• বঙ্গবন্ধু বিপিএল ২০২২
  • " />

     

    নাহিদুল ইসলাম: আড়ালে থেকে পাওয়ারপ্লেতে আনপ্লেয়েবল

    নাহিদুল ইসলাম: আড়ালে থেকে পাওয়ারপ্লেতে আনপ্লেয়েবল    

    আপনি কিছুটা অবাক হয়েও যেতে পারেন এই তথ্য জানার পরে। হ্যাঁ, নাহিদুল ইসলামের নামে ফেসবুকে কোন ভেরিফাইড পেজের খোঁজ পাওয়া যায়নি। যেখানে বলা যায় বাংলাদেশের অখ্যাত থেকে প্রখ্যাত, প্রায় সকল ক্রিকেটারেরই অন্তত ফেসবুকে একটি পেজের দেখা মিলবে৷ নাহিদুল ব্যতিক্রম অন্যখানেও। লাজুক হোন কিংবা না, ইউটিউবে নাহিদুলের ইন্টারভিউ আপনি খুঁজে পাবেনই না বলতে গেল। 

    অথচ নাহিদুল আজ পর্যন্ত যে পারফরম্যান্স দেখিয়ে এসেছেন, তাতে নিঃসন্দেহে তিনি ইন্টারভিউ দেওয়ার তো যোগ্য বলাই চলে! যদিও ইন্টারভিউ দেওয়ার যোগ্যতা থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই, কিন্ত নাহিদুলের চেয়ে পারফরম্যান্সে অনেক পিছিয়ে থেকেও অনেকে যে মিডিয়ায় বারবার মুখ দেখাতেও পিছপা হন না। নাহিদুলের কাছেও হয়তো সেভাবে ছুটে যায় না গণমাধ্যম। তার 'নীরব' পারফরম্যান্সের মতো তাই তিনিও থেকে যান আড়ালেই!

    আড়ালে থাকাটাই হয়তো তার পছন্দ। নয়তো বিপিএলে 'মিতব্যায়ী' বোলিংয়ের রেকর্ড গড়লেন যেদিন, সেদিনও তিনি কেন আসবেন না ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে! কিংবা খ্যাতি বা জনপ্রিয়তা তাকে তেমন টানে না। পারফরম্যান্সের সঙ্গেই সব সখ্যতা। পারফরম্যান্স দিয়েই হয়তো তিনি আসতে চান পাদপ্রদীপের আলোয়। সেদিন যেমন এলেন। 

    চলতি বিপিএলে মিরপুরের উইকেটের চরিত্র সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা হয়ে গেছে সবারই। দিনের বেলায় উইকেট থাকে বেশ ধীরগতির, রাতের বেলায় শিশিরের প্রভাবে উইকেট হয়ে যায় ভালো। দিনের বেলায় ব্যাটিংটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে, রাতের বেলায় বোলিং। তবে বরিশালের বোলাররা কুমিল্লাকে আটকে দিয়েছিলেন ১৫৮ রানেই, যা মিরপুরে রাতের ম্যাচগুলোতে এই বিপিএলে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। তবে সে রান তাড়ায় গিয়েও বরিশালের ৬৩ রানের হার প্রশ্ন তুলেছিল, লক্ষ্যটা কি একটু বড় হয়ে গিয়েছিল?

    বরিশালের সাকিব ও লিনটট জানিয়েছেন, তাতে তারা সন্তুষ্টই ছিলেন। ম্যাচের মাঝপথে হয়তো কুমিল্লা সে সংগ্রহে সন্তুষ্ট নাও থাকতে পারে। তবে দুর্দান্ত বোলিংয়ে কুমিল্লা ৬৩ রানের যে জয় পেয়েছিল, তাতে অগ্রণী ভূমিকা নাহিদুলেরই। মিরপুরের পিচ স্পিন সহায়ক বলে নাহিদুলের অসামান্য বোলিংয়ে দাগ লাগানোর কোনই সুযোগ নেই৷ রাতের বেলায় ব্যাটিং সহায়ক বনে যাওয়া মিরপুরে নাহিদুলের ওমন 'অবিশ্বাস্য' বোলিংয়ের কৃতিত্ব আসলে নাহিদুলেরই। নাহিদুলের বুদ্ধিমত্তার, নাহিদুলের দক্ষতার। 

