'ফেক ফিল্ডিং' নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়!
ফিল্ডার কী করলো তাতে কী আসে যায়, তোমার কাজ বল দেখা, বল দেখো, আর দৌড়াও।
ক্রিকেটের আইনের বিশাল ঘরে নতুন কিছুর আগমন ঘটলেই, তা নিয়ে কম বিতর্ক হয় না। কোন একটা ম্যাচের কোন ঘটনা আবার সেই নতুন আইনে আলো ফেলে, আরও জোরদার হয় বিতর্ক।
‘নতুন’ বলে কারো আলো পড়ছে না তার উপর, এমনটা ভাবতে পারত ‘ফেক ফিল্ডিং’ সম্পর্কিত আইন। কিন্ত বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচে বিরাট কোহলির ‘ফেক ফিল্ডিং’ তাকে আলোকিত করে দিয়েছে সম্পুর্ণরুপেই। তবে এই আইনটা যুক্ত করার শুরুতেই এ নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি।
এই আইন নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার শন টেইটের মনোভাব তো ছিল প্রথমেই বলা কথাটারই মতো। টেইট বলেছিলেন, ছোটবেলায় যখন ক্রিকেট খেলা শুরু করেছি, প্রথমেই বলা হতো একটাই নিয়মের কথা, বল দেখো!
তাদের সময়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে এরকম প্রায়শই হতো। ফেক ফিল্ডিংকে তিনি 'এত বড়' করে দেখতে চানও না তাই। ফেক ফিল্ডিং নিয়ে শন টেইটের মত ছিল সোজাসাপ্টা- ‘এটাই, বল দেখো!’
***
অনেক সময় একটা ওয়ানডে অথবা টি-টোয়েন্টি ম্যাচের জয় পরাজয়ের ব্যবধানই হয়ে দাঁড়ায় ৫ রান। শন টেইট যেটাকে পাঁচ রান পেনাল্টি দেওয়ার মতো 'এত বড়' করে দেখতে চান না, তিনি নিজেই কিন্ত বলেছিলেন, এমন ঘটনা হরহামেশাই দেখা যেত তাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে।
অনেকের মত এই আইনের পক্ষে না থাকার ক্ষেত্রে আরেকটা যুক্তি ছিল। একজন ব্যাটসম্যান যখন হাত বদলে ডানহাতি থেকে বাঁহাতি হয়ে যাচ্ছেন, তাহলে সেটি ‘আনফেয়ার প্লে’ না হলে এটি কীভাবে হয়?
ক্রিকেটের আইনের কাজ-কারবার যাদের, সেই এমসিসির এক কর্মকর্তা ফ্রেজার স্টুয়ার্ট বিষয়টা নিয়ে যৌক্তিক ও স্বচ্ছ ধারণা দিয়েছিলেন।
একজন ব্যাটার শট মেরে রানের জন্য বের হবে, একজন ফিল্ডার যদি তখন বল তার হাতে রাখার ভান ধরেন এবং থ্রো মারার ভঙ্গি করেন, ব্যাটসম্যান বিভ্রান্তিতে পড়ে গিয়ে যতক্ষণে বুঝবে বল সে ফিল্ডারের কাছে নয়, ততক্ষণে কিছু মুহূর্ত তার চলে যাবে, যাতে সে রান নেওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়বে। ‘ফেক ফিল্ডিং’ এর ঘটনা নাকি সকল স্তরের ক্রিকেটে বেশ বেড়ে গিয়েছিল। ২০১৭ সালে তাই ফেক ফিল্ডিং সম্পর্কিত আইনের প্রণয়ন।
***
২০১৭ সালে আইনটা প্রণয়ন হওয়ার পরে ফেক ফিল্ডিংয়ে প্রথম পেনাল্টি পাওয়ার ঘটনা ঘটে ওই বছরই। ঘরোয়া ক্রিকেটে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া একাদশের সাথে কুইনসল্যান্ডের ম্যাচে।
কাভারে থাকা লাবুশেন ডাইভ দিলেও বল তাকে পাড়ি দিয়ে চলে যায়, লাবুশেন বল ধরে ফেলেছেন ভান করে থ্রোয়ের ভঙ্গি করেন, যদিও দেখা যায় পুরোপুরিভাবে থ্রো পূর্ণ করার আগেই মাঝপথে থ্রোয়ের ভঙ্গি রুখে ফেলেন লাবুশেন। হয়তো তার খেয়ালে এসে গিয়েছিল পেনাল্টির কথা। কিন্ত লাবুশেনের ওই কান্ডেই যা হওয়ার হয়ে গিয়েছিল, ব্যাটার রান নিতে গিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে উল্টো পথে ফিরেও গিয়েছিলেন 'ফেক ফিল্ডিং' বুঝে উঠার আগে, দুই আম্পায়ার মিলে পরে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া একাদশকে পাঁচ রান পেনাল্টি উপহার দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এমন একটা ঘটনা আছে। ২০১৯ সালের বিপিএলে ফেক ফিল্ডিং করে পেনাল্টি দিতে হয়েছিল মেহেদী মিরাজকে। রাজশাহী কিংসের মিরাজ তা করেছিলেন রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে এক ম্যাচে। একটা ওভারথ্রো যখন আসে তিনি ডাইভ দেন, কিন্ত বল তার নাগালের অনেক বাইরেই ছিল। পেনাল্টি পেয়ে পরে মিরাজ স্বীকার করেছিলেন, তিনি নিয়মটার সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত এবং তার ভুলই হয়েছিল৷
