• লা লিগা
  • " />

     

    দেউলিয়া বার্সার 'মানিহাইস্ট' এবং যেভাবে হলো ফেরান টরেসের 'অসম্ভব' সাইনিং

    দেউলিয়া বার্সার 'মানিহাইস্ট' এবং যেভাবে হলো ফেরান টরেসের 'অসম্ভব' সাইনিং    

    ‘বার্সা আর ব্যাক’- হাস্যোজ্জ্বল মুখে বার্সা বোর্ড সভাপতি হুয়ান লাপোর্তার দম্ভোক্তি। সেই হুয়ান লাপোর্তা- মলিন মুখে আর করুণ স্বরে যিনি মাসকয়েক আগে অনুশোচনার সুরে বলছিলেন, বার্সেলোনার দেনা এখন বিলিয়ন ইউরোর উপর! 

    সেই বার্সেলোনা ৫৫ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে ম্যান সিটি থেকে উড়িয়ে এনেছে ফেরান টরেসকে। খরচ আদৌ হয়েছে কীনা সেটা নিয়ে তর্ক হতে পারে, কিন্তু প্রায় দেউলিয়া হতে বসা এক বোর্ড নিমিষেই পকেট থেকে ছুড়ে দিচ্ছে ৫৫ মিলিয়ন ইউরো- তাও শুধু একজন খেলোয়াড়ের জন্য। 

    পিকে, বুস্কেতস, আলাবা, রবের্তো- সবাইকে অনুরোধ করা হয়েছিল ক্লাবের ‘ভালো’র জন্য কম বেতনে এই মৌসুমটা খেলার। চুক্তি অনুযায়ী বেতন দিতে না পারা এক বোর্ড মাসকয়েক পর কীভাবে আবার খেলোয়াড় সাইন করাতে পারল? রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেল বার্সেলোনা বোর্ড, নাকি এতে লুকিয়ে আছে শুভঙ্করের বড় ফাঁকি? 

     

    ফেরান টরেস আদৌ কী বার্সেলোনার খেলোয়াড়?

    ফেরান টরেসকে বার্সেলোনা সাইন করিয়েছে- এ খবর সত্য। কাম্প নউয়ের দর্শক ও অসংখ্য মিডিয়া আউটলেটের সামনে টরেসকে বার্সেলোনার নতুন খেলোয়াড় হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা আর দিনে দুপুরে কাল্পনিক কিছু হতে পারে না। হ্যাঁ, ফেরান টরেসকে ঠিকই কিনেছে বার্সেলোনা; কিন্তু বার্সেলোনার জার্সি গায়ে ঠিক এখনই খেলতে পারবেন না স্প্যানিশ এই ফরোয়ার্ড। লা লিগার নিয়ম অনুযায়ী, খেলোয়াড় অ্যামোরটাইজেশন ফি (প্লেয়ারদের ট্রান্সফার ফি এবং চুক্তি অনুযায়ী তার বেতনের যে কাঠামো সেটার সম্পূর্ণ দলিল, যা লা লিগা কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমোদিত হতে হবে) এখনোও ঠিক হয়নি তার। এছাড়াও বেতন কাঠামোর মধ্যে থেকে কীভাবে টরেসকে বেতন দেওয়া হবে- সেটাও ঠিক হয়নি। তাই আনুষ্ঠানিকভাবে এখনি বার্সেলোনার জার্সি গায়ে খেলতে পারবেন না টরেস। 

    ফেরান টরেস: নো ওয়ে হোম?

     

    ফেরান টরেসের ট্রান্সফার ফি ও বেতন- বার্সেলোনার টাকা কোথায়?

    এইতো বেশিদিন নয়। টিস্যু পেপারে মেসির চোখের জলের দাগ মুছে গেলেও বার্সেলোনা ভক্তদের কাছে মেসিকে হারানোর ক্ষত এখনোও স্মৃতিতে দগদগে। শুধু তাই নয়, সীমিত বেতন কাঠামোয় খেলোয়াড় সংকুলান করার জন্য উচু বেতনের খেলোয়াড়দেরও ছেড়ে দিতে হয়েছে। গ্রিজমান চলে গেছে আতলেতিকোতে, সেখান থেকে দেড় বছর পর ৪০ মিলিয়ন ইউরো আসবে বার্সেলোনার পকেটে। পিকে বুসকেতস কম টাকায় খেলতে রাজি করানোয় রেজিস্টার করানো গেছে মেমফিস ডিপাইকে। আগুয়েরোর অবসরের কারণে বোর্ড রেজিস্টার করতে পেরেছে দানি আলভেজকেও; এরইমধ্যে হয়ে গেছে বার্সা জার্সি গায়ে তার দ্বিতীয় অভিষেক।

    দেনা জর্জরিত এই বার্সেলোনার পক্ষে কাগজে-কলমে ফেরান টরেসকে সাইনিং করানোটা বার্সেলোনার জন্য রীতিমত অসম্ভব! কিন্তু তাও কীভাবে ফেরান টরেস হলেন বার্সেলোনার?

