• বঙ্গবন্ধু বিপিএল ২০২২
  • " />

     

    আবার আসবেন, জ্যাকস

    আবার আসবেন, জ্যাকস    

    উইল জ্যাকস বিশ্বজোড়া ভ্রমণে বের হয়েছেন।  

    'বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র, নানানভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র’ সুনির্মল বসুর এই লাইনের কথা জানার কোন প্রশ্নই আসে না উইল জ্যাকসের। যদিও কবিতার এই লাইনের মর্মার্থ জ্যাকসের স্বপ্নের সমার্থকই বটে। যে স্বপ্নের পিছুপিছু এই ইংলিশ ছুটে চলছেন এক যাযাবর যাত্রার হাত ধরে।

    লেস্টারশায়ারের কোচ পল নিক্সন। সারের হয়ে খেলা জ্যাকসকে ভালোই চেনাজানা আছে তার। টি-টেন লিগে বাংলা টাইগার্সের কোচ ছিলেন নিক্সন। তার পাকা জহুরির চোখ জ্যাকসকে দলে ভেড়াতে ভুল করেনি। চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের কোচ হয়ে বাংলাদেশেও তিনি আনলেন জ্যাকসকে। পরের গন্তব্য পাকিস্তান। পিএসএলের ডাক এসেছে ইসলামাবাদ ইউনাইটেড থেকে। তার এই যাযাবর যাত্রার শুরু বিপিএলের আগে বিগ ব্যাশ দিয়ে।

    ***

    নিজের স্কুল সেন্ট জর্জেসের হয়ে খেলতে নেমেছেন জ্যাকস। কৈশোর থেকেই ব্যাট হাতে ছিলেন মারকুটে। সেই ম্যাচেও ঝড় উঠেছিল তার ব্যাটে। ঐটুকু বয়সে ১৩৮ বলে ২৭৯ রানের ইনিংস! অভাবনীয় বটে। প্রতিপক্ষের বোলাররা তো বেধড়ক পিটুনির সাক্ষীই হয়েছেন। মূলত সে ইনিংস দিয়েই সবার নজর কাড়েন জ্যাকস। এর কিছুদিন পর আরো একটা ম্যাচ খেলতে নামেন জ্যাকস। তার নামডাক শুনে সারের তৎকালীন পরিচালক অ্যালেক স্টুয়ার্টও হাজির হন মাঠে। ম্যাচ শেষে জ্যাকসের ভূয়সী প্রশংসা করেন স্টুয়ার্ট। 

    জ্যাকসের বয়স যখন ১৪, তখন তিনি খেলতেন যাদের সঙ্গে, তাদের বেশিরভাগই ছিলেন বয়সে তার চেয়ে ৪-৫ বছরের বড়। তাদের সঙ্গে খেলে 'স্পেশাল ট্যালেন্ট' হিসেবে বেশ নামডাক কুড়িয়েছেন তখনই। এরপর সারের মূল দলে জায়গা করে নিতেও বেশি সময় লাগেনি তার। বিশ বছর বয়সেই লিস্ট 'এ' ক্রিকেটে অভিষেক। এরপর প্রথম শ্রেণি ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে হাতেখড়িও হয় জ্যাকসের। ২০১৮ সালে তিন ফরম্যাটের ঘরোয়া আসরেই সারের জার্সিতে নামার সুযোগ হয়েছে ডানহাতি এই ব্যাটারের।

    এর আগেই অবশ্য খেলেছেন 'ছোটদের' জাতীয় দলে। ২০১৮ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড দলের হয়ে নেমেছেন মাঠে। সে আসরে নজরকাড়া কিছু করতে না পারলেও সারের জার্সিতে পরে ঠিকই আলো ছড়িয়েছেন। রয়্যাল লন্ডন ওয়ানডে কাপে নিজের তৃতীয় ম্যাচেই করে ফেলেন সেঞ্চুরি। সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখেন পরের মৌসুমেও।

    ২০১৯ সালের প্রাক-মৌসুমের এক ম্যাচে জ্যাকস করে বসেন লঙ্কাকাণ্ড। ল্যাঙ্কাশায়ারের বিপক্ষে দশ ওভারের সেই ম্যাচে ২৫ বলেই তুলে নেন সেঞ্চুরি। শুধু তাই নয়, এক ওভারে টানা ছয়টা ছক্কাও মেরেছিলেন তিনি। যদিও স্বীকৃত ম্যাচ না হওয়ায় আড়ালেই থেকে গেছে জ্যাকসের সেই তাণ্ডব। তবে বর্তমানে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে তার যে চাহিদা, সেটার নেপথ্যে ঝড়ো সে ইনিংসেরও অবদান আছে সেটা বোধহয় স্বীকার করবেন জ্যাকস নিজেও। 

