• ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ
  • " />

     

    ব্যাটে-বলেই শুধু জেতেনি আইরিশরা, জিতেছে কৌশলেও!

    ব্যাটে-বলেই শুধু জেতেনি আইরিশরা, জিতেছে কৌশলেও!    

    ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশ্বকাপ স্কোয়াডের প্রায় অর্ধেকের দাম ৩৪.৭৫ কোটি, পুরো আয়ারল্যান্ডের শূন্য। কীভাবে সম্ভব? সেটা সম্ভব দুদলের স্কোয়াডে থাকা ক্রিকেটারদের গত আইপিএলে বিক্রি হওয়া মূল্যের হিসাবে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ২০২২ বিশ্বকাপ স্কোয়াডের আটজন আইপিএলের গত নিলামে বিক্রি হয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের বিক্রি হওয়া মূল্য যোগ করলে সেটি ত্রিশ কোটি রুপি ছাড়িয়ে যায়। আয়ারল্যান্ডের কোন ক্রিকেটারই তো আইপিএলে বিক্রি হননি। 

    বিশ্বকাপ সেই আয়ারল্যান্ড আর ওয়েস্ট ইন্ডিজকেই মুখোমুখি করিয়ে দিয়েছিল। ‘না জিতলে মরো’ এমন ম্যাচে ১৫ বল পকেটে রেখে ক্যারিবিয়ানদের হারিয়ে দেওয়াই বলে দিচ্ছে, কতটা দাপটে জিতেছে আইরিশরা। ব্যাটে-বলেই শুধু জেতেনি, জিতেছে কৌশলেও! 

    গ্রামে-গঞ্জে হাডুডু খেলায় ‘মাথা মারা’ বলে একটা কথা আছে, যার মানে মাথা দিয়ে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়কে একেবারে বাইরে ফেলে দেওয়া। ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়দেরও যে ‘অহম’, তা ‘মাথা মারা’ই খেল আইরিশদের হাতে! এই ‘মাথা মারা’র কথা দাপুটে জয়ের প্রসঙ্গের সাথে আরেকটা অর্থেও বলা, তা হচ্ছে কীভাবে দুই দলের মাথার খেলায় (কৌশলের খেলা) আইরিশরা মেরে দিয়েছে ক্যারিবিয়ানদের। 

    ***

    ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের অধঃপতনের নির্দশন বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডে আসা। সেখানে পুরান-পাওয়েলরা প্রথম ম্যাচেই জোরেশোরে ধাক্কা খেলেন দুই ধীরগতির বোলারে। মার্ক ওয়াট ও মাইকেল লিস্কের স্পিনে ৪৮ বলে ২৭ রান আনতে তাদের বিসর্জন দিতে হয়েছিল পাঁচটি উইকেট। পরের ম্যাচে জিম্বাবুয়ের স্পিন জালেও আটক, তার উপর ইনিংসের অর্ধেকই খেলতে হলো স্পিন। রাজা-উইলিয়ামসন-বার্লের দশ ওভারে চারটি উইকেট খুইয়েও তুলতে পারলো মোটে ৬৩ রান। স্পিনে ক্যারিবিয়ান হিটারদের দুর্বলতার ফায়দা আয়ারল্যান্ডও নিতে চাইবে , কিন্ত তাদের ওয়াট-রাজা মানের স্পিনার কই? ডকরেল বোলিং বাদ দিয়ে আজকাল পুরোদস্তর ব্যাটসম্যান, সিমি সিং-গ্যারেথ ডিলানি পারবেন তো? 

    সপ্তম ওভারে অধিনায়ক অ্যান্ডি বালবির্নি আনলেন ডিলানিকে, পরে তাকে আরও যে তিন ওভার করালেন, তা ১১, ১৫ ও ১৭ নাম্বার। আরেক স্পিনার সিমি সিংকে যে দুই ওভার করিয়েছেন, তা ৫ ও ১৩ নাম্বার। খেয়াল করুন তো, সবই কিন্ত বিজোড় সংখ্যা! এই মিলের একটা কারণ আছে বটে। 