***
আইন বলে, স্ট্রাইকার বল খেলার পর কোনো ফিল্ডার ইচ্ছাকৃতভাবে, কথা বা কাজ দিয়ে যেকোন ব্যাটসম্যানের মনোযোগ সরিয়ে দেওয়ার, ধোঁকা বা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে সেটি আনফেয়ার প্লে বলে বিবেচিত হবে। ৪১.৫.১ ধারায় বলা এই কথার পরের ধারায়ই অবশ্য উল্লেখ করা আছে, ব্যাটারকে কোন বিভ্রান্তি, ধোঁকা বা বাধার চেষ্টা ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে কি না, সেটার সম্পুর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব যেকোন আম্পায়ারের।
৪১.৫.৩ ধারায় বলা আছে, যদি কোন আম্পায়ার মনে করেন কোন ফিল্ডার এমন কিছু করেছেন, বা করার 'চেষ্টা' করেছেন, তবে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ডেড বল ঘোষণার সাথে অপর আম্পায়ারকেও তা জানিয়ে দিবেন। সেই সাথে ৪১.৫.৬ ধারা অনুযায়ী বোলিং প্রান্তের আম্পায়ার ৫ পেনাল্টি রান দিবেন ব্যাটিং দলকে। ৪১.৫.৭ ধারা মতে ওই বলটা ওভারের একটি হিসেবে বিবেচিত না হলেও ওই বলে আয় করা রানটা কাটা যাবে না। পরের ধারায়ই বলা আছে, ডেড বল ঘোষিত হলেও ব্যাটাররা রান নিতে পারলে তা ঠিকই যুক্ত হবে স্কোরে।
***
‘ফেক ফিল্ডিং’ জোরেশোরে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল গেল বছরেই।
ফাখার জামান তার ওয়ানডেতে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির দারপ্রান্তেই ছিলেন। ১৯২ রানে থাকা ফাখার শেষ ওভারের প্রথম বলে লং অফে মেরেই দৌড় দেন৷ দ্বিতীয় রানের জন্য ফাখার যখন দৌড়ে, উইকেটকিপার কুইন্টন ডি কক বল নন-স্ট্রাইক প্রান্তে থ্রোয়ের ইশারা দেখান, তা দেখে ফাখার গাঢ় ঘুরিয়ে পেছনে তাকান, পরে আবিস্কার করেন লং অফ থেকে আসা থ্রোটা তার প্রান্তের স্টাম্পেই আঘাত হানছে।
ওই ঘটনায় যদিও পেনাল্টি রানের ঘোষণা আসেনি। আলোচনার সুত্রপাত মূলত এ কারণেই। কেন পেনাল্টি রান পেল না পাকিস্তান? কেন আউট হতে হল ফাখারকে?
তবে ম্যাচ শেষে ফাখার জামান বলেন, ভুলটা তারই ছিল। ফাখার বলেছিলেন, ‘আমি অপর প্রান্তে হারিস রউফকে দেখায় একটু বেশি ব্যস্ত ছিলাম, আমি ভেবেছিলাম সে কিছুটা দেরিতে দৌড় শুরু করায় বিপদে আছে। বাকিটা ম্যাচ রেফারির উপর, তবে আমি মনে করি না ওটা ডি ককের ভুল ছিল।'
ওই ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক টেম্বা বাভুমাও ম্যাচ শেষে ডি ককের প্রশংসাই করেছিলেন। বাভুমা বলেছিলেন, ডি কক বেশ চালাকির সাথেই কাজটা করেছে।
***
উইকেটকিপারদের নিয়ে এই আইনের আঙ্গিনায় আরও মজার কয়েকটা ঘটনা পাওয়া যায়।
২০১৯ সালে অ্যাশেজেরই এক ম্যাচে হাস্যরসের জন্ম দেন বেইরস্টো। স্ট্রাইক প্রান্তে যাওয়ার জন্য দোড়াচ্ছিলেন স্টিভ স্মিথ, কিপার জনি বেইরস্টো এমন ভান করছিলেন যেন বল এই তার কাছে আসতেই যাচ্ছে আর তিনি উইকেট ভাঙ্গতে যাচ্ছেন। স্মিথ কিপার বেইরস্টোর এমন ভঙ্গি দেখে লম্বা ডাইভ দিয়ে ঢুকেন ক্রিজে। কিন্ত পরে আবিস্কার করতে পারেন, তিনি বোকাই বনেছেন শুধু, বল ছিল নন-স্ট্রাইক প্রান্তে আর্চারের হাতে।