    নতুন বলে বোলিং করার অভ্যাসটা তার পুরোনোই। ইমরুলও শুরু করালেন তাকে দিয়েই। প্রথম ওভারই মেডেন উইকেট। নিজের পরের ওভারেই পেলেন আরেকটি উইকেটের দেখা। প্রথম রানটা খরচ করলেন গিয়ে ১১তম বলে। সাধারণত ভালো শুরুর পর নাহিদুলকে দিয়ে টানা বোলিং করিয়ে গেছেন, অনেক সময়ই তার অধিনায়কদের এমনটা করতে দেখা গেছে। আগের ম্যাচে ইমরুলও টানা চার ওভার বোলিং করিয়ে নিয়েছিলেন তাকে। কিন্ত এদিন দুই ওভার করিয়েই তাকে রেখে দিলেন। গেইলের জন্য!

    ক্রিজে ডানহাতি হৃদয়ের সাথে ছিলেন বাঁহাতি শান্তও। আরেকটি উইকেট শিকার করে বরিশালের চাপ আরও বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারতো কুমিল্লা। কিন্ত নাহিদুলকে দুই ওভার করিয়ে এরপর আর অষ্টম ওভারে বোলিংয়ে নিয়ে আসে কুমিল্লা। আগের ওভারেই করিম জানাতের অসাধারণ ইনসুঙ্গারে হৃদয়ের বোল্ড হওয়ার ফলে ক্রিজে ছিলেন দুই বাঁহাতি। দুই বাঁহাতির সামনে ডানহাতি স্পিনার, চিরচেনা কৌশল। তবে এ ম্যাচে নাহিদুলকে সেসময়ে আক্রমণে আনার আসল কারণ ছিলেন ক্রিস গেইল। কুমিল্লা একাদশে একমাত্র নাহিদুলই গেইলের ব্যাটের পাশ দিয়ে বল বের করিয়ে নিতে পারেন। সেরকমই এক বেরিয়ে যাওয়া বলে গেইল পরাস্ত হয়ে উইকেটও হারান শেষমেশ। 

    সফল কুমিল্লা, সফল নাহিদুল। ২৪ বলে নাহিদুল রান দিলেন মাত্র পাঁচটি সিঙ্গেলই। যাতে গড়ে নিলেন চার ওভারের স্পেলে বিপিএলে যৌথভাবে সবচেয়ে কম রান দেওয়ার রেকর্ড। ডানহাতি এই স্পিনারের দক্ষতা ছিল, সেটা কাজেও লাগিয়েছেন দারুণ বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ রেখে। বল ভেতরে ঢুকিয়েছেন, তো সময়মতো বের করিয়ে নেওয়ার কাজটাও সেরেছেন। সব সময়ই ধন্দে রেখেছেন ব্যাটসম্যানদের। লাইনে অদল-বদল এনে অনুমেয় হওয়া থেকেও বিরত থেকেছেন। আর এতেই মিলে গেছে টানা দ্বিতীয় ম্যান অব দ্যা ম্যাচ। 

    বিপিএল ও বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ মিলিয়ে ব্যাট হাতে ১২০ ছুঁই ছুঁই স্ট্রাইক রেটে প্রায় ১৭ গড়ে ব্যাট করেছেন তিনি। অবশ্য বল হাতে দক্ষ নাহিদুল ব্যাট হাতেও বেশ কার্যকর হতে পারেন। চলতি বিপিএলের প্রথম ম্যাচেও দেখিয়েছেন তা। ২০ রানে ২ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ১৬টি রান এনে দিয়ে হয়েছেন ম্যাচসেরা। দ্বিতীয় ম্যাচে তো অসামান্য বোলিং করে জানান দিলেন দৃষ্টিসীমার বাইরে ফেলে দেওয়া যাবে না তাকে। 

