দামে কম মানে ভালো: ফ্যান্টাসিতে কারা হতে পারেন তুরুপের তাস
ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টগুলোতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন সাধারণত তারকা ক্রিকেটাররাই। আসন্ন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগও (বিপিএল) এর ব্যতিক্রম নয়। শুরু থেকেই দেশ-বিদেশের তারকা ক্রিকেটারদের নিয়ে চলছে মাতামাতি। কে কোন দলে গেলেন, কেমন ভূমিকা রাখবেন দলে; এই আলোচনাই চলছে।
তবে তারকাকেন্দ্রিক এই আলোচনার মাঝেও আসন্ন বিপিএলে আলাদা করে আলো কাড়তে পারেন স্থানীয় ক’জন ক্রিকেটার। এদের মধ্যে বেশিরভাগ তরুণ হলেও, অভিজ্ঞ ক্রিকেটাররাও পিছিয়ে নেই। ঘরোয়া ক্রিকেটের নিয়মিত এই পারফর্মাররা ব্যাটে-বলে হতে পারেন স্ব স্ব ফ্র্যাঞ্চাইজির তুরুপের তাস।
মিজানুর রহমান
গত প্রিমিয়ার ডিভিশন টি-টোয়েন্টির সর্বোচ্চ রানের মালিক। ১১ ম্যাচে ৪১৮ । তিন হাফ সেঞ্চুরির সাথে আছে, এক সেঞ্চুরি। গড়টাও পঞ্চাশোর্ধ্ব। বলছি মিজানুর রহমানের কথা। রাজশাহীর এই ক্রিকেটার ব্রাদার্স ইউনিয়নের হয়ে ডিপিএল টি-টোয়েন্টিতে ছুটিয়েছেন রানের ফোয়ারা।
ডিপিএলে ব্যাট হাতে দারুণ পারফর্ম করে এবার সুযোগ পেয়েছেন বিপিএলেও। সিলেট সানরাইজার্স দলে নিয়েছে ডানহাতি এই ওপেনারকে। সিলেটে মিজানুরের সতীর্থ হিসেবে আছেন এনামুল হক বিজয়, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতরা। তবুও টপ অর্ডারে দেখা যেতে পারে মিজানুরকে। বিশেষ করে ডিপিএলে অমন পারফর্মের পর, সিলেটের ম্যানেজম্যান্টও তার ওপর ভরসা করতে চাইবে। মিজানুরও সেই রানের ধারা বিপিএলে বজায় রাখতে চাইবেন।
পারভেজ হোসেন ইমন
বিশ্বকাপজয়ী বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ওপেনার ছিলেন পারভেজ হোসেন ইমন। নিজের প্রথম বিপিএল খেলবেন এবারই। তাকে দলে নিয়েছে দুইবারের চ্যাম্পিয়ন ফ্র্যাঞ্চাইজি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স।
সতীর্থ হিসেবে লিটন দাস, ইমরুল কায়েস ফাফ ডু প্লেসিরা থাকলেও মারকাটারি ব্যাটিং দিয়ে স্পটলাইট কাড়তে পারেন তিনি। শুরু থেকেই চড়াও হতে পারেন প্রতিপক্ষের বোলারদের ওপর। হাতে রয়েছে প্রচুর শটস, খেলতে পারেন উইকেটের চারপাশেই। পায়ের ওপর উঠে আসা বলে ফ্লিকটাও করেন দারুণ।
ইমনের উঠে আসার মঞ্চ অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দল হলেও, নিজেকে চিনিয়েছেন ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টিতে। ফরচুন বরিশালের জার্সিতে নেমে, মিনিস্টার গ্রুপ রাজশাহীকে একাই গুড়িয়ে দেন বাঁহাতি এই ওপেনার। উইকেটের চারপাশে বাহারি শটের পসরা সাজিয়ে মাত্র ৪২ বলে করেন বিধ্বংসী এক সেঞ্চুরি।