এই ঘটনায় বেইরস্টোকে ফেক ফিল্ডিংয়ের জন্য দোষী মানা হয়নি কিন্ত! সেই সিদ্ধান্তের পক্ষে কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যাবে- বেয়ারস্টোর এই ভান ধরাতে ফিল্ডিং টিমের কোন সুবিধা আদায়ের উদ্দেশ্য ছিল না, এবং এতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে ব্যাটারকে রান নিতে বাঁধা প্রদান করার চেষ্টাও ছিল না। বেইরস্টোর ওই ভঙ্গির সময়ে বল নন-স্ট্রাইক প্রান্তে আর্চারের হাতে এসেই গিয়েছিল প্রায়।
এমন ভাবভঙ্গি দিয়ে ব্যাটারকে খামোখা বিপদের আশঙ্কায় ফেলে দেওয়ার আরেকটা মজার ঘটনা আছে। উইকেটকিপার কুমার সাঙ্গাকারা এমন ভাব ধরেন যেন এই বল ধরেই লাগিয়ে দিচ্ছেন স্টাম্পে, তা দেখে আহমেদ শেহজাদ লাফ দিয়ে ক্রিজে ঢুকে দেখতে পান, ঘটনা আসলে ওসব কিছুই না! ঘটনাটা ঘটেছিল যদিও ২০১৫ সালে, 'ফেক ফিল্ডিং' এর আইনটা প্রণয়নই হয়নি তখনো।
***
ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে নুরুল হাসান ৫ পেনাল্টি রান না পাওয়ার যে আফসোস করেন, তা ঘটে ৭ম ওভারের দ্বিতীয় বলে। আক্সারের বলে কাট করে ডিপ পয়েন্ট অঞ্চলে বল পাঠিয়ে লিটন দ্বিতীয় রানের উদ্দেশ্য যখন দৌড়ে আছেন, তখনই পয়েন্টে থাকা বিরাট কোহলি নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তের দিকে ‘নকল থ্রো’ করেন। আর্শদীপের করা 'আসল থ্রো'তে বল আসছিল কোহলির পাশ দিয়েই। সেটি এসে কার্তিকের হাতে পৌঁছায়, লিটন সহিহ সালামতেই যদিও ক্রিজে ঢুকে গিয়েছিলেন।
গণমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, শান্ত নাকি মাঠের মধ্যেই আম্পায়ারকে এ ব্যাপারে জানিয়েছিলেন। বৃষ্টিতে খেলা থেমে থাকার সময়ে টেকনিক্যাল কনসালটেন্ট শ্রীধরন শ্রীরামও আম্পায়ারদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন এ ব্যাপারে। তবে আম্পায়াররা নাকি বলেছিলেন, তাদের নজর এড়িয়ে গিয়েছে তা। তাহলে কি পার পেয়ে গেল ভারত?
কোহলি কি 'ফেক ফিল্ডিং'ই করেছিলেন?
কোহলি যখন নকল থ্রো করেন, বল তখন আসছে স্ট্রাইক প্রান্তে। এর আগে কোহলি দেখেন আর্শদীপের থ্রো আসছে, সেই থ্রো অর্ধেকের বেশি পথ পাড়ি দেওয়ার পরই কোহলি ঘুরে যান, নকল থ্রো করেন নন-স্ট্রাইক প্রান্তের দিকে। এর কারণ কী হতে পারে? হয়তো চেয়েছিলেন, স্ট্রাইক প্রান্তে দৌড়ে থাকা লিটনকে নন-স্ট্রাইকে থ্রো দেখিয়ে বিভ্রান্তিতে ফেলতে। তার মানে বিভ্রান্তি, বা ধোঁকায় ফেলতে তার চেষ্টা ছিল। সে কারণে বলা যায়, বাংলাদেশের পাঁচ রান পেনাল্টিতে উপহার না পাওয়ার কোন কারণ ছিল না। কিন্ত সেই চেষ্টা ছিল কি না, সেটি ইচ্ছাকৃত নাকি না, তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব সম্পুর্ণই আম্পায়ারের।
বাংলাদেশের জয় ও পরাজয়ের মাঝের ব্যবধান পাঁচ রানই ছিল, শুধুমাত্র এ কারণেই, 'সবার নজর এড়িয়ে যাওয়া' ব্যাপারটার জল লাফিয়ে লাফিয়ে পৌঁছে গেছে এতদূর যে, 'প্রপার ফরামে' এ নিয়ে কথা বলার কথা মাথায় আছে বাংলাদেশের। অস্ট্রেলিয়ায় থাকা ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস কয়েকটা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন এমনটাই।
'ফেক ফিল্ডিং' সম্পর্কিত আইন শুরুতে আসার পরেই এ নিয়ে বিতর্কের দেখা দিয়েছিল। পরবর্তীতে ম্যাচের বিভিন্ন ঘটনা আরও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এবং এখানেই শেষ নয়...চলবে।