    হোবার্টের বেলেরিভ ওভালের যে পিচে খেলা হলো ম্যাচটা, এতে দুই প্রান্ত থেকেই বোলিং করার সময় এক পাশের বাউন্ডারি তুলনামূলক বড় থাকে। এই ম্যাচে যেমন স্কয়ার বাউন্ডারি এক পাশে ছিল ৬০ মিটার, আর অন্য পাশে ৬৭ মিটার। ডানহাতি ব্যাটারের সময় তার স্কয়ার লেগে সীমানার দূরত্ব ছিল ৬৭ মিটার, ফাইন লেগের দিকে ৭১ মিটার এবং মিডউইকেট অঞ্চলের দিকে ৮১ মিটার, পয়েন্ট ও কাভারের দিকে যথাক্রমে ৬০ ও ৭৩ মিটার, স্ট্রেইট বাউন্ডারি ছিল ৮৪ মিটারের। ইনিংসের প্রথম ওভারেই ডানহাতি চার্লসের লেগ সাইড বাউন্ডারি ছিল বড়। অর্থাৎ, বিজোড় ওভারগুলোতে ডানহাতির লেগ সাইডে সীমানা তুলনামূলক দূরে। আর ওভার শেষে প্রান্ত বদলের কারণে জোড় ওভারগুলোতে ডানহাতির অফসাইড বাউন্ডারি তুলনায় বড় ছিল। 

    বালবির্নি সবসময় নিশ্চিত করতে চেয়েছেন, স্পিনাররা যখন ডানহাতিদের বোলিং করছে, তখন তুলনামূলক বড় বাউন্ডারির পাশটা ব্যাটারের লেগসাইডই যেন হয়। ব্যাটারদের যাতে বড় বাউন্ডারি পার করার ঝুঁকিটাই নিতে হয়। ১৫তম ওভারে এলেন ডিলানি, ৩৩ বলে ৪৬ রানে ক্রিজে থাকা ব্র্যান্ডন কিংয়ের সঙ্গী পুরান। কিংয়ের লেগ সাইড বাউন্ডারি বড়, তার মানে পুরানের অফ সাইড বড়। ডিলানি প্রথম বলটাই ভাসিয়ে ছাড়লেন অফ স্টাম্পের বেশ বাইরের দিকে। সাহসী পুরান তুলে মারলেন, বল সীমানার বেশ ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা টেক্টরের হাতে গিয়ে পড়লো টুপ করে। 

    স্পেলের শেষ ওভার করতে ইনিংসের ১৭তম ওভারে এলেন ডিলানি। ক্রিজে কিং ও পাওয়েল। তখনও ডানহাতিদের লেগ সাইড বাউন্ডারি বড়। বাউন্ডারি বড়, তাতে কি আসে যায়? ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটাররা সে ‘অহম’ ধারণ করতেই পারে। পাওয়েলও গেলেন সীমানা ছাড়িয়ে বল উড়িয়ে মারার চেষ্টায়। সেদিনের জন্য সেই ‘অহম’ খেল ‘মাথা মারা’!

    তার আগে ১১তম ওভারে এভিন লুইসও একই কাজে গিয়েছিলেন। ইনিংসের অর্ধেকপথে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দাঁড়িয়ে তখন দুই উইকেটে ৬৭ রানে। রানের গতি বাড়াতে গিয়ে ডিলানির অফ স্টাম্পের বাইরে ঝুলিয়ে দেওয়া বলে তিনিও বল আকাশে তুললেন। এই উইকেট বলগুলো ছাড়াও ডিলানি তার পুরো স্পেলেই চেষ্টা করে গেছেন, ব্যাটাররা যেন ছোট বাউন্ডারির সুবিধা নিতে না পারে। বড় বাউন্ডারিতেই ঝুঁকি নিতে বাধ্য করে তিন উইকেটের মালিক হয়েছেন। 

    ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে গ্যারেথ ডিলানি

    তার স্পিন-আক্রমণ সাথী সিমি সিংও ডেলানির মতো একই কাজটাই করে গেছেন। ১১তম ওভারে কিংয়ের সামনে রাউন্ড দ্য উইকেটের অ্যাঙ্গেল তৈরি করে রক্ষণাত্মক বল করে গেছেন, পুরানের সময় অফ স্টাম্পের বেশ বাইরে বল দিয়ে পুরানকে বড় বাউন্ডারির অফ সাইডেই খেলিয়েছেন। পাওয়ারপ্লেতে আরেক ওভারেও বুদ্ধিমত্ত্বার পরিচয় দিয়েছেন। পঞ্চম ওভারে বল করতে এসেই প্রথম বলেই চার্লসের হাতে চার খেয়েছিলেন, পরের বলেই রাউন্ড দ্য উইকেট বদলে অ্যাঙ্গেল বানিয়ে বল করলে চার্লসের কাট উঠে গেছে ফিল্ডারের হাতে। 