    এখানে কাজ করছে দুইটি বিষয়। প্রথমত, ম্যানচেস্টার সিটির সঙ্গে চুক্তির ধরন ও খোদ টরেসকে রাজি করানো- যেটা আসলে মামুলি ব্যাপার। টরেসের জন্য জায়গা নেই পেপ গার্দিওলার ম্যান সিটিতে। নাখোশ টরেস তাই ফিরতে চেয়েছেন স্পেনে, আর কাতালান সন্তান পেপ গার্দিওলাকে এ ব্যাপারে রাজি করাতে অতটা বেগ পেতে হয়নি বার্সা বোর্ডকে। ফেরান টরেসও রাজি হয়েছেন কাতালান দলের হয়ে খেলতে। এ না হয় গেল দুই পক্ষের সম্মতি- টাকা পয়সার লেনদেনটা তাহলে কীভাবে হবে? 

    ফেরান টরেসের সঙ্গে পাঁচ বছরের চুক্তি বার্সেলোনার। ৫৫ মিলিয়ন ইউরোর এই ট্রান্সফার ফি ম্যান সিটিকে দেওয়া হবে বিভিন্ন মেয়াদে। এই ৫৫ মিলিয়ন ইউরোই আবার চূড়ান্ত ফি নয়। বিশেষ শর্ত পূরণে ম্যান সিটিকে দিতে হবে আরও অর্থ; যেটা সর্বোচ্চ বেড়ে দাঁড়াতে পারে আরও ১২ মিলিয়ন ইউরোতে। মোদ্দা কথা, আগামী পাঁচ বছর ধরে চুক্তির এই অর্থ ম্যান সিটিকে শোধ করবে বার্সেলোনা।

    দ্বিতীয় বিষয়, খেলোয়াড় সাইন করানোর ব্যাপারে লা লিগার নীতি। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি মৌসুমে একটি দলকে তার খেলোয়াড়দের বেতন দেওয়ার একটি সীমা নির্ধারণ করা হয়, যেটা হিসাব করা হয় একটি দলের আয়-ব্যয়ের পার্থক্যের উপর ভিত্তি করে। সে দিক থেকে এই সাইনিং রীতিমত আকাশ কুসুম কল্পনা!

     

    এক বিলিয়ন ইউরোর বেশি দেনা এবং বার্সেলোনার ত্রাতা গোল্ডম্যান স্যাকস

    বার্সেলোনার বর্তমান দেনার পরিমাণ প্রায় ১.৩৫ বিলিয়ন ইউরো। শুধুমাত্র গতবছরেই বার্সেলোনা ক্ষতির পরিমাণ ৪৮১ মিলিয়ন ইউরো! এর মাঝে নতুন খেলোয়াড় সাইন করাতো দূরের কথা- তাদের এক পয়সা বাড়তি বেতন দেওয়া বার্সেলোনার জন্য অবাস্তব রূপকথা। তবে আপাতত স্বস্তির খবর হচ্ছে আমেরিকার প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস বড় অংকের অর্থ ধার দিতে যাচ্ছে বার্সেলোনায়, যার পরিমাণ প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ইউরো। আর দীর্ঘদিন ধরে বার্সেলোনার নতুন স্টেডিয়াম বানানোর পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে সেখানে তারা প্রায় দেড় বিলিয়ন ইউরো দিতে প্রস্তুত। এক অর্থে, অন্তত এই মৌসুম টিকে থাকার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বার্সেলোনার কাছে আছে।

    গোল্ডম্যান স্যাকস যেন বাঁচিয়েছে বার্সেলোনাকে

     

    কোভিডের ধাক্কায় জর্জরিত বার্সেলোনার জন্য আরও সুখবর, কাম্প নউতে দর্শক ফিরে আসায় অন্তত ম্যাচডে টিকিটের অর্থটা তাদের পকেটে আবার আসতে শুরু করেছে। অন্তত গত বছরের মত দুর্দশায় তাদের পড়তে হবে না তাদের এই মৌসুম শেষে।

     

    বার্সেলোনার বেতন সীমা ও ‘আসল’ শুভঙ্করের ফাঁকি

    এই মৌসুমে বার্সেলোনার বেতন সীমা কাটায় কাটায় ৯৭.৭ মিলিয়ন ইউরো, যা কীনা তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের বেতন সীমার সাত ভাগের এক ভাগ! বিস্ময়কর শোনাতে পারে- কিন্তু বার্সেলোনার চাইতে বেশি বেতন দেওয়ার ক্ষমতা আছে লা লিগার রিয়াল সোসিয়েদাদ, ভিয়ারিয়াল, ভ্যালেন্সিয়া, অ্যাথলেটিক বিলবাও’র মত ক্লাবগুলোর। এমনকি প্রিমিয়ার লিগের রেলিগেশন জোনে থাকা ওয়াটফোর্ডের বেতন সীমাও বার্সেলোনার চাইতে বেশি। বার্সেলোনা তারকা বহুল স্কোয়াডকে এই বেতন কাঠামো সীমার ভেতর নিয়ে আসতে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে হুয়ান লাপোর্তা এবং কোং. কে। কম দামে ছেড়ে দিতে হয়েছে খেলোয়াড়। ঝুলে আছে অনেক খেলোয়াড়ের ভবিষ্যত।

