শুধু বিশ্বকাপ হারানো নয়, রোহিতের আফসোস...
আরেকটি বিশ্বকাপ, আরেকটি বিশ্বকাপ বিহীন ভারতের বিদায়। অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপের প্রস্ততির যাত্রায় ভারত প্রায় সবকিছুই ঠিক করে এসেছে, তবু আরেকবার ব্যর্থতার গল্প। ভারতের দুঃখ তা বাড়িয়ে দেয় আরও।
২০২১ বিশ্বকাপে ধাক্কা খাওয়ার পরে ভারতের চিন্তার ঘরেও লাগে ধাক্কা। 'বেশি ঝুঁকি, বেশি লাভ', এই মন্ত্রে বিশ্বাসী হতে চায় ভারতও। টি-টোয়েন্টি জিততে হলে আগ্রাসী ক্রিকেটের ঘরানাতেই ভরসা রাখতে হবে। বিশ্বকাপ রোগ সারাতে তাহলে ঔষধের সন্ধান করে ফেলল ভারত?
মানসিকতায়ও পরিবর্তন যে এনে ফেলে, সেটি পরিস্কারভাবে ফুটে উঠছিল পরবর্তীতে তাদের খেলায়। রোহিত শর্মা শুরুতে সময় নিতে পছন্দ করেন, তিনি শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক হওয়ার চেষ্টা চালালেন। নতুন ধাঁচের ক্রিকেটে অভ্যস্ত হওয়ার পথে অধিনায়কই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন।
২০২১ বিশ্বকাপের পর থেকে ২০২২ বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত, এই মাঝের সময়ে ভারতের চেয়ে বেশি গতিতে কোন দল রান তুলতে পারেনি। এসময়ে ওভারপ্রতি ৯.৩২ রান করে এনেছিল ভারত। সেই বেশি ঝুঁকির খেলায় তেমন কোন হোচট খাওয়া ছাড়াই অগ্রসর হতে থাকে ভারত। এমন আক্রমণাত্মক ক্রিকেটেই ৩৫ ম্যাচ খেলে জিতে নেয় ২৬টিতে। ৭৪ শতাংশ ম্যাচেই জয়, এত ভালো হারে জিততে পারেনি আর কোন দলই। কিন্ত একের পর এক দ্বিপক্ষীয় সিরিজ জয়ের ট্রফি নয়, ভারতের তো চাই বিশ্বকাপ!
অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে এসে দেখা গেল অন্য ভারতকে। সুপার টুয়েলভে ভারতের চার জয়ের বেশি কেউ জিততে পারেনি। কিন্ত সেসব জয়েও একটা বিষয় লক্ষণীয় ছিল, পাওয়ারপ্লেতে ভারতের সাবধানী ব্যাটিং। দুই বিশ্বকাপের মাঝের সময়ে পাওয়ারপ্লেতে ৮.৬ রান রেটে ব্যাট করছিল ভারত। অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে প্রথম ছয় ওভারে ভারত ব্যাট করে মাত্র ছয় রান রেটে। বিশ্বকাপের ষোলো দলের মধ্যে যা তৃতীয় সর্বনিম্ন। পাওয়ারপ্লেতে ভারতের চেয়ে কম রান রেটে ব্যাটিং করেছে শুধু সংযুক্ত আরব আমিরাত।
পেসবান্ধব কন্ডিশন, কোথাও পেসের সাথে অতিরিক্ত বাউন্স, আবার কোথাও সুইং-সিমের কারিশমা- সবমিলিয়ে এই বিশ্বকাপে ওপেনারদের কাজটা কঠিনই হয়ে উঠেছিল। ভারতীয় ওপেনারদের শুরুতে সতর্কতা অবলম্বনের যৌক্তিকতা অন্তত তাই চাইলে খুঁজে নেওয়া যায় কিছুটা। ধীরগতির শুরু পরে দ্রুতগতির ব্যাটিংয়ে পুষিয়ে দিতে সক্ষম হচ্ছিল বলে ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি ভারতকে।
সেমি-ফাইনালে এসে তারা যে দলের মুখোমুখি হলো, সেই ইংল্যান্ডই মূলত আগ্রাসী ক্রিকেটের ঝান্ডা উড়ানোর নায়ক। আরও একবার আক্রমণের মন্ত্র জেপে ইংল্যান্ড যখন ম্যাচ জিতে নিল, তখনও বাকি ২৪ বল। ভারত কিনা এমনই এক লক্ষ্য দিল, যা হেসেখেলেই পেরিয়ে যায় ইংলিশরা। আর সেটিই ভারতের ব্যাটিং ইনিংসকে পাঠিয়ে দিচ্ছে বিশ্লেষণাগারে।
বোলিংয়ে ভারত তাদের সেরার থেকে বহুদূরে ছিল, তাও ঠিক। সেটি নিয়ে ম্যাচ শেষে রোহিতের কণ্ঠেও ঝরেছিল আক্ষেপ। কিন্ত দিনশেষে ভারত পিছিয়ে পড়েছিল ব্যাটিংয়েই। অ্যাডিলেইড ওভালে পেস বোলাররা সেই পরিমাণে সহায়তা পাননি, যেমনটা আসলে ভারতের ব্যাটিং বলছে। সেটির পক্ষে স্বাক্ষ্য দিচ্ছে ইংলিশদের ব্যাটিংও।