সর্বশেষ প্রিমিয়ার ডিভিশন টি-টোয়েন্টিতেও রানের ছোঁয়া ছিল ইমনের ব্যাটে। ১৪ ম্যাচে করেছেন ৩৩০ রান। স্বীকৃত টি-টোয়ন্টিতে মোট ২৪ ম্যাচ খেলে, সংগ্রহ ৫৬৩ রান। স্ট্রাইকরেট ১২৩.৭৩।
নুরুল হাসান সোহান
দেশের সেরা উইকেটরক্ষকদের একজন বলা হয়ে তাকে। গ্লাভস হাতে দারুণ সক্রিয়। জাতীয় দল কিংবা ঘরোয়া ক্রিকেটের ম্যাচ; সম্পৃক্ত থাকেন পুরোটা সময়ই। ফিল্ড প্লেসমেন্ট, দুর্দান্ত কোনো ক্যাচ অথবা রান আউটেও তার দারুণ মুন্সিয়ানা।
লেট অর্ডারে সোহানের ব্যাটিংটাও বেশ। দীর্ঘদেহী হওয়ায় শটের রেঞ্জও বেশ বড়। প্রায়ই দেখা যায় প্যাডেল স্কুপ খেলতে। হাত খুলে খেলার অভ্যাস থাকায় ডেথ ওভারেও ক্যামিও ইনিংস খেলতে দেখা যায় তাকে।
ডিপিএলের টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টেও ছিলেন ছন্দে। ১৬ ম্যাচে করেছেন ৩৮৯ রান; টুর্নামেন্টের তৃতীয় সর্বোচ্চ।
বিপিএল খেলছেন অনেকদিন ধরেই। গত আসরে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের হয়ে খেললেও এবার তাকে দেখা যাবে ফরচুন বরিশালের জার্সিতে। টুর্নামেন্টের সেরা একাদশে থাকা তার এক প্রকার নিশ্চিতই। ওদিকে ডোয়াইন ব্রাভো, জিয়াউর রহমানের মতো ফিনিশাররা থাকলেও, ডেথ ওভারে সোহানের ব্যাটেও অনেকখানি ভরসা খুঁজবে বরিশাল।
মুনিম শাহরিয়ার
বিপিএলের ড্রাফটে অবিক্রিতই ছিলেন মুনিম শাহরিয়ার। ডানহাতি এই ব্যাটসম্যানকে নিতে আগ্রহ দেখায়নি কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজিই। তবে পরবর্তীতে ময়মনসিংহের এই তরুণকে দলে টেনেছে ফরচুন বরিশাল।
ব্যাটে বলে বেশ ভারসাম্যপূর্ণ দলই গড়েছে বরিশাল। দলে আছেন সোহান-হৃদয়-শান্তদের মতো এক ঝাঁক তরুণ খেলোয়াড়। সেরা একাদশে সুযোগ পেলে, ব্যাটের পারফর্ম্যান্সে তাদের ছাড়িয়ে যেতেই চাইবেন মুনিম।
মুনিমের এই আশার পালে হাওয়া দিচ্ছে ঘরোয়া ক্রিকেটে গত মৌসুমের পারফর্ম্যান্স। ডিপিএলের টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে খেলেছেন আবাহনীর হয়ে। প্রথম দুই ম্যাচে ওপেন করতে নেমে হাঁকিয়েছেন দুটি হাফ সেঞ্চুরি। টুর্নামেন্ট শেষে ১৪ ম্যাচ খেলে তার নামের পাশে ৩৫৫ রান। ১৪৩.১৪ স্ট্রাইকরেটটাও আশা জাগানিয়া।
শামীম হোসেন পাটোয়ারী
তারুণ্যকে প্রাধান্য দিয়েই এবারের দল গড়েছে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স। সেই দলেরই অন্যতম এক সদস্য অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী শামীম হোসেন পাটোয়ারী। ব্যাট হাতে মিডল কিংবা লেট অর্ডারে হতে পারেন দারুণ কার্যকরী। সাথে অফস্পিনটাও বোনাস।
বিশ্বকাপের পর আলোচনায় আসেন বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি দিয়ে। জেমকন খুলনার হয়ে ব্যাট হাতে উল্লেখযোগ্য কিছু না করলেও, কেবল ফিল্ডিং দিয়েই তোলপাড় করে দেন। ডাক পান জাতীয় দলেও।