    কিন্তু এইখানেই লুকিয়ে আছে শুভঙ্করের ফাঁকিটা। দ্য গার্ডিয়ান  এর লা লিগা প্রতিনিধি সিড লো’র অনুসন্ধানমতে, বার্সেলোনার বর্তমান স্কোয়াডকে বেতন দিতে তাদের খরচ হচ্ছে ৪০০ মিলিয়ন ছুঁই ছুঁই ইউরো, যা কিনা তাদের অনুমোদিত বেতন সীমার চাইতে চারগুণ বেশি!

    তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, লা লিগার এসব নিয়ম-নীতির কোন বাস্তব প্রয়োগ নেই? দেউলিয়া হতে বসা একটি ক্লাব যদি অর্ধ বিলিয়নের কাছাকাছি ইউরো খেলোয়াড়দের পেছনে খরচ করতে পারে, ৫৫ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে খেলোয়াড় কিনতে পারে- সেক্ষেত্রে এসব নিয়ম অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়- এমনটাই মনে হওয়া উচিত। কিন্তু খালি চোখে এটা বেশ জটিল সমীকরণ। লা লিগার এই কড়া নীতি আছে বলেই মেসি আর বার্সেলোনায় নেই। বার্সেলোনার হয়ে খেলতে পিকে, বুসকেতস, আলাবাকে কমাতে হয়েছে বেতন। ঠিক এই কারণেই এখনও টরেস নামতে পারবেন না বার্সেলোনার হয়ে।

    তবুও কীভাবে তারা নীতির ফাঁক গলে সমাধান বের করছে সেটাই বিস্ময়কর ব্যাপার। আর তাদের সামনে এখন নতুন চ্যালেঞ্জ ফেরান টরেসেকে খেলানোর জন্য এমন কোন সমাধান খুঁজে বের করা। টরেসের বেতনের অঙ্কটাও কিন্তু কম নয়- বছরে সাড়ে বারো মিলিয়ন ইউরো।

     

    খেলোয়াড় বিদায়ের প্রক্রিয়া ও নতুন মৌসুমে অর্থের অনুসন্ধান

    যে খেলোয়াড়ের জন্য বার্সেলোনা খরচ করেছিল দেড়শ মিলিয়ন ইউরো, সেই ফিলিপ কুতিনিয়ো আবারও ধারে ক্লাব ছেড়ে যেতে পারেন কিছুদিনের মধ্যেই। শোনা যাচ্ছে, সাবেক সতীর্থ ও বর্তমান অ্যাস্টন ভিলা ম্যানেজার স্টিভেন জেরার্ড কুতিনিয়োকে দলে নিতে আগ্রহী। আর এক ম্যাচ খেললেই চুক্তি অনুযায়ী দশ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে কিনে নিতে হবে তরুণ অস্ট্রিয়ান ইউসুফ ডেমিরকে; যে কারণে আপাতত বেঞ্চেই বসে কাটাতে হচ্ছে তাকে। এই মুহূর্তে ডেমিরকে কেনার ইচ্ছা নেই বলেই হাবে-ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন বার্সা ম্যানেজার জাভির। নতুন চুক্তি নিয়ে উসমান দেম্বেলের সঙ্গে নতুনভাবে কথা শুরু হয়েছে, তবে সেদিকেও ইতিবাচক কিছুর আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। শোনা যাচ্ছে, নতুন মৌসুমে মেমফিস ডিপাই, সার্জিনো ডেস্টদের জন্য ট্রান্সফার অফার শুনতে রাজি আছে বার্সেলোনা। সঠিক দাম পেলে তাদের ছেড়ে দিতে এক সেকেন্ডও বেশি চিন্তা করতে চাইবে না বার্সেলোনা বোর্ড।

    এবার কোথায় যাবেন কুতিনিয়ো?

    এই সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের সব রাস্তা খোলা আছে বার্সেলোনা ও হুয়ান লাপোর্তার জন্য, যদিও সে পথ যথেষ্ট জটিল। তবুও আশাবাদী লাপোর্তা, শুধু তাই নয়- যাকে বলে ‘ওভার কনফিডেন্ট’! অন্যান্য ক্লাবগুলোকে তো সতর্কবার্তা দিয়েই ফেলেছেন- ট্রান্সফার মার্কেটে আবারোও ফিরে এসেছে বার্সেলোনা। প্রয়োজনে তারা দলে ভেড়াতে প্রস্তুত আরলিং হালান্ডকেও। প্রায় দেউলিয়া এক ক্লাব কীভাবে এই সংকটময় পরিস্থিতি উতরে যেতে পারে- সে দিকে চোখ থাকবে সবার।