    ***

    ২৫ বলে সেঞ্চুরির পর সেই মৌসুমে ১৩ ম্যাচ খেলেছিলেন জ্যাকস। ১৫২ স্ট্রাইক রেটে করেন ২৭২ রান, গড় ছিল ২০.৯। ভাইটালিটি ব্লাস্টে জ্যাকস 'ব্লাস্ট' করেন পরের মৌসুমেই। গড়টা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪, স্ট্রাইক রেটও আগের মতো দেড়শো ছাড়ানো। ১২ ইনিংসে জ্যাকসের নামের পাশে ৩০৯ রান। বল হাতে অফস্পিনে ১৬ উইকেট নিয়ে হয়ে গেলেন টুর্নামেন্ট সেরা। স্বপ্নের মতো এক মৌসুম কেটেছে সেবার জ্যাকসের। 

    এরপর ডাক পড়লো বিগ ব্যাশে। হোবার্ট হারিকেন্সের হয়ে খেলতে গেলেন, কিন্ত সামর্থ্যের ছাপ রাখতে পারেলেন না। ৮ ম্যাচে মাত্র ৭৯ রান, যা তার নামের সাথে বেমানান। বিগ ব্যাশে ব্যর্থ হলেও ভাইটালিটি ব্লাস্টে চলতে থাকে তার 'ব্লাস্ট'! ২০২১ সালের সেই আসরে ১২ ইনিংসে করেন ৩৯৩ রান। সমীহ জাগানো ১৭০.১ স্ট্রাইক রেটে!

    তেমন স্ট্রাইক রেটেরই এক ইনিংস খেলেছিলেন মিডলসেক্সের বিপক্ষে। তার ব্যাট থেকে এসেছিল ২৪ বলে ৭০ রানের এক বিস্ফোরক ইনিংস। মাত্র ১৫ বলেই ছুঁয়েছিলেন ফিফটি, যা টি-টোয়েন্টিতে ইংল্যান্ডের কারো তৃতীয় দ্রুততম ফিফটি।

    করোনার ধাক্কায় পিছিয়ে যাওয়া নিজেদের ঘরোয়া ফ্র‍্যাঞ্চাইজি লিগ, দ্যা হান্ড্রেডের প্রথম আসর শুরু হলো এরপর। সেখানেও তার 'ধামাকা' চলতে থাকলো। ব্যাট করলেন ১৭৫ স্ট্রাইক রেটে। ৭ ম্যাচে তার দল ওভাল ইনভিন্সিবল, ৮৪ বলে পেল ১৪৭ রান। 

    বিশ্বকাপের পরপরই আবুধাবিতে টি-টেন লিগ শুরু হলে জ্যাকসের হাতে এলো নিক্সনের বাংলা টাইগার্সের অ্যাসাইনমেন্ট। এর আগেও দিল্লি বুলসের হয়ে খেলেছিলেন তিনি টি-টেন লিগে। সেবার এক ম্যাচ খেললেও বাংলা টাইগার্সের হয়ে খেলেছেন ১১ ম্যাচ। মোট ৯৪ বল খেলে ১৭৯ রান। জ্যাকসের স্ট্রাইক রেট ১৯০.৪!

    ***

    উইল জ্যাকসের স্ট্রাইক রেট 'মোটাতাজা' ছিল সবসময়ই। বাংলাদেশের স্পিন সহায়ক উইকেটে এসে কি তেমন থাকবে? যারা তার খোঁজখবর রেখেছেন তাদের মনে হয়তো এই প্রশ্ন ঘুরেছে। চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের হয়ে সেই প্রশ্নের দারুণ উত্তর দিয়েছেন জ্যাকস। সকল চ্যালেঞ্জ উতরে গেছেন একেকটা দারুণ শটে খেলা বিশাল স্ট্রাইক রেটের ইনিংসে। টুর্নামেন্ট শেষে তার স্ট্রাইক রেট ১৫৫.০৫।

    দেড়শোর বেশি স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করে এই বিপিএলে একশোর বেশি রান করতে পেরেছেন মাত্র পাঁচজন। তাদের মধ্যে জ্যাকসের স্ট্রাইক রেট চতুর্থ। জ্যাকসের চেয়ে বেশি স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেছেন আরও তিনজন। তবে তাদের সবার রানের চাইতেই দ্বিগুণের বেশি রান করেছেন এই ইংলিশম্যান। ওই তিনজনের মধ্যে একমাত্র সুনিল নারাইনের রানই ছিল দেড়শোর বেশি। প্রায় ১৯৮ স্ট্রাইক রেটে নারাইনের রান ১৫৯। আর থিসারা পেরেরা ও চ্যাডউইক ওয়ালটনের রান ছিল যথাক্রমে ১২২ ও ১৪২।