নিজের অভিষেক সিরিজেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম দুই ম্যাচেই খেলেন দারুণ দুটি ক্যামিও ইনিংস। যদিও পরবর্তীতে তার ব্যাট থেকে বিশেষ কিছু আসেনি। ডিপিএল টি-টোয়েন্টিতে ১৭ ম্যাচে করেছেন ২৪৩ রান। লেট অর্ডারে ব্যাট করেও টুর্নামেন্টে তার স্ট্রাইকরেট ১৪৬।
খুব বড় ইনিংস না খেললেও, ছোট ছোট ক্যামিও দিয়ে এবার বিপিএলে নজর কাড়তে পারেন শামীম। আর ডেথ ওভারে তারুণ্যঠাসা চট্টগ্রামের রানের চাকা নির্ভর করবে তার ওপর, বলাই যায়।
শুভাগত হোম চৌধুরী
নামীদামী বিদেশি ক্রিকেটারদের পেছনে না ছুটে মিনিস্টার ঢাকা দল গড়েছে অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দিয়ে। অলরাউন্ডার শুভাগত হোমও খেলবেন ঢাকার হয়েই, যে দলে তার সতীর্থ মাশরাফি-তামিম-মাহমুদউল্লাহরা।
জাতীয় দলের পাট অনেক আগেই চুকে গেছে শুভাগতর। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটের শীর্ষ পারফর্মারদের একজন অভিজ্ঞ এই অলরাউন্ডার। তার নেতৃত্বেই কদিন আগে বিসিএলের চারদিনের টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতেছে সেন্ট্রাল জোন।
এর আগে ডিপিএল টি-টোয়েন্টিতেও ব্যাটে-বলে উজ্জ্বল ছিলেন শুভাগত। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ স্ট্রাইকরেটে ব্যাট করে ১৬ ম্যাচে ২৪২ রান, আর অফস্পিনে ১১ উইকেট।
ডাকাবুকো ব্যাটসম্যান না হলেও, টি-টোয়েন্টিতে ভালোই চলে তার ব্যাট। ডিপিএলের সর্বোচ্চ স্ট্রাইকরেট ১৬৯.২৩ অবশ্য সেই কথাই বলে। বিপিএলেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চাইবেন তিনি।
জিয়াউর রহমান
জিয়াউর রহমান; মারকুটে ব্যাটসম্যান, কব্জি আর হাতে প্রচন্ড জোর। ইনিংসের শেষদিকে নেমে চার-ছক্কায় রান তোলার সামর্থ্য আছে তার। জাতীয় দলে ব্রাত্য হয়ে পড়া এই অলরাউন্ডারকে এবারের বিপিএলে দেখা যাবে ফরচুন বরিশালের জার্সিতে।
গত মৌসুমের ডিপিএল টি-টোয়েন্টিতে ১৬ ম্যাচে জিয়াউরের ব্যাট থেকে এসেছে ২০৯ রান। অভিজ্ঞ এই অলরাউন্ডার টুর্নামেন্ট শেষ করেছেন নামের পাশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্ট্রাইকরেট নিয়ে। ১৫৭.১৪; তার মারকাটারি ব্যাটিংয়েরই সাক্ষ্য দেয়।
বল হাতেও কম যান না জিয়াউর। ডিপিএলে ১৬ ম্যাচে ১৮ উইকেট নেন ডানহাতি এই পেসার।
স্লগ ওভারে দরকারি রান, বল হাতে ব্রেক থ্রু এনে দেয়া; সব মিলিয়ে বরিশালের জন্য দারুণ এক সম্ভাবনা হতে পারেন অভিজ্ঞ জিয়াউর।
নাহিদুল ইসলাম
বিপিএলের এবারের আসরে নাহিদুল ইসলাম মাঠে নামবেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হয়ে। লোয়ার অর্ডারের ব্যাটিং আর রান আটকানো অফ স্পিনে দারুণ কার্যকর হতে পারেন তরুণ এই অলরাউন্ডার।
