিকে। বল জালে!!! টাইব্রেকারে ৫-৩ এ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। প্রথম বারের মতো এই শিরোপা!!!! পুরো দেশ তখন আনন্দে ভাসছে। সুজনকে কোলে তুলে সকলের উল্লাস। ল্যাপ অব অনার দিতে শুরু করলো গোটা দল। এমন দৃশ্য ফুটবলের কল্যাণে এরপর আর দেখেনি এই জাতি!

    বাংলাদেশ একাদশঃ আমিনুল; টিটু, হাসান-আল-মামুন, নজরুল, সুজন, পারভেজ বাবু (মাহমুদুল ৮৯’); জয়, মুন্না, আরমান; আলফাজ (ফরহাদ ৪৬’), কাঞ্চন

    এরপর দেড় যুগ আর সাতটি সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ পার হয়ে গেছে। শিরোপায় আর হাত ছোঁয়াতে পারেনি বাংলাদেশ। সবচেয়ে কাছাকাছি গিয়েছিলো ২০০৫ এ। সেবার ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে রানার্স-আপ হয়েই সন্তষ্ট থাকতে হয়। ২০০৩ এ শিরোপা জয়কে কেন্দ্র করে ফুটবল নিয়ে যে উন্মাদনা জেগে উঠেছিলো সারা দেশে, তা কাজে লাগাতে পারিনি আমরা। গত চারটি সাফ টুর্নামেন্টে আবার বিদায় নিতে হয়েছে প্রথম রাউন্ড থেকেই। এবারও শেষ কয়েকটি টুর্নামেন্ট এর বাংলাদেশের ফর্ম, টুর্নামেন্ট শুরুর দুই সপ্তাহ আগে কোচ পরিবর্তন সব মিলিয়ে শিরোপার আশা খুব একটা করা যাচ্ছে না। তবুও আশা থাকবে জামাল ভুঁইয়ারা আবারও দেশকে আঠারো বছর আগের সেই সন্ধ্যার কথা মনে করিয়ে দেবেন। মানুষতো আশাতেই বাঁচে!!!