ম্যাচশেষের সংবাদ সম্মেলনে এসে ভারতের কোচ রাহুল দ্রাবিড় বলেছিলেন, ১৫-২০ রান কম করেছিল ভারত। দ্রাবিড়ের কথাটা আরেকটু ভেঙ্গে বলার দরকার। যখন ১৫ ওভারে ১০০ রান করে ভারত, তখন ভারতের আরও ১৫-২০ রান বেশি থাকা উচিত ছিল, এমনটাই বলেছিলেন তিনি। সেইসাথে পুরো ইনিংসে ভারতের ১৮০-১৮৫ রান করতে পারা উচিত ছিল বলেও মনে করেছেন দ্রাবিড়।
সেই একই পিচে অ্যালেক্স হেলস-জস বাটলারের ধারালো ব্যাটের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি ভারতের বোলাররা। হেলসের মতে যে পিচ 'ভেরি ভেরি গুড', সেখানেই ভারত প্রথম দশ ওভারে টেনেটুনে গিয়েছিল ৬২ রান পর্যন্ত। আর ইংল্যান্ড পাওয়ারপ্লেতেই তুলে ফেলেছিল তার থেকে এক রান বেশি। ইংলিশ বোলারদের কৃতিত্ব না দেওয়াটাও ভুল হবে। ছোট স্কয়ার বাউন্ডারির কথা মাথায় রেখে বোলিং করে যান তারা, আর এতেই ভারতকে বাউন্ডারি পাওয়া থেকে বেধে রাখতে সক্ষম হয় তারা।
পাওয়ারপ্লের ফায়দাও কাজে লাগাতে পারেনি ভারত, প্রথম ছয় ওভারে মেরেছিল মাত্র পাঁচ বাউন্ডারি। সমান বাউন্ডারি মারতে ইংল্যান্ডের লেগেছিল মাত্র তিন ওভার! পাওয়ারপ্লের পরের আট ওভারে ভারত মারতে পারে মোটে পাঁচ বাউন্ডারি। ইংল্যান্ডের লম্বা ও বিধ্বংসী ব্যাটিং লাইনআপকে লক্ষ্য দিতে নেমেছে ভারত, অথচ ঝুঁকিবিহীন ক্রিকেটে ১৪ ওভার পর্যন্ত তারা খেলে যাচ্ছে সাড়ে ছয় রান রেটে। সময়মতো সেই ঔষধ কাজে লাগাতে যেন ভুলেই গেল ভারত!
তখন বিরাট কোহলি ক্রিজে ছিলেন ৩২ বলে ৩৮ রানে। শেষে গিয়ে তিনি যেমন বিধ্বংসী রুপ ধারণ করেন, সেটি পারেননি বলে ৪০ বলে ৫০ রানেই থেমে যায় তার ইনিংস। এর আগে রোহিত শর্মাও খেলেছিলেন ২৮ বলে ২৭ রানের কচ্ছপগতির এক ইনিংস। হাতে যখন মাত্র পাঁচ ওভার বাকি, তখনই তাই কেবল একশ পূর্ণ করেছে ভারত। স্যাম কারান পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই ডেথ ওভারে অসাধারণ বোলিং করে এসেছেন, এদিন জর্ডানও যোগ দিয়েছেন তার সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত ভারত যে রানে পৌঁছাতে পেরেছিল, সেটিও তখন সম্ভব হবে ভাবতে কষ্টই হচ্ছিল।
শেষ তিন ওভারে যখন ঢুকছে ভারত, হার্দিক পান্ডিয়া তখন ক্রিজে ২১ বলে ২৪ রানে। শেষে এমনই ঝড় তুললেন, ৩৩ বলে নিজের রানটা নিয়ে গেলেন ৬৬ তে। হার্দিক পান্ডিয়া ওমন দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছিলেন বলেই না ভারত যেতে পারলো ১৬৮ রানে! ভারতের দেওয়া সেই রান যে যথেষ্ট হয়নি, সেটি পরে বুঝিয়ে দেন জস বাটলার আর অ্যালেক্স হেলস মিলে। ধীরগতির ব্যাটিংই যে কাল হল ভারতের, সাথে কি তা-ও মনে করিয়ে দিলেন না তারা?
নতুন ঘরানার ক্রিকেটে মনযোগ দেওয়ার পর অনেকবারই রোহিত শর্মা বলেছেন, যেহেতু তারা বেশি ঝুঁকির ক্রিকেট খেলছেন, ব্যর্থতাও তাদের দেখা দিবে সেভাবে, তারা তা মেনে নিতেও রাজি থাকবেন। রোহিত শর্মা আফসোস করতেই পারেন, সেই ব্যর্থতা যেদিন দেখা দিল, সেদিন বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনাল।
কিন্ত রোহিতের আফসোস তো আদতে বাড়িয়ে দিতে পারে অন্য একটি কারণ, ওই বেশি ঝুঁকি নেওয়ার কাজটাই যে তারা করলেন না! যা করে ব্যর্থ হলে হয়তো দুঃখের পরিমাণ কিছুটা কমে আসত। রোহিতের কথার সুরে বলা যায়, ব্যর্থ হলেও তখন মেনে নেওয়াটা কিছুটা হলেও হয়তো সহজ হতো!