নিচের দিকে ব্যাট করেন বলে, ব্যাটিং প্রান্তে নিয়মিত তাকে দেখা যায় না। তবে বল হাতে অধিনায়কের ভরসা তিনি হতে পারেন। বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে ১০ ম্যাচে নেন ১১ উইকেট।
এছাড়া ঢাকা লিগের টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে অফস্পিনে নিয়েছেন ১৬ ম্যাচে ১৫ উইকেট। ব্যাট হাতেও বেশ কার্যকর তিনি, কিছুদিন আগে বিসিএল ওয়ানডে লিগেও লোয়ার অর্ডারে নেমে করেছেন মূল্যবান রান।
তানভীর ইসলাম
ঢাকা লিগের গত আসরের চতুর্থ সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী তানভীর ইসলাম। বাঁহাতি এই স্পিনার ১১ ম্যাচে নিয়েছেন ২০ উইকেট। নিজের প্রথম বিপিএল খেলবেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হয়ে।
ডিপিএলে উইকেট সংখ্যায় শীর্ষ তিনজনের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও, ইকোনোমি রেটে তানভীরই সেরা। ২০ উইকেট নিতে ওভারপ্রতি খরচ করেছেন ৪.৭৯ রান। সেই বিবেচনায় কুমিল্লার স্পিন বিভাগের অন্যতম এক অস্ত্র হতে পারেন তানভীর।
কামরুল ইসলাম রাব্বি
খুলনা টাইগার্সের জার্সিতে এবারের বিপিএল খেলবেন কামরুল ইসলাম রাব্বি। ঢাকা লিগের দুর্দান্ত পারফর্ম্যান্সই তাকে নজরে এনেছে খুলনা ফ্র্যাঞ্চাইজির। ১৭ ম্যাচে ২৫ উইকেট নিয়েছেন ডানহাতি এই পেসার। খালেদ আহমেদ, নাভিন-উল-হকদের সাথে পেস আক্রমণে আলাদা দৃষ্টি থাকবে রাব্বির ওপরও।
শেষ ঢাকা লিগে ওভারপ্রতি রান একটু বেশি গুনলেও, ব্রেক থ্রু ঠিকই দিয়েছেন দলকে। রানের লাগাম টেনে, ঢাকা লিগের ধারাবাহিকতা বজায় রাখলে খুলনার বোলিং আক্রমণের নেতৃত্ব দিতে পারেন রাব্বিই।
শহীদুল ইসলাম
বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টির ফাইনালে দারুণ এক ওভার করে খুলনাকে শিরোপা জেতান শহীদুল ইসলাম। অথচ এর একদিন আগেই চিরতরে নিজের বাবাকে হারান ডানহাতি এই পেসার। বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি দিয়ে আলোড়ন তুলেছেন। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটের নিয়মিত মুখই নারায়ণগঞ্জের এই তরুন।
বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে আট ম্যাচে নেন ১৫ উইকেট। কিন্তু বলের গতির তারতম্যে ব্যাটসম্যানদের যেভাবে ভুগিয়েছেন, তা আলাদা করে মনে রাখার মতোই। স্লোয়ার, ব্যাকহ্যান্ড স্লোয়ারে ডেথ ওভার কিংবা পাওয়ার প্লেতে রানের চাকা টেনে ধরতে বেশ কার্যকরী। করতে পারেন ভালো ইয়র্কারও।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স এবারের বিপিএলে দলে ভিড়িয়েছে শহীদুলকে। বৈচিত্র্যপূর্ণ বোলিং দিয়ে কুমিল্লার আক্রমণের ধার বাড়াতে পারেন শহীদুল।