    উইল জ্যাকস বিপিএলে এসে যে ১১ ইনিংস খেলেছেন, সেখানের চারটিই ছিল পঞ্চাশোর্ধ। খেলেছেন ৯২ রানের ম্যাচ জেতানো এক ইনিংস। চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের অন্যতম ভরসা হয়েই ছিলেন এই ডানহাতি ওপেনার। ৪১.৪০ গড়ে ৪১৪ রান করে প্রথমবার বাংলাদেশে এসে ফিরে গেছেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ স্কোরার হয়েই। 

    ইংল্যান্ডের ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে বড় হওয়া যে কারো জন্যেই বাংলাদেশে এসে খেলা বেশ চ্যালেঞ্জিং। জ্যাকসও জানতেন উইকেট আর কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা জরুরি। সেই কাজটা যে দারুণভাবে করেছেন তিনি, সেটা তার ব্যাটিংই জানান দিয়েছে বারবার। অবশ্য তেমন স্লো এন্ড লো স্পিনিং ট্র‍্যাকের সামনে পড়তে হয়নি জ্যাকসকে। 

    তবু বলা চলে স্পিনটা তিনি সামলেছেন দারুণ। ফুটওয়ার্ক আর শাফল করা ব্যাটিংয়ের মুন্সিয়ানায় ধাঁধায় রেখেছেন বোলারদের। অফ সাইডের দিকে সরে এসে স্পিনারদের বল সুইপে সীমানা ছাড়া করেছেন। লেগ সাইডের দিকে সরে জায়গা বানিয়ে ব্যাক ফুটে পাঞ্চ করেছেন, কাট করে চার মেরেছেন। আর পেসের বিরুদ্ধে তো চোখে লেগে থাকার মতো সব শটই খেলেছেন। ক্রিকেট ব্যাকরণ মেনে খেলা সেসব শটে 'মোটাতাজা' স্ট্রাইক রেট ধরে রাখাটা বেশ প্রশংসনীয়ই বটে। 

    ***

    জেসন রয়, স্যাম কারান, টম কারান, ওলি পোপ; নিজেদের 'প্রোডাক্ট' বলে যাদের নিয়ে গর্ব করে সারে। উইল জ্যাকসও সেই তালিকায় নাম লেখাবেন অচিরেই। কাউন্টিতে সারে দলে ওপেনিং পার্টনার জেসন রয়, স্যাম কারানদের মতো ইংল্যান্ডের দরজা খুলেছিল জ্যাকসের জন্যেও। গেল বছরেই মূল দলে করোনার হানায় পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের স্কোয়াডে ডাক পেয়েছিলেন জ্যাকস। যদিও অভিষেকের স্বাদ পাওয়া হয়নি।

    কেউ দেশের হয়ে খেলার সুযোগ হারিয়ে যাযাবর জীবনেই আনন্দ খুঁজে নেয়। কেউ আবার যাযাবর জীবনে ছুটে লক্ষ্যের টানে। জ্যাকসও আপাতত তাই করছেন। টি-টেন লিগ, বিগ ব্যাশ খেলা হয়েছে এর আগেই। বিপিএল শেষে এবার যোগ দিয়েছেন পিএসএলে। জ্যাকসের এ যাত্রায় সামনে নিশ্চয়ই যোগ হবে আরও অনেক স্টেশন। ইংল্যান্ড নামের স্টেশনের খোঁজ পাওয়ার যে লক্ষ্য, সেটিও পূরণ হবে হয়তো।

    জ্যাকস আবার হয়তো একদিন ডাক পাবেন ইংল্যান্ড দলে। তার সেই স্বপ্ন পূর্ণতা পেলে এর নেপথ্যে জড়িয়ে থাকবে বাংলাদেশ আর বিপিএলের নামও। কারণ জ্যাকস নিজেই বলেছেন, বাংলাদেশে এসে উপভোগ করেছেন তিনি। স্পিনের বিপক্ষে ব্যাটিংটাও আরো শাণিত হয়েছে। তার ব্যাটিংটাও বাংলাদেশ উপভোগ করেছে বেশ।

    পরিশেষে বলতে হয়, ধন্যবাদ জ্যাকস, আবার আসবেন।