    সিমি ও ডিলানির ৩৬ বলে ৪ উইকেট হারিয়ে ক্যারিবিয়ানরা তুলেছিল মাত্র ২৭ রান। ইনিংস শেষে ওডিন স্মিথ বলেছিলেন, তারা পার(গড়) স্কোরের অনেক কমেই আটকে গেছেন। স্পিনারদের সহ ১৪৬ রানে আটকে দেওয়াতে তাই বাকি পেসারদেরও যথেষ্ট কৃতিত্ব দিতে হয়। আর পেসারদেরও সেই কৌশল মেনে চলার চেষ্টা ছিল প্রায় সবসময়ই। আয়ারল্যান্ডের পুরো বোলিং ইনিংসই বলা যায়, এই কৌশল মেনে চলেছে। 

    গেল ম্যাচে দুই ওভারে ৯ রানে দুই উইকেট নেওয়া ক্যাম্ফার এ ম্যাচে ১২ বল করেই পাঁচটি বাউন্ডারি খেয়েছিলেন। এক ছয় বাদে যে চারটি চারের মার পড়েছে তার উপরে, সবকটি বলেই ব্যাটসম্যান ওয়াইড লাইনের আশেপাশে থাকা বলগুলোতে হাত খুলে মারার সুযোগ পেয়েছিলেন। ক্যাম্ফারের এই পরিণতির মূলেও তো তাহলে ওই কৌশলটাই ছিল! 

    ‘এক পাশের বড় বাউন্ডারির ব্যবহার’, এই কৌশলে বোলিং করতে অনেকসময়ই দেখা যায় বোলারদের। সহজ-সরল এই কৌশল বুঝতে দশ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিজ্ঞতা থাকা লাগে না, কৌশলটার যথার্থ ব্যবহারেই আসলে সাফল্য নিহিত। যেটাই অত্যন্ত সুনিপুণভাবে করে গেছে আয়ারল্যান্ডের বোলাররা। জেনে-বুঝেও যা থেকে বেরুবার কোন উপায় বের করতে পারেনি ক্যারিবিয়ান ব্যাটাররা। 

    ***

    ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটারদের পাওয়ার হিটিংয়ের খ্যাতিতেই তো আইপিএলে এত টাকার মালিক হওয়া। ক্রিকেট বিশ্বে তো ছড়িয়েই আছে উইন্ডিজদের ছয় মারার খ্যাতি। বাউন্ডারি ছোট আর বড়, তাদের কাছে সেটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নাকি? 

    উত্তরটা পাওয়া যাবে ক্রিকভিজের দুটি তথ্যের সহায়তায়। ২০১২ থেকে ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, সব কটি বিশ্বকাপের মধ্যে প্রতি ছয়ে এবারই সবচেয়ে বেশি বল লেগেছে ক্যারিবিয়ান ব্যাটারদের। ২০১২ ও ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রতি ছয়ে বল লেগেছে ২০টিরও কম, ২০১৪ ও ২০২১ বিশ্বকাপে ২০ থেকে ২৩ এর মধ্যে। আর এবার? প্রতি ছয়ে পুরান-পাওয়েলদের লেগেছে ২৯.৪ বল! পুরানদের ছয় মারাতে ব্যর্থতা আসলে তাদের ব্যাটিং ব্যর্থতারও কথা বলে। 

    আগের বিশ্বকাপগুলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ খেলেছিল শ্রীলংকা, বাংলাদেশ ও ভারতে, যেখানে অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় বাউন্ডারি ছিল ছোট। অস্ট্রেলিয়ার বড় বাউন্ডারিই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ছক্কার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ব্যাটিং ব্যর্থতাতেও যে এটি একটা বড়সড় কারণ ছিল, সেটি বুঝা যায় ক্রিকভিজের আরেক তথ্যে। 

    এই বিশ্বকাপের আগের চারটিতে আলাদাভাবে তাকালে দেখা যায়, কোনটিতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের পড়া সবকটি উইকেটের মধ্যে আউটফিল্ডে ক্যাচের মাধ্যমে ৬০ শতাংশের বেশি উইকেট হয়নি। আর ২০২২ সালের অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের যতটি উইকেট পড়েছে, তার ৬৮ শতাংশই সার্কেলের বাইরে থাকা ফিল্ডারদের হাতে ক্যাচ দিয়ে।

    বড় বাউন্ডারি যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে প্রমাণ তো পরিসংখ্যানই দিচ্ছে। অবশ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের কেউ দাবি করতেই পারেন, ‘বাউন্ডারি’ মারতে পারার ক্ষমতাটা তাদের অহমের ব্যাপার। কিন্ত তাদের সেই অহমেই আঘাত হেনে আপাতত আয়ারল্যান্ডের ইতিহাস লেখা সারা!

    ৩৪.৭৫ কোটি বনাম ০, এই খেলায় হেরে গেল ৩৪.৭৫ কোটি। সাবধান, শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের অহমে লাগতে পারে কিন্ত!