    নাহিদুলকে বিপিএলের মঞ্চে প্রথমবার নামিয়েছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সই। ২০১৬ সালের সে আসরে মাশরাফির অধীনে দুটি ম্যাচ খেলার সুযোগ মিলেছিল। এরপর রংপুর রাইডার্স, রাজশাহী রয়্যালসে খেলে এখন বলা চলে তিনি বিপিএলের নিয়মিত মুখই। সময়ের সাথে নিজের উন্নতির গ্রাফটা উর্ধ্বমুখী রাখার চেষ্টাও করেছেন। বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে দারুণ বোলিংয়ে এসেছিলেন নজরে। ১১ ইনিংসে ১০ উইকেট নিয়েছিলেন মাত্র ৬.০৬ ইকোনমিতে বল করে। 

    তার আগে চার বিপিএল মিলিয়ে ১৭ ম্যাচ খেলেছিলেন ২৮ বছর বয়সী এই স্পিনার। তাতে উইকেট মাত্র ছয়টি নিতে পারলেও ওভারপ্রতি রান দেননি ৬.০৫ এর বেশি করে। তখন তার বোলিং গড় ছিল ৩৭.৮৩। টি-টোয়েন্টি কাপ সহ বিপিএল মিলিয়ে এখন তার বোলিং গড় ২২.৪। এবং কঠিন ওভারগুলোতেই তিনি বল করেন সাধারণত। তার প্রায় ৫৫% ওভারই তো বোলিং করেছেন তিনি পাওয়ারপ্লেতে। আর সেখানে ত্রিশগজী বৃত্তের বাইরে দুই ফিল্ডার রেখেও তিনি ছয়ের কম ইকোনমিতেই বল করে গেছেন। 

    টি-টোয়েন্টি কাপ সহ বিপিএলে এ পর্যন্ত পাওয়া ২১ উইকেটের ১৬টিই তিনি এনে দিয়েছেন পাওয়ারপ্লেতেই। 'পাওয়ারপ্লে স্পেশালিষ্ট' তাকে বললেও তাই ভুল হওয়ার কথা না। পাওয়ারপ্লেতে তার দুর্দান্ত ইকোনমিকাল বোলিংয়ের পেছনের কারণ, মূলত ডানহাতি ও বাঁমহাতি দুধরনের ব্যাটসম্যানের সামনেই তিনি প্রায় সমান কার্যকর। বাঁহাতির বিপক্ষে ১০ উইকেট নিতে বল করেছেন প্রায় পাঁচ ইকোনমিতে। আর ডানহাতির উইকেট নিয়েছেন ১১টি, ওভারপ্রতি ৬.৪৫ রানের বেশি দেননিও অবশ্য। 

    সবমিলিয়ে ৫৫ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে উইকেট সংখ্যা তার ৩৬ এর বেশি নয়, যদিও বেশ কার্যকরী এক বোলারই তিনি। বিশ ওভারের খেলায় ছয়ের নিচে ইকোনমি৷ অর্থাৎ, এক প্রান্তে আঁটোসাঁটো বোলিং করে যান তিনি, যার ফায়দা মেলে অন্য প্রান্তে। তার কাজটা আসলে তিনি করে যান নীরবেই। 

    মাঝেমধ্যে তার পারফরম্যান্সই তার দিকে আলো ফেলতে বাধ্য করে। ক্যামেরার সামনে নিজে না এসেও তার পারফরম্যান্সের খাতিরে তাকে নিয়েই আলোচনা চলতে থাকুক, এমন চাওয়া নিশ্চয়ই নাহিদুলের নিজেরও!